ব্যর্থতা সফলতার পথ দেখায়

1

ড. মুহম্মদ মাসুম চৌধুরী

আমরা অনেক কিছু দেখি কিন্তু নিজকে দেখিনা। নিজকে দেখার আয়না আবিষ্কারই বড় কাজ। নিজকে দেখতে অন্যের দোষত্রুটি নিয়ে পড়ে থাকার সময় পাওয়া যায় না। আমার ভিতর আরেকটা আমি আছে তাকে আবিষ্কার করতে পারলে, তার ডাক শুনতে পেলে জেগে উঠা যায়। সবার আগে নিজকে বিশ্বাস করতে হবে। সবাই সফলতার উপাদান নিয়ে জন্মগ্রহণ করে কিন্তু সবাই সফল হয় না, কারণ সফলতার উপাদানের কথা আমরা বুঝি না, জানি না, তাই ব্যবহার করি না। আমার মন আছে কিন্তু মনোবল নেই। মানুষের আত্মবিশ্বাস একটি বড় শক্তি। বিশ্বাসের শক্তি দিয়ে পুরো পরিবর্তন করা সম্ভব। দুনিয়া পরিবর্তন করতে চাইলে সবার আগে নিজকে বিশ্বাস করতে হবে। তোমার শক্তি আছে, সাহস আছে, তুমি পারবে এই বিশ্বাসই তোমাকে বহু দূর দিয়ে যাবে। নিজের উপর বিশ্বাস হারানোর চেয়ে বড় ক্ষতি নেই। নিজের ক্ষতি নিজে না করলে, কেউ কারো বড় ক্ষতি করতে পারে না।
মহৎ জীবন গড়ে তুলতে চাইলে নিজের মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে। যাকে বলে আত্মদর্শন। বহু সফল ব্যক্তি নিরবে জেল জীবনে, পাহাড় পর্বতে সত্যের সন্ধান পেয়েছে। ইবসনের মতে একাকী মানুষের মত শক্তিশালী দ্বিতীয় কেউ নেই। মানুষ যখন একা নিঃস্ব হয়ে নিজের মুখোমুখি দাঁড়ায় তখন অজানা শক্তির প্রকাশ ঘটে। সে শক্তির সন্ধানে হযরত মুসা (আ.) তুর পাহাড়ে যেতেন। খানায়ে কাবার পাশেই আল্লাহর রাসুল (দ.)’র ঘর। একটু চিন্তা করুন, খানায়ে কাবায় কোরআন নাজিল হয়নি, নবুয়ত প্রকাশ খানায়ে কাবায় হয়নি, প্রথম দর্শন হযরত জিব্রাঈল (আ.)’র সাথে খানায়ে কাবায় হয়নি, খানায়ে কাবা হতে ৬ মাইল দূরে জবলে নুরের আড়াই হাজার ফুট উচ্চে হেরাগুহয় পনের বছরের (মাঝে মাঝে বিরতি দিয়ে) ধ্যানমগ্নতার মাধ্যমে কোরআন নাজিল জিব্রাঈল দর্শন, নবুয়তের প্রকাশ ঘটে। নিজের শক্তির বিকাশ ঘটাতে গৌতম বুদ্ধ অশ্বত্থ বৃক্ষের নিচে একা ছয় বছর ধ্যান করেন। নবী রাসুল, সাধক, আউলিয়া কেরামগণ পাহাড়ে পর্বতে চিল্লা করে সত্যের শক্তির সন্ধান পান। বিজ্ঞানের বড় বড় আবিষ্কারগুলো বই পড়ে নয়, শিক্ষকের শিক্ষা হতে নয়, কঠিন ধ্যানমগ্ন সাধনায় এসব আবিষ্কার করেন।
আমরা ক্লাসরুমে যা লিখি তার চেয়ে বহুগুণ বেশি শিখি ক্লাসরুমের বাইরে। জগৎখ্যাত লেখক ম্যাক্সিম গোর্কি কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করেননি, কিন্তু তিনি একটা বই লেখেছেন, আমার বিশ্ববিদ্যালয়, তিনি তার বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা তুলে ধরেছেন। যাকে বলা হয় চলমান বিশ্ববিদ্যালয়, দুনিয়াজুড়ে রয়েছে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের লক্ষ লক্ষ ছাত্র। দুনিয়ার সেরা সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো ছাত্রদের সর্বোচ্চ ২৫ভাগ (কম বেশি) শিখাতে পারে, বাকী শিক্ষা ক্লাসের বাইরে ধ্যান, কল্পনাশক্তি, জ্ঞান চর্চা ও পরিবেশ প্রকৃতি হতে শিখতে হয়। মানুষ পড়লে ২০ ভাগ (কম বেশি), শুনলে ৩০ ভাগ, শুনে লেখলে ৪০ ভাগ, দেখলে (ভ্রমণে) সর্বোচ্চ ৫০ ভাগ মনে থাকে। এসব তথ্যের জ্ঞান, সত্যের নয়। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘আমাদের শিক্ষা যেন তথ্য না দেয়, সত্যও দেয়’। বর্তমান যুগকে বলা হয় ‘ইনফরমেশন সুপার হাইওয়ে’র যুগ। তথ্যের মহাসড়কে আমরা বাস করছি। কিন্তু সত্যের সন্ধান পাচ্ছি না। সত্য জ্ঞান অর্জিত নয় সাধনায় আর ধ্যানমগ্নতায়।
মানুষ কত বড় ? প্রতিটি মানুষ তার স্বপ্নের চেয়ে অনেক বড়। কম্পিউটার হতে ১০ লক্ষগুণ শক্তিশালী মানুষের মস্তিষ্ক। একটি কম্পিউটারে দাম যদি হয় ১ লক্ষ টাকা তাহলে একজন মানুষের মস্তিষ্কের দাম হতে হাজার কোটি টাকা। প্রতিটি মানুষের (কম বেশি) ১০ হাজার কোটি টাকার সম্পদ আছে, এই তথ্যটিই পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ জানি না। ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল কালাম বলেছেন, গরিব হলে জন্ম গ্রহণ করা অপরাধ নয়, গরিব হয়ে মৃত্যু বরণ করা অপরাধ। কারণ প্রতি মানুষের ১০ হাজার কোটি টাকার সম্পদ আছে, মহান আল্লাহ পাক কাউকে দুনিয়াতে গরিব করে পাঠায়নি। মানুষ পরাজিত হবার নয়। মানুষ জয়ী হয় নিজের কাছে, পরাজিত হয় নিজের কাজে। মানুষের জন্ম হয়েছে বিজয়ের জন্য, ব্যর্থ হবার জন্য নয়।
আল্লামা ইকবালের খুদী দর্শনের মূল কথা হলো, ‘মানুষ অপরিমেয়-অভাবনীয় শক্তির অধিকারী। যদি প্রবৃত্তি তাড়িত নফসের কারাগার হতে মানুষ মুক্ত হতে পারে তখন মানুষের অপরাজেয় শক্তির আবির্ভাব ঘটাতে পারে। যে শক্তি পারমানবিক বোমার চেয়ে বড় শক্তিতে পরিণত হয়’। তিনি বলেছেন, খুদীকো কর বুলন্দ ইতনাকে হর তকদীর সে পাহলে / খোদা বন্দসে খোদ পুছে বাতা ত্যারী রিয়া কিয়্যা হ্যায়’। অর্থাৎ ব্যক্তিত্বকে এমন উঁচু নিয়ে যাও যেন ভাগ্য নির্ধারণের পূর্বে স্বয়ং মহান আল্লাহ জানতে চান, বান্দা বল তুমি কী চাও ?
মানুষের শক্তির পূর্ণ বিকাশ হলে তখন ড. আল্লামা ইকবালের মত বলতে পারবে, ‘মাহবুবে কী উম্মাত হ্যায়, হাম হাম আরশ হেলা দেঙে’। আমরা মাহবুবে খোদা প্রিয় নবী (দ.)’র উম্মাত। আমরা খোদার আরশকে হেনিয়ে দিতে পারি’। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন, ‘ভূলোক দ্যুলোক গোলোক ভেদিয়া, খোদার ‘আরশ’ ছেদিয়া, উঠিয়াছি চির-বিষ্ময় আমি বিশ্ববিধাত্রীর’। কবি এখানে আল্লাহ পাকের অবস্থান আরশে আজিমের কথা বলেননি, বলেছেন, আল্লাহ প্রদত্ত শক্তির বিকাশের কথা।
মহামনীষীরা বলেগেছেন, ‘আগে নিজকে জান, তারপর অন্যকে জানাও। নিজকে জানা মানে, নিজের শক্তিকে জানা। নিজের শক্তিকে জানলে মানুষ ফিরে পায় আত্মবিশ্বাস। আত্মবিশ্বাসের নবজাগরণ ঘটে। নবজাগরণের নাম নবচেতনা। ফলে মানুষের পরিবর্তন ঘটে। যেভাবে পরিবর্তন হয়ে ডাকাত রতœকর মহাকবি বাল্মীকিতে পরিণত হয়ে উঠে, নিরক্ষর কালিদাস হয়ে উঠেন জগত সেরা কবিতে। ভাগ্যের উপর নির্ভর করে আপনি ধনী হবেন এই বিশ্বাস আপনাকে ধনী করবে না। লটারীর টাকায় কোটিপতি হবেন এ আশা নিজের শক্তি নষ্ট করে। অমিতাভ বচ্চন কৌন বনেগা ক্রোড়পতি, অনুষ্ঠানের মাধ্যমে অনেক মানুষকে কোটিপতি করেছেন, কিন্তু তিনি নিজেই কোটিপতি হয়েছেন ইচ্ছা শক্তি, আত্মবিশ্বাস ও সাধনার জোরে।
মানুষের জীবনের কোন গ্রামার নেই, প্রচুর লোক মেধাবী হয়ে সফল হতে পারেনি। অনেক মানুষ কম মেধাবী হয়ে সমাজের জন্য মহৎ কাজ করেন। প্রচুর ধর্নাঢ্য লোকের ছেলে মানুষ হতে দেখিনি, আবার অভাবের সাথে যুদ্ধ করে বিশাল বিজয় ছিনিয়ে আনতে দেখি। বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা ছিলেন গরিব মুদির দোকানীর ছেলে, উইলিয়াম কেরী ও টমাস আলভা এডিসন ছিলেন শিশু শ্রমিক। তাদের আত্মবিশ্বাস ও লড়াকু মনই তাদের সফলতার চূড়ায় নিয়ে যায়।
মানুষ টাকা হারালে গরিব হয় না, সাহস আর আত্মবিশ্বাস হারালে গরিব হয়। প্রচুর মানুষ ব্যর্থতারে নিকট আত্মসমর্পন করে হারিয়ে যায়, অনেক মানুষ শত বার ব্যর্থ হওয়ার পরও ঘুরে দাঁড়ায়। প্রত্যেক ব্যর্থতাই সাফল্যের পথ দেখায়। যে জীবনের ব্যর্থ হয়নি সে জীবনে কোন কাজ করেনি। টমাস আলভা এডিসনের নিকট এক সাংবাদিক জানতে চান, আপনার দশ হাজার গবেষণা নাকি ভুল হয়েছে ? তিনি জানালেন আমি দশ হাজার বার ভুল বা ব্যর্থ হয়নি, আমি দশ হাজার বার পরীক্ষা করে দেখেছি কাজটি এভাবে হয় না, অন্যভাবে হয়। আমার ভুলগুলো আমাকে সঠিক আবিষ্কারের পথ দেখিয়েছে। তাতে আমি সফল হয়েছি। আমি আমার ব্যর্থ গবেষণাগুলো না করলে আমার আবিষ্কারগুলো করা সম্ভব হতো না। মানুষের ব্যর্থতাগুলো সাফল্যের পথে নিয়ে যায়।
জগৎখ্যাত মানুষের জীবনেও ব্যর্থতা আসে, অমিতাভ বচ্চন ব্যবসা করতে গিয়ে সব সম্পদ হারিয়ে ফেলেন। পাওনাদাররা তাঁর সমস্ত সম্পত্তি ক্রোক করে নিয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত তিনি ব্যর্থ হননি। উত্থান পতনের মাধ্যমে জীবন পথে হাটতে হয়। কোন সফল মানুষের জীবন সরল পথে চলেনি। আত্মবিশ্বাস অসম্ভবকে সম্ভব করে। আত্মবিশ্বাস না থাকলে অনেক কাজ করা সম্ভব হয় না। যে কাজ সম্ভব হবে না সে কাজ শুরু করতে নেই। লেনিন বলেছেন, যে যুদ্ধে তোমার জয়ী হওয়ার সামর্থ্য নেই, সে যুদ্ধ শুরু করার তোমার অধিকার নেই’। সে যুদ্ধ শুরু করা মানে নিজের শক্তি ক্ষয় করা। শক্তি ক্ষয়ে জয় নেই।
বেন ফেন্ডমান বলেছেন, একজন মানুষের চিন্তা যত বড়, সে মানুষ হিসেবে তত বড়’। মানুষের ক্ষমতার সীমারেখা নেই কিন্তু আত্মবিশ্বাসের কারণে মানুষের শক্তি মানুষ ব্যবহার করতে ব্যর্থ হয়।

লেখক : কলাম লেখক, রাজনীতিক