ফখরুল ইসলাম নোমানী
প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের একটি সুন্দর ও অর্থবহ নাম থাকে। গ্রাহকরা নির্দিষ্ট নামেই প্রতিষ্ঠানকে চিনতে পারেন। সুন্দর নাম, সুন্দর ব্র্যান্ডিং এবং উত্তম সেবা গ্রাহকের আস্থা ও ভালবাসা ধরে রাখার অন্যতম উপকরণ। প্রতিষ্ঠান প্রয়োজনে নাম ও ব্র্যান্ডিং সংশোধন এবং পরিবর্তন পরিমার্জন করতে পারে। আইনগত এবং অন্যান্য কারণে ব্যাংকসহ যেকোন প্রতিষ্ঠানেরই এসব পরিবর্তন প্রয়োজন হতে পারে। তবে গ্রাহকদের রুচি এবং তাদের চাহিদার বিষয় খেয়াল রেখে এসব পরিবর্তন পরিমার্জন করা কোম্পানির জন্য কল্যাণকর। উন্নত দেশগুলোতে পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিকে সংক্ষেপে পিএলসি এবং প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানিকে এলটিডি দিয়ে চিহ্নিত করা হয়। এই দুই ধরণের প্রতিষ্ঠানের মৌলিক পার্থক্য হলো প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানির শেয়ার সহজে হস্তান্তরযোগ্য নয় ব্যক্তিগতভাবে তা ক্রয় বিক্রয় হতে পারে, সাধারণ মানুষ এর শেয়ার ধারণ করতে পারেনা। অন্যদিকে পাবলিক লিমিটেড কোম্পানির (পিএলসি) শেয়ার সহজে ক্রয় বিক্রয় করা যায় এবং সাধারণ মানুষ এর শেয়ার ক্রয় বিক্রয় করতে পারে। আমাদের দেশের বেশির ভাগ ব্যাংক তাদের নামের শেষে লিমিটেড শব্দটি ব্যবহার করে। অর্থাৎ এটি প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি। বিশেষজ্ঞগণ মনে করেন আমাদের দেশের ব্যাংকের নামের সাথে লিমিটেড শব্দ ব্যবহার বহুল প্রচলিত একটি ভুল। এ ধরণের ভ্রার্ন্তি দূর করতে ২০২০ সালে কোম্পানি আইন সংশোধনের মাধ্যমে পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি শনাক্ত করতে একটি নতুন ধারা যোগ করা হয়। ওই ধারায় বলা হয়েছে যে পাবলিক সীমিত দায় কোম্পানি শনাক্ত করতে তাদের নামের শেষে পাবলিক সীমিতদায় কোম্পানি বা পিএলসি লিখতে হবে। বাংলাদেশে বেশির ভাগ বাণিজ্যিক ব্যাংকের শেয়ার স্টক একচেঞ্জে কেনাবেচা হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে একটি পরিপত্র জারি করে বলা হয়েছে দেশের ব্যাংকগুলোর নামের শেষে লিমিটেডের পরিবর্তে এখন থেকে পিএলসি লিখতে হবে। ইদানীং বিভিন্ন কোম্পানিও নাম পরিবর্তন করছে। এ বিষয়ে বিজ্ঞপ্তিও দিচ্ছে অনেক কোম্পানি। পরিবর্তনের পর মূল নামের সঙ্গে পার্থক্যও দেখা যাচ্ছে না। জার্মান বহুজাতিক সিমেন্ট প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান হাইডেলবার্গ সিমেন্ট বাংলাদেশ লিমিটেড তাদের নাম পরিবর্তন করেছে। প্রতিষ্ঠানটি বিশ্বব্যাপী তাদের রিব্রান্ডিং কার্যক্রমের অংশ হিসেবে বাংলাদেশে এখন থেকে নতুন নাম হাইডেলবার্গ ম্যাটেরিয়ালস বাংলাদেশ পিএলসি হিসেবে পণ্য বাজারজাত করছে। পর্যায়ক্রমে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোকেও নিজেদের নামের শেষে পিএলসি লিখতে হচ্ছে। তাহলে কেন এ পরিবর্তন। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যেসব কোম্পানি নাম পরিবর্তন করছে তাদের মূলত নামের শেষাংশই পরিবর্তন হচ্ছে। নামের শেষে লিমিটেড শব্দটি বাদ দিয়ে পিএলসি যোগ করছে। পিএলসির পূর্ণ রূপ হলো পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি। কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের দায় ও সম্পদ চিহ্নিত করতে তার নাম সুনির্দিষ্ট হওয়া প্রয়োজন। ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান যদি কোম্পানি হয় তাহলে তার সম্পদের মালিকানা ও দায় সুনির্দিষ্ট করা অত্যাবশ্যক। সীমিতদায় কোম্পানির ক্ষেত্রে শেয়ারধারীদের দায় তাঁদের নিজ নিজ ধারণকৃত শেয়ার-মূলধন পর্যন্ত সীমিত। এর অর্থ হচ্ছে কোম্পানির দায় দেনা পরিশোধ বা আর্থিক ক্ষতির জন্য শেয়ারধারী মালিকেরা ব্যক্তিগতভাবে দায়ী থাকবেন না। কোম্পানির সম্পদ থেকে কোম্পানির দায় পরিশোধ হবে। লিমিটেড কোম্পানির অবসায়ন হলে শেয়ারধারীরা বড় জোর কোম্পানিতে তাঁদের বিনিয়োগকৃত শেয়ার-মূলধন খোয়াতে পারেন। আমরা সবাই জানি কোম্পানি গঠনের জন্য প্রতিটি দেশে সরকার নির্ধারিত সংস্থা আছে। বাংলাদেশে এ সংস্থার নাম যৌথ মূলধনি কোম্পানিগুলোর নিবন্ধকের কার্যালয় (সংক্ষেপে আরজেএসসি)। এ সংস্থা থেকে কোম্পানির নিবন্ধন নিতে হয়। কোম্পানি গঠন ও এর পরিচালনা বিষয়ে আইনও আছে। এ আইনে কোম্পানির নামের শেষে কী লিখতে হবে তা নির্ধারণ করে দেওয়া আছে। বাংলাদেশে কোম্পানি গঠন ও পরিচালনা সংক্রান্ত মৌলিক আইনটি কোম্পানি আইন ১৯৯৪ হিসেবে পরিচিত।
প্রাইভেট কোম্পানিকে পাবলিক কোম্পানিতে রূপান্তর : ব্যবসার প্রসার ও বৃদ্ধির লক্ষ্যে অনেক প্রাইভেট কোম্পানি পাবলিক কোম্পানিতে রূপান্তরিত হতে চায়। এই রূপান্তর প্রক্রিয়া জটিল হলেও সঠিক পরিকল্পনা ও পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে এটি সহজ করা সম্ভব। বাংলাদেশের কোম্পানি আইন ১৯৯৪ অনুযায়ী একটি প্রাইভেট কোম্পানিকে পাবলিক কোম্পানিতে রূপান্তরিত করা সম্ভব। এই রূপান্তরের মাধ্যমে একটি কোম্পানি বৃহত্তর বাজারে শেয়ার বিক্রি করে অধিক মূলধন সংগ্রহ করতে পারে এবং তার ব্যবসা সম্প্রসারণ করতে পারে। প্রাইভেট কোম্পানিকে পাবলিক কোম্পানিতে রূপান্তর কোম্পানির প্রসার ও উন্নয়নের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হতে পারে। তবে রূপান্তরের সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সকল দিক বিবেচনা করে সাবধানতার সাথে এগোনো উচিত। ব্যবসায় গঠনতন্ত্র রুপান্তর একটি প্রতিষ্ঠানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ তাই প্রয়োজনে অভিজ্ঞ আইনজীবী, অ্যাকাউন্ট্যান্ট এবং অন্যান্য পেশাদারদের পরামর্শ নিন।
পাবলিক এবং প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানির মধ্যে পার্থক্য : কোনো কোম্পানির মালিকানা বা এর শেয়ার মালিকানার কমপক্ষে ৫১% শেয়ার যদি সরকারি মালিকানায় থাকে এবং এর পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব সরকারের হাতে থাকে তবে তাকে সরকারি মালিকানায় পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি বলে। যে সীমাবদ্ধ দায় কোম্পানিতে সদস্যের সংখ্যা ন্যূনতম ২ বা সর্বোচ্চ ৫০ জন রাখা হয় এবং সীমাবদ্ধ দায়ের ভিত্তিতে কোম্পানিকে প্রদত্ত আইনের আওতায় নিবন্ধিত করা হয় তাকে ঘরোয়া মালিকানায় সীমাবদ্ধ কোম্পানি বা প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি বলে।
নিচে পাবলিক এবং প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানির মধ্যে পার্থক্য নিম্নরূপ : ১. প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানিতে ন্যূনতম শেয়ারহোল্ডার থাকতে হয় ২ জন আর সর্বোচ্চ শেয়ারহোল্ডার হতে পারে ৫০ জন। এর বেশি শেয়ারহোল্ডার নিতে হলে প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানিকে পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিতে রূপান্তরিত করতে হয়। অন্যদিকে পাবলিক লিমিটেড কোম্পানির ক্ষেত্রে ন্যুনতম ৭ জন শেয়ারহোল্ডার থাকতে হয় কিন্তু শেয়ার হোল্ডারের সর্বোচ্চ কোনো সংখ্যা থাকে না অর্থাৎ যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে ক্ষেত্র বিশেষে নিয়ন্ত্রক সংস্থার অনুমোদন নিয়ে যে কোনো সংখ্যক শেয়ার ইস্যু করা যায়। ২. প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানিতে নূন্যতম পরিচালক সংখ্যা ২ জন অন্যদিকে পাবলিক লিমিটেডে কোম্পানিতে ন্যূনতম পরিচালক সংখ্যা ৩ জন। ৩. প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানিতে সার্টিফিকেট অব ইনকর্পোরেশন থাকলেই কোম্পানি তার কার্যক্রম শুরু করতে পারে অন্যদিকে পাবলিক লিমিটেডে কোম্পানিতে সার্টিফিকেট অব কমেন্সমেন্ট অব বিজনেজ প্রাপ্তির পরে কোম্পানি তার কার্যক্রম শুরু করতে পারে। ৪. প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানিতে শেয়ার হস্তান্তর ও ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে কিছু বিধিনিষেধ থাকে অন্যদিকে পাবলিক লিমিটেডে কোম্পানিতে শেয়ার সহজেই হস্তান্তর করা যায়। ৫. প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি জনসাধারণের কাছে শেয়ার এবং ডিবেঞ্চার ও বন্ডসহ কোনো ধরণের ঋণপত্র বিক্রি করতে পারে না অন্যদিকে পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি আইনী প্রক্রিয়া অনুসরণ করে জনসাধারণের কাছে শেয়ার ও বন্ড বিক্রি করতে পারে। ৬. প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি পরিচালক পর্ষদ গঠন এক্ষেত্রে প্রতি বছরই পরিচালক পর্ষদ গঠনের প্রয়োজন পড়ে না পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি আইনানুযায়ী প্রতি বছরই অবসর গ্রহণকারী পরিচালকদের স্থলে নতুন পরিচালক নির্বাচন ও পর্ষদ পুনর্গঠিত হয়। ৭. প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি কাজ শুরুর জন্য ন্যূনতম মূলধন সংগ্রহ এক্ষেত্রে অপরিহার্য নয় পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি কার্যারম্ভের অনুমতিপত্র পাওয়ার জন্য একে বাধ্যতামূলকভাবে ন্যূনতম মূলধন সংগ্রহ করতে হয়।
ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো সাধারণত আমানতকারীদের কাছ থেকে অর্থ নিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করে। এ কারণে জনগণের কাছে তাদের দায় বদ্ধতা রয়েছে এবং নামের শেষে পিএলসি লিখতে হচ্ছে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে জনগণের কাছে দায়বদ্ধ বা জনগনের বিনিয়োগ বা আমানত রয়েছে এমন যে কোনো কোম্প ানির নামের শেষে পিএলসি লিখতে হয়। বাংলাদেশেও এটি চালু করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোকেও নিজেদের নামের শেষে পিএলসি লিখতে হচ্ছে। বাস্তবতা হচ্ছে ব্যাংকের নামের শেষে পিএলসি যুক্ত করার ফলে নতুনভাবে একটি ব্যাংকের সুমান বৃদ্ধি বা হ্রাস, উন্নত বা অনুন্নত প্রকাশ পায় না বা গ্রাহকদের আস্থা হ্রাস বা বৃদ্ধি কোনো কিছুর ওপর প্রভাব বিস্তার করে না। সম্প্রতি বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকের নামের শেষে পিএলসি যুক্ত করা হয়েছে যা শুধু বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশ পরিপালনের জন্য। গ্রাহকদের মধ্যে যেন প্রতিষ্ঠানের কোন পরিবর্তনের প্রভাব না পড়ে সেদিকে খেয়াল রেখে আগে থেকেই বিষয়গুলো তাদের অবহিত করা যেতে পারে। গণমাধ্যমে সংবাদের পাশাপাশি সহজে চোখে পড়ার মতো বিজ্ঞাপন প্রচার ও মুঠোফোনে ক্ষুদেবার্তা প্রেরণ করে গ্রাহকদের অবহিত করা যায়। পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও এসব প্রচারণা চালালে তা বেশি সংখ্যক মানুষের দৃষ্টিগোচর হবে। ব্যাংক-কোম্পানিগুলোর নাম, লোগো ও ব্র্যান্ডিং পরিবর্তন বা লিমিটেড থেকে পিএলসিতে রূপান্তরে গ্রাহকের কিছুই যায় আসে না। গ্রাহকের চাহিদা উত্তম ব্যাংকিং সেবা তারা চান জমানো অর্থের নিরাপত্তা। ব্যাংক-কোম্পানিতে বিনিয়োগকারী ও আমানতকারীদের ভয় থাকবে বিনিয়োগ ও জমাকৃত আমানতের সুরক্ষা। তাই ব্যাংক-কোম্পানিগুলো ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালনায় সংশ্লিষ্টদের এসব বিষয় বিবেচনায় রাখতে হবে। প্রাইভেট কোম্পানিকে পাবলিক কোম্পানিতে রুপান্তের কোম্পানির প্রসার, ব্যবসা সম্প্রসারণ ও উন্নয়নের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হতে পারে।
লেখক : লেখক ও কলামিস্ট