মনিরুল ইসলাম মুন্না
নগরীতে দিনের পর দিন বাড়ছে ব্যাটারিচালিত রিকশার সংখ্যা। এটাকে কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না। পুলিশ ও প্রশাসন যৌথ অভিযানে গেলে তাদের উপর সংঘর্ষ ও ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনাও ঘটছে। চালকরা ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণও করছেন। তাছাড়া তাদের গ্যারেজে অবৈধভাবে বিদ্যুৎ সংযোগ নিয়ে দৈনিক ৪৮০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ গ্রাস করছে। একইভাবে চালকদের বেপরোয়া গতির কারণে ঘটছে নিত্য দুর্ঘটনা। গতকাল বুধবার নগরীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে ও সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
নগরীতে ব্যাটারি রিকশা চালকদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। গতকাল বুধবার দুপুরে চান্দগাঁও থানাধীন বাহির সিগন্যাল এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। সংঘর্ষে দুই পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন বলে জানা গেছে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, গতকাল সকাল ১০টার দিকে বাহির সিগন্যাল এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে বেশ কয়েকটি ব্যাটারি রিকশা জব্দ করে পুলিশ। জব্দ করা রিকশা ফেরত ও পুলিশের হয়রানি বন্ধের প্রতিবাদে ব্যাটারি রিকশা চালকরা বাহির সিগন্যাল এলাকায় সড়ক অবরোধ করে রাখে। পরে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে সড়ক ছাড়তে বললে তাদের সঙ্গে বাগবিতন্ডা শুরু হয়। এরপর রিকশা চালকদের সঙ্গে পুলিশের পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এ সময় ব্যাটারি রিকশা চালকরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। পরে পুলিশও বিক্ষোভকারীদের উদ্দেশ্য করে টিয়ারশেল ছোড়ে। এরপর সেনাবাহিনীর সদস্যরা গেলে চালকরা সড়ক ছেড়ে পালিয়ে যায়।
এ প্রসঙ্গে চান্দগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আফতাব উদ্দিন বলেন, ‘সড়ক অবরোধ করে বেশ কয়েকজন ব্যাটারি রিকশা চালক বিক্ষোভ করেন। এতে লোকজনের যাতায়াতে ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়। পুলিশ গিয়ে তাদের রাস্তা থেকে সরে দাঁড়াতে বলতেই পুলিশের উপর হামলা করে। পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করেছে। এতে দুই পুলিশসহ কয়েকজন আহত হয়েছেন।’
নিজে বাঁচতে রিকশাসহ দুই যাত্রীকে খালে ফেলে দিলেন চালক : হালিশহরে নিজে বাঁচতে নিয়ন্ত্রণ হারানো ব্যাটারি রিকশাসহ দুই যাত্রীকে খালে ফেলে দিয়েছেন চালক। পরে স্থানীয়রা দ্রুত এগিয়ে এসে যাত্রীদের উদ্ধার করেন। তবে এ ঘটনায় কারও নাম-পরিচয় জানা যায়নি। গতকাল বুধবার বেলা সাড়ে ১১টায় হালিশহর থানার সামনের খালে এ ঘটনা ঘটে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, হালিশহর থানা সংলগ্ন রাস্তার পাশে একটি অটোরিকশা উল্টে খালে পড়ে যায়। চালক লাফ দিয়ে রাস্তায় অক্ষত থাকে। কিন্তু যাত্রীসহ গাড়িটি খালে পড়ে যায়। মূলত সেই চালক নিজে বাঁচতে গাড়িটি খালে ফেলে দেয়। পরে যাত্রীকে উদ্ধার করা হয়।
রিকশাচালক স্থানীয়দের জানান, একটি ছোট বাচ্চা তার মায়ের হাত থেকে ছুটে রিকশার সামনে দৌড়ে চলে আসে। তাকে বাঁচাতে গিয়ে রিকশাটি উল্টে যায়।
বিষয়টি নিশ্চিত করে হালিশহর থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) মোহাম্মদ জামির হোসেন জিয়া বলেন, ’অতিরিক্ত গতিতে চলছিল ব্যাটারি রিকশাটি। হঠাৎ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে রাস্তায় ডানে সরে গিয়ে পাশের খালে পড়ে যায়। চালক তাৎক্ষণিকভাবে লাফিয়ে রক্ষা পেলেও যাত্রীসহ রিকশাটি খালে পড়ে যায়। পরে স্থানীয়দের সহযোগিতায় যাত্রীদের উদ্ধার করা হয়। এখন পর্যন্ত আহতদের নাম-পরিচয় জানা যায়নি।’
গ্রাস করছে ৪৮০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ : সরকার যেখানে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে সেখানে অবৈধভাবে নগরীতে চলাচল করা ৬০ হাজারের বেশি ব্যাটারি রিকশা প্রতিদিন ৮০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ গিলে খাচ্ছে। এক্ষেত্রে ৮০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সাশ্রয় করা গেলে চট্টগ্রামের বিদ্যুৎ সংকটের সমাধান হয় বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
তথ্যমতে, প্রতিদিন দুই শিফটে একটি ব্যাটারি রিকশা ৮ ইউনিট বিদ্যুৎ চার্জ নেয়। তাহলে একটি ব্যাটারি রিকশা দৈনিক ৮ হাজার ওয়াট বা ৮ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ গ্রহণ করে। এভাবে নগরীতে ৬০ হাজারেরও বেশি ব্যাটারি রিকশা চলাচল করে। তারপরও যদি ৬০ হাজার রিকশা একই সময়ে চার্জগ্রহণ করে ৪৮০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ খরচ হবে যা চট্টগ্রামের জন্য বড় ধরনের ক্ষতি।
বিদ্যুৎ বিভাগের তথ্যমতে, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি ও বান্দরবান মিলে দৈনিক ১৩০০ মেগাওয়াটের মত বিদ্যুতের চাহিদা আছে। তার মধ্যে শুধু নগরীতে ব্যবহার হয় ২০০ মেগাওয়াটের কম বেশি। এর মধ্যে অবৈধভাবে দৈনিক ৪৮০ মেগাওয়াট যদি ব্যাটারি রিকশায় চলে যায় তবে লোডশেডিং হওয়াটা স্বাভাবিক। তবে চট্টগ্রামে উৎপাদন কেন্দ্র থাকা এবং চাহিদার বিপরীতে বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে বিধায় এখনও কোনো লোডশেডিং শুরু হয়নি। তবে দেশের অন্যান্য অঞ্চলে কিছুটা শুরু হয়েছে।
শিশু-কিশোরদের হাতে রিকশা : ব্যাটারি রিকশা চালকদের বেশির ভাগই শিশু-কিশোর। কোনো ধরনের প্রশিক্ষণ বা সড়কের নিয়ম নীতি না জেনেই তারা ব্যাটারি রিকশার স্টিয়ারিং হাতে নিচ্ছে। এতে মূল সড়কে যানজট বেড়েছে। একই সাথে দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন যাত্রীরা। প্রতিটি ব্যাটারি রিকশা চালকের বয়স ১২ থেকে ১৬ বছর। কোনরকম চালকের সিটে বসে তারা যাত্রী পরিবহন করছেন।
দেখা গেছে, এসব ব্যাটারি রিকশার নেই কোন ফিটনেস, রুট পারমিট ও চালকদের নেই ড্রাইভিং লাইসেন্স। এসব অদক্ষ চালকদের অনেকেরই প্রতিষ্ঠানিক ও ব্যবহারিক শিক্ষা না থাকায় যাত্রীদের সাথে চালকদের ঝগড়া-বিবাদ লেগেই থাকে। ভাসমান বহু অদক্ষ রিকশা চালকদের অনেকেই জোর করে যাত্রীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করারও অভিযোগ রয়েছে।
যাত্রীদের অভিযোগ, শিশু-কিশোররা রিকশা চালানোর ক্ষেত্রে রাস্তার উভয়দিক, ডান-বাম, সাইট, ওভারটেক কিছুই চেনে না। তবুও তারা রিকশাচালক। তারা রাস্তায় অতি দ্রæতগতিতে রিকশা চালাতে গিয়ে বহু দুর্ঘটনা ঘটাচ্ছে।
দিনে চালক, রাতে মাদক-জুয়ায় মত্ত : নগরীতে ব্যাটারি রিকশা চালকদের বেশিরভাগই কিশোর। তারা দিনের বেলায় বেপরোয়াভাবে রিকশা চালালেও রাতে মদ, জুয়া, গাঁজা ও ইয়াবা সেবনে মত্ত থাকে। এমনকি এতে কেউ বাধা বা প্রতিবাদ করলে দল বেধে এসে প্রতিবাদকারীর উপর হামলা চালায়।
ব্যাটারি রিকশা চালকরা মাদক সেবন করতে না পেরে হামলা চালানো নিয়ে গত ২০২৪ সালের ১০ মে পশ্চিম বাকলিয়া এক্সেস রোড এলাকার লায়লা বেগম নামে এক মহিলা থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন। তিনি পূর্বদেশকে বলেন, ‘ব্যাটারিরিকশা চালকরা আমার বাসার সামনে বসে গাঁজা ও ড্যান্ডি সেবন করছিলো। আমি ও আমার মেয়ে প্রতিবাদ করায় আমাকে এবং আমার মেয়েকে চড়-থাপ্পড় দিতে থাকে। আমাদের জানে মেরে ফেলার হুমকিও দেয়। সেজন্য আমরা সাধারণ ডায়েরি করেছি।’
গ্যারেজে-গ্যারেজে অভিযান : নগরজুড়ে ব্যাটারিচালিত রিকশার বিরুদ্ধে সূাঁড়াশি অভিযান শুরু হয়েছে। টানা কয়েকদিনের অভিযানে বিভিন্ন এলাকা থেকে জব্দ করা হয়েছে প্রায় তিন হাজার রিকশা। নগর পুলিশের আওতাধীন ট্রাফিক বিভাগের ডাম্পিং স্টেশন মনসুরাবাদ ও সদরঘাটে জায়গা প্রায় পুরোটা ভরে গেছে জব্দকৃত রিকশায়। পরে গ্যারেজগুলোতে অভিযান চালাচ্ছে জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, বিদ্যুৎ বিভাগ, চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশসহ সংশ্লিষ্টরা। এতে বেশ কয়েকটি গ্যারেজের বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্নের পাশাপাশি প্রাথমিকভাবে সতর্কতামূলক জরিমানাও করা হচ্ছে।
জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. মঈনুল হাসান পূর্বদেশকে বলেন, ‘আমরা কয়েকটি গ্যারেজে অভিযান পরিচালনা করে প্রাথমিকভাবে জরিমানা করেছি। আগামীকাল (বৃহস্পতিবার) আর জরিমানা হবে না। অবৈধ ব্যাটারি রিকশা ও গ্যারেজের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
এদিকে নগরীতে নিয়মিত চলাচলকারীরা জানান, ধীরগতির এ বাহন দ্রুতগামী গাড়ির সঙ্গে মিশে গিয়ে সিগন্যাল পয়েন্টে জ্যাম সৃষ্টি করে। হঠাৎ রাস্তার মাঝে থেমে যাত্রী ওঠা-নামা করে, বড় গাড়ির লেনে ঢুকে পড়ে- সব মিলিয়ে এগুলো এখন বড় উৎপাত। প্রতিটি মোড়ে ব্যাটারিচালিত রিকশা যানজট সৃষ্টি করছে। বেপরোয়া এই যানের কারণে প্রায় প্রতিদিন দুর্ঘটনা ও হতাহতের খবর পাওয়া যায়। সর্বশেষ গত ১৮ এপ্রিল রাতে চকবাজার থানার কাপাসগোলা এলাকায় একটি রিকশা উল্টে গিয়ে পড়ে যায় হিজড়া খালে। রিকশায় থাকা দুই নারী বেঁচে গেলেও, তাদের কোলে থাকা ৬ মাস বয়সী শিশু সেহরিজ নিখোঁজ হয়। পরদিন সকালে চাক্তাই খাল থেকে শিশুটির মরদেহ উদ্ধার করা হয়। শহরজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে শোক। পাশাপাশি ক্ষোভের সঞ্চারও হয়। ওই ঘটনার পর থেকে পুলিশ ব্যাটারি রিকশার বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে। গত চার দিনের অভিযানে ৬০০-এর বেশি ব্যাটারিচালিত রিকশা জব্দ করা হয়েছে। শুধু এ এপ্রিল মাসে পুলিশের অভিযানে ২ হাজার ৮৯৬টি ব্যাটারিচালিত রিকশা জব্দ করা হয়েছে।