ব্যাংকিং খাতে আস্থা ফিরিয়ে আনতে চাকরিচ্যুতি প্রকৃত সমাধান নয়

1

সালাহউদ্দিন শাহরিয়ার চৌধুরী

স্বাধীনতা পূববর্তী আমাদের দেশে ব্যাংক ছিল ১২টি। ১৯৭২ সালে এসব ব্যাংককে একীভূত করে ছয়টি সরকারি ব্যাংকে রূপান্তর করা হয়।তখন থেকে শুরু হয় স্বাধীন বাংলাদেশে ব্যাংক খাতের যাত্রা। বেসরকারি খাতে বাংলাদেশে প্রথম ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৮২ সালে ১২ এপ্রিল আরব-বাংলাদেশ (এবি) ব্যাংক লিমিটেডের মাধ্যমে বেসরকারি খাতে যাত্রা শুরু হয়।পরবর্তী এক দশকে দেশে বেসরকারি ব্যাংকের সংখ্যা দাঁড়ায় আটটি।এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত পূবালী ও উত্তরা ব্যাংক বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া হয়।নতুন করে অনুমোদন পায় ইসলামি ব্যাংক, ইউসিবি, ন্যাশনাল ব্যাংক, দি সিটি ব্যাংক ও আইএফআইসি ব্যাংক লিমিটেড।১৯৯১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত ডাচ-বাংলা, ইস্টার্ন, এক্সিম, আল আরাফা, সাউথইস্ট, প্রাইম, প্রিমিয়ারসহ মোট ২২টি ব্যাংকের অনুমোদন দেওয়া হয়।২০১২ সাল থেকে আরও ১২টি বাণিজ্যিক ব্যাংকের অনুমোদন দেওয়া হয়।এসব ব্যাংকের মধ্যে দেশীয় উদ্যোক্তাদের মালিকানায় ছয়টি এবং প্রবাসী বাংলাদেশিদের মালিকানায় দেওয়া হয় তিনটি ব্যাংক।প্রবাসীদের মালিকানায় অনুমোদন পায় এনআরবি ব্যাংক, এনআরবি গ্লোবাল ও এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক।
বিগত সরকারের আমলে নানা কারনে দেশের ছয়টি ব্যাংক চট্টগ্রাম ভিত্তিক এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে ছিলো।২০১৭ সালের ৫ জানুয়ারি ইসলামী ব্যাংকের আগের মালিকদের হটিয়ে নিয়ন্ত্রণ নেয় এস আলম শিল্প গ্রæপ শুধু ইসলামী ব্যাংক নয়, ২০১৭ সালে শরিয়াহভিত্তিক আরেক ব্যাংক স্যোসাল ইসলামী ব্যাংকেরও দখলে নেয় চট্টগ্রামের ঐ শিল্প গ্রæপ এবং এই সমস্ত ব্যাংকগুলো ব্যাংকের মালিকানা পরিবর্তন হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন সাপেক্ষে।৫ই আগষ্ট সরকার পরিবর্তনের পর মালিকানা বেহাত হয়ে যাওয়া ব্যাংকসমূহের মালিকানা ফিরে পেতে পুরোনো উদ্যোক্তারা হয়ে উঠেন তৎপর এবং ক্ষমতাচ্যুত সরকারের আমলে দখল হওয়া বিভিন্ন ব্যাংক বিশেষ করে জোর করে মালিকানা পরিবর্তন করা ব্যাংকগুলোতে দীর্ঘদিনের বঞ্চনার শিকার কর্মকর্তা কর্মচারীরা বিরুদ্ধে হয়েছেন সরব। এমন পরিস্থিতিতে সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে গত ৬ আগষ্ট মালিক এবং কর্মকর্তাদের একটি অংশ নতুন মালিকদের কাছ থেকে সুবিধাভোগী কর্মকর্তাদের ব্যাংক থেকে বের করে দেন। সবচেয়ে বেশি অস্থিরতা দেখা গেছে বেসরকারি খাতের ইসলামী ব্যাংকে এমনকি ব্যাংকটিতে দুই গ্রæপের দ্বন্ধে ৭ জন গুলিবিদ্ধসহ অন্তত ১৫ জন আহত হয়েছেন। এছাড়া স্যোসাল ইসলামী ব্যাংক, আইএফআইসি ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকসহ অন্তত ১০টি ব্যাংকে মালিকানার দ্বন্ধ প্রকাশ্য হয়ে উঠেছে। নানাভাবে এসব ব্যাংকের তহবিলে তছরূপ এবং তারল্য সংকটের কারনে এসব ব্যাংক গ্রাহকদের টাকা ফেরত দিতে পারছে না, যার কারণে ঐ সমস্ত ব্যাংকগুলোর গ্রাহকের আস্থা হারিয়েছে। গ্রাহক আস্থা হারানোর কারণে ব্যাংকগুলো দিনে দিনে আরো দুর্বল হচ্ছে যার পরিপ্রেক্ষিতে নিয়ন্ত্রনকারী বাংলাদেশ ব্যাংক টাকা ধার দিয়ে এসব ব্যাংকের কার্যক্রম কোনোমতে টিকিয়ে রেখেছে।
নিজেদের স্বার্থে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সরকার রাজনৈতিক বিবেচনায় নতুন নতুন ব্যাংকের অনুমোদন প্রদান করে থাকে। পরবর্তীতে সেসব ব্যাংক সমূহ নানা কারনে সরকারের আজ্ঞাবহ ভূমিকা পালন এবং নানা অনিয়মে জড়িয়ে পড়ে।ফলে সরকার পরিবর্তনের সাথে সাথে ঐ ব্যাংকসমূহে পরিচালনা বোর্ডে পরিবর্তন দেখা দেয় এবং এই পরিবর্তনের ফলে সবচেয়ে বেশী রোষানলে পড়তে হয় কিছু কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের এবং তাদের অনেককেই করা হয় চাকরিচ্যুত। তাদের অপরাধ তারা পূবর্তন পরিচালনা বোর্ডের অধীনে চাকরিপ্রাপ্ত অথবা তারা পূর্বতন পরিচালনা বোর্ডের নিদের্শনা পালন করেছে।কিন্তুঅনিয়মের সাথে জড়িত না থাকলেও কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চাকরিচ্যুত করা হয় যাদের পক্ষে ব্যাংকে দুর্নীতি বা অর্থ লোপাটের কোন সুযোগই থাকে না, তারা শুধু ভয়ভীতি এবং চাকরি রক্ষার্থে আদেশ পালন করায় তাদের হতে হয় বলির পাঠা। বর্তমান সময়ে যারা বেসরকারী ব্যাংকে চাকরি করেন তাদের সবসময় তটস্থ থাকেন উর্ধতন কর্তৃপক্ষের অনিয়মের আদেশ পরিপালন করতে হয় বলে, যা পালন করলেও বিপদ না করলেও বিপদ তাই উভয় সংকটের ফলে তাদের সবসময় ঝুঁকি নিতে হয়।এছাড়া এখনো যারা চাকরিতে আছে তাদের অনেকেই মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত, অনেক ব্যাংক কর্মকর্তা শুধু ব্যাংকে চাপের মধ্যে নয়, ব্যাংকে আমানতের টার্গেট পূরণ করতে গিয়ে যাদের মাধ্যমে ঐ ব্যাংকের টাকা জমা করেছেন তাদের হাতে প্রতিনিয়ত নিগৃহত হচ্ছেন।বিভিন্ন ব্যাংকের চাকরিচ্যুত করা হয়েছে শত শত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক পিএলসি, ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংক পিএলসি অন্যতম। লক্ষনীয় বিষয় যে সমস্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চাকরিচ্যুত করা হয়েছে তাদের অধিকাংশের বাসস্থান চট্টগ্রামে। কিন্তু যাদের চাকরিচ্যুত করা হয়েয়ে তাদের মধ্যে অনেকেই নিরীহ কর্মকর্তা ও কর্মচারী। এদের চাকরিচ্যুত করার ফলে দিশেহারা হয়ে পড়েছে তাদের পরিবার,তারা শুধু আর্থিক সংকটের মুখে নয়,তাদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনও হয়রানির মুখে, এমতাবস্থায় অনেকেই নেমেছে রাস্তায়।
বিশ্বব্যাংক, আইএমএফসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে তাদের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনগুলোতে ব্যাংকগুলোতে সুশাসনের ঘাটতিকে আর্থিক খাতের বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে উল্লেখ করেছে।ব্যাংক খাতে অস্থিরতার আরেকটি কারণ হলো, নতুন ব্যাংকের প্রয়োজন না থাকলেও নতুন নতুন ব্যাংকের অনুমোদন। বাংলাদেশ ব্যাংকের আপত্তি থাকলেও সরকারের ইচ্ছায় ব্যাংকের অনুমোদন দেয়। ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধীনতা বিভিন্ন ক্ষেত্রে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে ক্ষুন্ন হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বা উর্ধ্বতন কর্মকর্তরা যদি রাজনৈতিক চাপের মুখে বা নিজের আর্থিক লাভের আশায় অনিয়ম করে তাহলে কোন ভাবেই ব্যাংকিং সেক্টরে বিশ্বাস বা আস্থা ফিরে আসবে না।
যদি কোনো অনিয়মের কারণে বা সুশাসনের অভাবে ব্যাংকিং খাতে কোনো প্রভাব পড়ে, তবে তা দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিকে ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তার দিকে নিয়ে যায়।বিভিন্ন খাতে ভুল নীতি গ্রহণ, বেনামি ঋণ, অনিয়ম, দুর্নীতি ও অর্থপাচারের কারণে দেশের অর্থনীতিতে ও ব্যাংক খাতে বেশ নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।বর্তমানে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত যে নাজুক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে,তা থেকে উত্তরণের জন্য সবার একীভূত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। ব্যাংক খাত সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে ঠিক করতে হবে কোন সংস্কার এখনই শুরু করা দরকার, না হলে বড় বিপদ আসবে পুরো আর্থিক খাতে।ব্যাংক খাত চলে আস্থার উপর, তাই ব্যাংকিং নীতিমালা এমনভাবে প্রণীত হওয়া দরকার,যাতে তা দেশের উন্নয়নে কাজে লাগে, এতে যেন সংকট তৈরি না হয় সেদিকে গুরুত্ব দিতে হবে। দেশের স্বার্থে এ খাতের ওপর জনগণের আস্থার সম্পর্কে যেন কোনো ধরনের চিড় না ধরে, সেজন্য সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।এ খাতে যাতে অনাকাক্সিক্ষত কোনো দুর্ঘটনা না ঘটে সেজন্য বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাংলাদেশ সরকারকে আরও মনোযোগী হতে হবে। আর্থিক খাতের বিভিন্ন কেলেঙ্কারি, ঋণ খেলাপি, দেশের টাকা বাইরে পাচার করা ইত্যাদি অপকর্মের সাথে যারা যুক্ত হয়ে দেশের ক্ষতি করেছেন তাদের বিরুদ্ধে অতি দ্রুত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এই পরিস্থিতি থেকে দেশের আর্থিক খাতকে রক্ষা করতে হলে দ্রুততার সাথে ব্যাংকিং খাতের অভিভাবক বাংলাদেশ ব্যাংককে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। সরকারকে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে যে, পরবর্তীতে এ ধরনের অপকর্মের সাথে জড়িত তারা যেন কোনভাবেই শাস্তি থেকে পরিত্রান না পায় এবং ভবিষ্যতে এই ধরনের সব অপকর্মের পথ যাতে বন্ধ হয়ে যায়। ব্যাংক সমূহ একদিকে চাকরিচ্যুত করছে শত শত কর্মকর্তা এবং কর্মচারীদের, অন্যদিকে নতুন নিয়োগ বিজ্ঞপ্তী প্রকাশ করছে। তাই অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় শুধু ব্যয় সংকোচনের জন্য তাদের চাকরিচ্যুত করা হচ্ছেনা, বরং পরিচালনা বোর্ডের রোষানলের কারনে তাদের চাকরিচ্যুত করা হচ্ছে।তাই কোন কর্মকর্তা- কর্মচারী যাতে বিনা দোষে কারো রোষানলের কারনে চাকরিচ্যুত না হয় সেই বিষয়ে নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংককে সচেষ্ট থাকতে হবে-কারণ এক একজন কর্মকর্তার উপর নির্ভরশীল তাদের পরিবার।

লেখক : ডেপুটি রেজিস্ট্রার, বিজিসি ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ