নিজস্ব প্রতিবেদক
কৃষকদের কাছ থেকে বোরো ধান সংগ্রহে এবারও ব্যর্থ হয়েছে খাদ্য অধিদপ্তর। নির্ধারিত সময়ে লক্ষ্যমাত্রার ৬০ শতাংশ ধান সংগ্রহ হয়েছে। বোয়ালখালী ও হাটহাজারী উপজেলা ছাড়া অন্য কোথাও ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি। ধান সরবরাহে অনাগ্রহের পেছনে হয়রানিকেই দুষছেন কৃষকরা। এছাড়াও অভ্যন্তরীণ খাদ্য শস্য সংগ্রহের নীতিমালার নামে জুড়ে দেয়া ১৭টি শর্ত মানতে গিয়েই কৃষকরা হয়রানির শিকার হন বলে অভিযোগ উঠেছে। খাদ্য গুদামে ধান সরবরাহ করতে গিয়ে এসব শর্তের গ্যাড়াকলে পড়ে কৃষকরা গুদাম ফেরত হওয়ার কারণেই সরকারের এমন উদ্যোগ ভাটা পড়েছে। যে কারণে প্রায় টানা কয়েক বছর ধরে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যর্থ হচ্ছে খাদ্য অধিদপ্তর। কৃষক অ্যাপসের মাধ্যমে ধান সংগ্রহের ডিজিটাল পদ্ধতিতেও সুফল মিলেনি।
চট্টগ্রাম জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক সুমাইয়া নাজনীন পূর্বদেশকে বলেন, ‘গত ৩১ আগস্ট পর্যন্ত আমাদের বোরো সংগ্রহের সময় ছিল। এরমধ্যে আমাদের পুরোপুরি বোরো লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি। সবমিলিয়ে ৯০ শতাংশের মতো লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়েছে।’
খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় সূত্র জানায়, খাদ্য মন্ত্রণালয় ধান-চাল সংগ্রহের ঘোষণা দেয় গত ২১ এপ্রিল। চট্টগ্রামে চলতি বোরো মৌসুমে ১২ হাজার ৬৩১ টন ধান-চাল কেনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। যার মধ্যে ধান ছয় হাজার ৫৮ টন, সিদ্ধ চাল ৬৭০ টন ও আতপ চাল পাঁচ হাজার ৯০৩ টন। প্রতি কেজি বোরো ধানের সংগ্রহ মূল্য নির্ধারণ করা হয় ৩২ টাকা, সিদ্ধ চাল ৪৫ টাকা এবং আতপ চাল ৪৪ টাকা। গত ৭ মে শুরু হওয়া এই অভিযান গত ৩১ আগস্ট পর্যন্ত চলে। কিন্তু নির্ধারিত সময় পেরিয়ে আতপ চাল সংগ্রহে লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হলেও সিদ্ধ চাল ও ধান সংগ্রহে সফলতা মিলেনি। ধান তিন হাজার ৬৫৯ দশমিক ১২০ মেট্টিক টন, সিদ্ধ চাল ৪৫৪ দশমিক ১০০ মেট্টিক টন, আতপ চাল সংগ্রহ ১১ হাজার ৮ দশমিক ৫০০ মেট্টিক টন সংগ্রহ হয়েছে।
২০২৪ সালে বোরো ধান সংগ্রহে চট্টগ্রামের ১৩টি উপজেলা ও নগরীর একটি থানায় ছয় হাজার ৫৮টন ধান সংগ্রহের টার্গেট করা হলেও ৯টি উপজেলা থেকে বোরো ধান সংগ্রহ করা হয়েছে তিন হাজার ৬৫৯ দশমিক ১২০ টন। এরমধ্যে ফটিকছড়িতে ৫৫৭ দশমিক ৬৮০ টন, হাটহাজারীতে ৬৪৭ দশমিক ৭২০টন, রাউজানে ২৭৪ দশমিক ৬০০ টন, রাঙ্গুনিয়ায় ৮৩৫ টন, পটিয়ায় ১৫৯ দশমিক ৮৪০ টন, লোহাগাড়ায় ৪০ দশমিক ২০০ টন, বাঁশখালীতে ৮৪৯ দশমিক ৫৬০ টন, আনোয়ারায় ৪৮টন, বোয়ালখালীতে ২৪৬ দশমিক ৫২০ টন ধান সংগ্রহ হয়েছে। যা লক্ষ্যমাত্রার ৬০ শতাংশ।
চট্টগ্রাম আতপ চালের জন্য প্রসিদ্ধ। যে কারণে এই চাল সংগ্রহে পাঁচ হাজার ৯০৩ টন লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও তার প্রায় দ্বিগুণ সংগ্রহ হয়েছে। এরমধ্যে মিরসরাইয়ে ১৭২টন, ফটিকছড়িতে ৬৬৮ দশমিক ৫০০টন, হাটহাজারীতে ৩৩৩টন, রাউজানে ৩৮৮টন, রাঙ্গুনিয়ায় দুই হাজার ৪৭৬টন, পটিয়ায় ৬৯৫টন, চন্দনাইশে ১১৩টন, সাতকানিয়ায় ৪০৫টন, লোহাগাড়ায় ১৫৮টন, বাঁশখালীতে এক হাজার ৯৪টন, আনোয়ারায় ৭১৬টন, মহানগরে তিন হাজার ৭৯০টন মিলিয়ে ১১ হাজার ৮ দশমিক ৫০০ টন আতপ চাল সংগ্রহ করা হয়েছে। সিদ্ধ চাল সংগ্রহ হয়েছে লক্ষ্যমাত্রার ৬৭ শতাংশ। ৬৭০টন লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে ফটিকছড়িতে ৩৩০ দশমিক ১০টন, পটিয়ায় ১২৪টন সিদ্ধ চাল সংগ্রহ হয়েছে।
কৃষক ও মিলারদের সাথে কথা বলে জানা যায়, চাল কেনার জন্য ১২টি ও ধান কেনার জন্য পাঁচটি শর্ত জুড়ে দিয়েছে খাদ্য মন্ত্রণালয়। এই শর্তের গ্যাড়াকলেই মূলত কৃষকরা ধান বিক্রিতে আগ্রহী হয় না। কয়েকটি উপজেলায় পাইলট প্রকল্প হিসেবে মিলার ও কৃষক অ্যাপসের মাধ্যমে ধান-চাল সংগ্রহের কথা বলা হলেও তাতেও তেমন সফলতা মিলেনি।
সংগ্রহ অভিযানের নিয়ম অনুযায়ী, ফসল ওঠার পর গ্রামের কৃষকদের উপজেলা খাদ্য গুদামে গিয়ে ধান দিয়ে আসতে হয়। পাঁচটি শর্ত মেনেই এই ধান বিক্রি করতে হয়। এরমধ্যে বড় সংকট তৈরি হয় আদ্রতা নিয়ে। ধান সরবরাহকালে আদ্রতা থাকতে হয় ১৪ শতাংশ। নির্ধারিত আদ্রতার বেশি হলে ধান ফেরত দেওয়া হয়। তখন গাড়ি ভাড়া করে গুদাম থেকে ধান বাড়িতে ফেরত নিতে হয়। এই জটিলতার কারণেও কৃষকরা সরকারকে ধান দিতে আগ্রহী হন না। এই জটিলতা দূর করতে এজেন্টের মাধ্যমে বা গ্রামীণ বাজারে বিক্রয়কেন্দ্র তৈরি করে যখন সরকার কৃষকের ধান কিনবে, তখন বাজারে প্রতিযোগিতার পরিবেশ তৈরি হবে।
চট্টগ্রাম কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ আবদুচ ছোবহান পূর্বদেশকে বলেন, ‘বোরো ধান সংগ্রহের যে লক্ষ্যমাত্রা ছিল তাতে কত সংগ্রহ হয়েছি বিষয়টি এখনো আমার কাছে আসে নাই। এই তথ্য পাওয়ার পর যদি লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হয় তাহলে আমি আমাদের উপজেলা কৃষি অফিসারদের সাথে কথা বলবো। কৃষকরা তাদেরকে ধান-চাল বিক্রি না করার কারণগুলো তখনই বের করা যাবে।’