ব্যবসায়ী-বান্ধব আর্থিক নীতিই শ্রেয়

9

নাসিরুদ্দিন চৌধুরী

সরকার আসে সরকার যায়। এটা রাজনীতির শাশ্বত প্রথা। রাজনৈতিক পালাবদলের এই চিরায়ত ধারায় আমাদের দেশে কখনো আওয়ামী লীগ কখনো বিএনপি শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হচ্ছে। শুধু একবার ১৯৮২ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত এরশাদ ক্ষমতাসীন থাকাকালে তিনি জাতীয় পার্টি নামে যে নতুন দল গঠন করেছিলেন, সেটি সেসময় দেশ শাসন করেছে। নব্বই থেকে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির জমানায় রাজনৈতিক দলের ওপর দমন-পীড়ন ও রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের ওপর ধরপাকড় হতে দেখা গেছে। পাকিস্তান আমলেও ১৯৫৮ সালে প্রথম মার্শাল ল হওয়ার পর রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ ও রাজনৈতিক দলের অফিসে তালা ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছিলো। রাজনৈতিক নেতাদের জন্য রাজনীতি ৫ বছর নিষিদ্ধ এবং অনেক নেতাকে নির্বাচনে অংশগ্রহণের অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছিলো। সেজন্য EBDO (Elective BodiesDisqualification Ordinance) এবংPODO (Public Office Disqualification Ordinance) নামে দুটি আইন করা হয়েছিলো। কিন্তু কোন সময় ব্যবসায়ীদের নিয়ে টানা হ্যাঁচরার কোন ঘটনা ঘটতে তেমন দেখা যায়নি। শুধু আইয়ুব খান ইস্কান্দর মির্জার হাত থেকে ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে পাকিস্তানের সর্বেসর্বা হওয়ার পর চোরাকারবার ও মজুদদারিতে লিপ্ত কোন কোন ব্যবসায়ির ব্যবস্থা গ্রহণের ঘোষণা দিয়েও পরে আর তেমন কিছু করেননি। তারপর আইয়ুব খান বরং ব্যবসায়িদের সাহায্য করার জন্য ও জি এল (ওপেন জেনারেল লাইসেন্স) নামে একটি ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছিলেন। এই ব্যবস্থায় পূর্ব পাকিস্তানে কিছু বাঙালি ব্যবসায়ীদের হাতে পুঁজি সঞ্চিত হয়েছিলো এবং তাদের মধ্যে থেকে শিল্পপতির আবির্ভাব হতেও আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। স্বাধীনতার পর, যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ, অর্থনৈতিক অবস্থা নাজুক-এমনি সংকটময় পরিস্থিতিতেও বঙ্গবন্ধু দেশের ব্যবসায়িদের স্বার্থ ক্ষুণœ করতে পারে, এমন কোন অর্থনৈতিক নীতি বা পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি। অবাঙালিদের ফেলে যাওয়া শিল্প-কারখানা জাতীয়করণ করলেও পরে বাঙালিদের শিল্প-কারখানা ফেরত দিয়েছেন। ইস্পাহানি, বিএসআরএম-এর মত অবাঙালিদের মিল-কারখানাও সম্ভবত ফেরত দিয়েছিলেন। এ কে খান তাঁর জাতীয়করণকৃত মিল ফেরত পেয়েছেন, একথা তাঁর ছেলের মুখে শুনেছি।
বঙ্গবন্ধু শুধু তাঁর দলের দু’জন বা তিনজন এমপিকে বহিষ্কার করে তাদের দুর্বৃত্তপনার শাস্তি দিয়েছিলেন। কিন্তু সাধারণভাবে ব্যবসায়ীদের স্বার্থবিরোধী কোনো অর্থনৈতিক বা বাণিজ্য নীতি অবলম্বন করেননি। কিন্তু ৯০-এর দশকের পর থেকে ব্যবসায়ীদের যেভাবে হয়রানি করা হচ্ছে, অতীতে তার কোন দৃষ্টান্ত খুঁজে পাওয়া যায় না। ২০০৮ সালে বিএনপিকে পরাজিত করে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর কিছু ব্যবসায়ির বিরুদ্ধে মামলা রুজু করে তাদেরকে গ্রেফতার করা হয় এবং সাজাও দেয়া হয়। উদাহরণ হিসেবে মোর্শেদ খান, আবদুল আউয়াল মিন্টু, গিয়াসুদ্দিন আল মামুন, মোসাদ্দেক হোসেন ফালু, চট্টগ্রামের আসলাম চৌধুরী প্রমুখের নাম উল্লেখ করা যায়। অবশ্য মিন্টুকে গ্রেফতার করা হয়নি। এবার ২০২৪ সালে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতাচ্যুত করে বিএনপির সমর্থনপুষ্ট অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হওয়ার পর দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী বসুন্ধরা, বেক্সিমকো, এস আলম, সাবেক অর্থ মন্ত্রী লোটাস কামাল বা আ হ ম মোস্তফা কামাল, সাবেক ভ‚মি মন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাভেদ, হাজি সেলিম প্রভৃতি ব্যবসায়ীকে হয়রানি করা হচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, শেয়ার বাজার কেলেংকারি, ব্যাংক ঋণ নিয়ে নয়ছয়, বিদেশে অর্থপাচার, অর্থ আত্মসাৎ, দখল ইত্যাদি নানা অভিযোগের তদন্ত করা হচ্ছে। তারা কেউ আটক হয়েছেন, কেউ বিদেশে ফেরার।
বর্তমান সরকারে অর্থনীতিবিদ ড. ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ (শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে), ড. সালেহ উদ্দিন আহমদ বিভিন্ন দায়িত্বে নিয়োজিত আছেন। ড. হাসান এইচ মনসুর বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্ণরের দায়িত্ব পালন করছেন। তাদের মুখে আমরা বিভিন্ন সেমিনার, সিম্পোজিয়ামে এমন বক্তব্য প্রদান করতে শুনেছি যে, ব্যক্তিখাত হচ্ছে অর্থনীতির চালিকা শক্তি। শক্তিশালী বেসরকার খাতের কারণেই বাংলাদেশের অর্থনীতি বর্তমানে গতিশীল এবং ইমার্জিং টাইগার হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসও একজন অর্থনীতিবিদ। সুতরাং এতজন অর্থনীতিবিদ যে সরকারের নীতিমালা প্রণয়ন ও নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে জড়িত রয়েছেন, তারা নিশ্চয়ই আমাদের চেয়ে ভালো বোঝেন যে ব্যবসায়ীদের স্বাভাবিক নিয়মে ব্যবসা করার সুযোগ না দিলে অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়তে পারে।
সালমান রহমান খানদানি ব্যবসায়ী এবং তাঁর পরিবার ঢাকার দোহারের পুরোনো জমিদার। তাঁর পিতা ফজলুর রহমান পাকিস্তানে প্রথম দিকে মন্ত্রী ছিলেন। তিনি সম্ভবত অবিভক্ত বাঙলার আইন পরিষদেরও একজন সদস্য এবং মুসলিম লীগের বড় নেতা ছিলেন। সাবেক মন্ত্রী ও বিএনপি নেতা নাজমুল হুদা ছিলেন সালমানের ভ্রাতুষ্পুত্র। সালমান রহমানের পৈত্রিক বাসভবন ছিলো ধানমন্ডিতে। বঙ্গবন্ধুর বাসভবনও ছিলো ধানমÐিতে। পাড়ার সমবয়সী ছেলেদের মধ্যে খেলাধূলা, আড্ডা ইত্যাদির মাধ্যমে যেমনি বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে, তেমনিসালমান এবং শেখ কামালও বন্ধু হয়ে যান। স্বাধীনতার পর শেখ কামাল যখন আবাহনী ক্লাব করার উদ্যোগ নেন, তখন সালমান রহমান তাঁর সঙ্গে এই উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। শেখ কামালের সঙ্গে বন্ধুত্বের সূত্রেই সালমান রহমান আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত হন। স্বাধীনতার পর সালমান এফ রহমান ও তাঁর বড় ভাই সোহেল এফ রহমান বেক্সিমকো প্রতিষ্ঠা করে ব্যবসায় আরম্ভ করেছিলেন।তাদের পরিবার আগে পাটের ব্যবসায় নিয়োজিত ছিল। সত্তরের দশকের গোড়ার দিকে পাট কারখানা জাতীয়করণ করা হয়। ১৯৭০ এবং ১৯৮০ এর দশকের শেষের দিকে মুক্ত বাজার সংস্কারের মাধ্যমে পরিবারটি তাদের অনেক ব্যবসা পুনরুদ্ধার করে।
বসুন্ধরাকে আমাদের দেশের ব্যবসায়ীদের মধ্যে শীর্ষস্থানে গণ্য করা হয়। বসুন্ধরার কত রকম ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-কারখানা তা পরিমাপ করা মুশকিল। বসুন্ধরার তৈরি ‘বসুন্ধরা সিটি’ দেশের একটি বৃহৎ মর্যাদাপূর্ণ অত্যাধুনিক বিপণি। আবাসন সেক্টরে বসুন্ধরার প্রতিদ্বন্দ্বী কেউ নেই। টিসু পেপার, সিমেন্ট শিল্পেও তারা অগ্রগণ্য। প্রিন্ট মিডিয়ায় কালের কণ্ঠ ও বাংলাদেশ প্রতিদিন-দুটি বাংলা দৈনিক এবং ইংরেজি দৈনিক দি সান ও অনলাইন নিউজ পেপার বাংলা নিউজ, ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় নিউজ ২৪ ও টি স্পোর্টস নামীয় দুটি চ্যানেলের মালিক বেক্সিমকোকে অনায়াসে বাংলাদেশের ‘মিডিয়া মোগল’ বলা যায়। বসুন্ধরা গ্রæপের জনপ্রিয় ও সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিনে আমার কাজ করার সৌভাগ্য হয়েছিলো। বাংলাদেশে মিডিয়ায় প্রথম কর্পোরেট সংস্কৃতি আমদানি করে বসুন্ধরা। তাদের পত্রিকায় কাজ করতে গিয়ে আমি বসুন্ধরা গ্রুপের মাননীয় চেয়ারম্যান আহমদ আকবর সোবহান ওরফে শাহআলম সাহেবের ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুযোগ পেয়েছিলাম। তখনই নাতিদীর্ঘ সুস্বাস্থ্যের অধিকারী ধীর স্থির শান্ত সৌম্য দর্শন সুন্দর মানুষটির মধ্যে যে সজীব জীবনবোধ, দূরদর্শিতা, প্রাণবন্ত আধুনিকতার ছোঁয়া দেখেছিলাম তাঁর বসুন্ধরার বাসভবনের তিনটি বৈঠকে, তা আজো আমাকে অনুপ্রাণিত করে। ইলন মাস্ক, জেফ বেজোজ, বিল গেটস এবং মুকেশ আম্বানিদের বিস্তীর্ণ পরিসরে নান্দনিক শৈলীতে স্থাপিত প্রাসাদোপম অট্টালিকার ঐশ্বর্য ও কীর্তি নিয়ে ইউটিউব ও অনলাইনে কত আলোচনা, কিন্তু শাহ আলম সাহেব তাঁর স্বকীয় উদ্ভাবনী চিন্তা দিয়ে বিশাল ফুটবল মাঠের ন্যায় একটি দিগন্ত বিস্তৃত মাঠের এক প্রান্তে নিজের পরিবার নিয়ে বসবাসের জন্য যে ভিলা তৈরি করেছেন, তার মধ্যেও অপূর্ব স্থাপত্য ও সৌন্দর্য চিন্তার উদ্ভাস লক্ষ্য করা যায়। তাঁর ছেলে সায়েম সোবহান আনভীর আমি দেখিনি, কিন্তু বসুন্ধরার ব্যবস্থাপনা পরিচালক হয়ে তিনি যেভাবে বাংলাদেশের এই বিজনেস GKRbIndustrial giant কে আরো বিস্তৃত করে উচ্চতার শিখরেনিয়ে যাচ্ছেন, তাতে ভারতের মিত্তাল গ্রুপ, আম্বানি রিলায়েন্স গ্রুপ, রতন টাটার পরিচালিত টাটা গ্রুপ, আদিত্য বিড়লা পরিচালিত বিড়লা গ্রুপ, কিংবা লন্ডনের হিন্দুজা গ্রুপ, আমেরিকার মাইক্রোসফট, আমাজন, টেসলার মত বিশ্ববিখ্যাত প্রতিষ্ঠানই হয়ে যাবে।
পিতার সমস্ত গুণ তাঁর ওপর আরোপিত হয়েছে, তদুপরি তাঁর নিজের প্রতিভা, অন্তর্নিহিত গুণ, দক্ষতার মিশ্রণে সায়েম সোবহান আনভীর যে বাংলাদেশের শিল্প সাম্রাজ্যের একেশ্বর হয়ে যাবেন- এতে কোন সন্দেহ নেই। বসুন্ধরা আনভীরের নেতৃত্বে বর্তমানে যে গলফ্ কোর্সটি তৈরি করছে, দূরদর্শিতা ও মৌলিক চিন্তার অধিকারী না হলে কোনো একজন শিল্পপতির পক্ষে এত মনোরম গলফ কোর্স গড়ে তোলা সম্ভব নয়। আমার কোনো সন্দেহ নেই যে, বাংলাদেশ একজনওহফঁংঃৎরধষ মরধহঃ পেয়ে গেছে, ক্রমশ যার ঔজ্জ্বল্যও ঠিকরে ঠিকরে বের হবে।
এস আলম প্রসঙ্গই এখন আলোচিত হচ্ছে বেশি। এসএম আলমের বাড়ি চট্টগ্রামের পটিয়া থানায়। সাইফুল আলম মাসুদ-তাঁর তিন শব্দের নাম থেকে প্রথম দুটি শব্দ নিয়ে এস আলম নামকরণ। তাঁর পিতা মোজাহের সাহেব বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তা, সেই সূত্রেই হয়তো ব্যাংকের প্রতি এস আলমের এত দুর্বলতা। তাঁর তিন মামার দুই মামা-বশিরুজ্জামান চৌধুরী ও আখতারুজ্জামান চৌধুরী ছিলেন শিল্পপতি। ছোট মামা বশরুজ্জামান চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধ করতে গিয়ে শহীদ হন। আখতারুজ্জামান চৌধুরী চিটাগাং চেম্বার ও এফবিসিসিআইর সভাপতি ছিলেন তিনি ইউসিবিএল ও জনতা ইন্সুরেন্স উদ্যোক্তা ও সাবেক চেয়ারম্যান। আখতারুজ্জামান বাবু দেশের একজন নেতৃস্থানীয় শিল্পপতি ও আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ছিলেন।
এস আলম অঢেল ধন সম্পদের মালিক, ডজন ডজন শিল্প-কারখানার মালিক তিনি; পশ্চিম পটিয়ার মইজ্যার টেকে এস আলম নামের কত শিল্প আছে তা গুণে শেষ করা যায় না। সে এলাকার নাম এস আলম শিল্পনগর রাখলেই বোধ হয় সঙ্গত হত।
সাইফুল আলম মাসুদ এলাকার হাজার হাজার দরিদ্র, গরীব-দুঃখী ঠিকানা-বিহীন মানুষকে নিজস্ব তহবিল থেকে পাকাঘর নির্মাণ করে দিয়েছেন। পবিত্র হজ্ব করিয়েছেন। অসহায় লোকদের ছেলে-মেয়েদের বিয়ে ও চিকিৎসার খরচসমূহ ছাড়াও বিভিন্ন শিক্ষা, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে কোটি কোটি টাকা আর্থিকভাবে সহায়তা দিয়ে মানবসেবার অনন্য নজির স্থাপন করেছেন। শিক্ষার আলো জ্বালানোর জন্য ‘এস আলম কলেজিয়েট স্কুল এন্ড কলেজ’ নামে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। আগামীদিনে পটিয়ায় একটি মানসম্মত মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা করার পরিকল্পনা রয়েছে তাঁর। তবে এত যাঁর ধনসম্পত্তি বিত্তবৈভব, তাঁর চালচলন, কথাবার্তায় তাঁর বিন্দুমাত্র প্রমাণ মেলে না। শিল্পপতি হিসেবে এস আলমের উত্থান ঢাকডোল পিটিয়ে হয় নি। খুব ধীরে, প্রায় নিঃশব্দে তিনি অর্থের ভুবনে বিচরণ শুরু করেন যে, তাঁর পদচারণা থেকে প্রায় কোন শব্দই উৎপন্ন হয়নি। তাঁর মনে কোন অহংকার নেই।
বর্তমানে এস আলম শিল্পগোষ্ঠীর অধীনে ৩৭টি ইউনিট আছে। এসব ইউনিটের নাম এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে- শিল্পখাত-এস আলম স্টীল, এস আলম ভেজিটেবল, এস আলম সয়াসিড এক্সট্র্যাকশন প্ল্যান্ট লি., এস আলম সুপার এডবিন অয়েল লি., এস আলম রিফাইন্ড চিনি শিল্প লি., এস আলম রিফাইন্ড সুগার ইন্ডাস্ট্রিজ লি. (ইউনিট-২), এস আলম ট্যাঙ্ক টার্মিনাল লি., এস আলম সিমেন্ট লি., পোর্টম্যান সিমেন্টস লি.,এস আলম স্টিলস লি., এস আলম কোল্ড রোল্ড স্টিলস লি., এস আলম কোল্ড রোল্ড স্টিলস লি. (এনওএফ), গ্যালকো স্টিল (বিডি) লি., গ্যালকো স্টিল (বিডি) লি. (ইউনিট-২), কর্ণফুলী প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানি লি., শাহ আমানত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানি লি., এস আলম পাওয়ার প্লান্ট লি., এস আলম পাওয়ার প্লান্ট লি. (ইউনিট-২), এস আলম পাওয়ার জেনারেশন লি., এস আলম লাক্সারি চেয়ার কোচ সার্ভিসেস লি., বেরিং সি লাইন, এস আলম ব্যাগ ম্যানুফ্যাকচারিং মিলস লি., এস আলম প্রোপার্টি লি., হাসান আব্বাস (প্রা.) লি., মডার্ন প্রোপার্টিজ লি., ওশেন রিসর্টস লি., প্রসাদ প্যারাডাইজ লি., মেরিন এম্পায়ার লি., এস আলম হ্যাচারি লি., ফতেহাবাদ ফার্ম লি., এস আলম ব্রাদার্স লি., এস আলম ট্রেডিং কোং (প্রা.) লিমিটেড, এস আলম অ্যান্ড কোম্পানি, সোনালী কার্গো লজিস্টিক্স (প্রা.) লি., সোনালী ট্রেডার্স, গ্লোবাল ট্রেডিং কোম্পানি লি. ও এস আলম পাওয়ার ওয়ান লি.।
এস আলম ৭টি ব্যাংকের মালিক বা বৃহৎ শেয়ারের মালিক। এই ব্যাংকগুলি হলো : ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক, ইসলামি ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক। ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় এস আলমের দু’টি টিভি চ্যানেল অন এয়ারে রয়েছে, এই দুটি চ্যানেল হলো- একুশে টেলিভিশন ও নেক্সাস। এস আলম একটি মেগা প্রজেক্ট হাতে নিয়েছে। সেটি হলো- ২০ হাজার কোটি টাকার টাকার বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রকল্প। বেসরকারি পর্যায়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন খাতে এটিই দেশের সবচেয়ে বড় বিনিয়োগ।
গণপরিবহনের ক্ষেত্রেও এস আলম বিপ্লব সাধন করেছে। শত শত এস আলম বাস কোচ দেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণির যাতায়াতের সেবায় নিয়োজিত রয়েছে। সারাদেশে সড়ক, মহাসড়ক ধরে ছুটছে এস আলম বাস। সব যে তাঁর তা নয়। কিন্তু এস আলম নাম এমন পয়মন্ত যে সে নামের জন্য অনেক বাস ব্যবসায়ী নিজ নিজ বাস এস আলম বাসের বহরে অন্তর্ভুক্ত করে স্বস্তি বোধ করেন। দেশের ব্যাংকিং জগতকে সমৃদ্ধ করা ছাড়াও পটিয়ার হাজার হাজার বেকার যুবক, ছাত্র, শিক্ষিত মানুষ চাকরি পেয়েছেন এস আলম গ্রুপের ব্যাংক ও শিল্প প্রতিষ্ঠানে। কোন একক ব্যক্তি বা একক প্রতিষ্ঠান কর্তৃক এত বেশি মানুষের কর্মসংস্থানের নজির আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। হিসেব করলে হয়তো দেখা যাবে, সমগ্র পটিয়ায় সরকারের চাইতেও বেসরকারী খাত অর্থাৎ এস আলম গ্রুপের কর্মচারীর সংখ্যাই বেশি হবে।
এস আলমের বিরুদ্ধে দুদকের তদন্ত, ব্যাংক হিসাব জব্দ এবং ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ থেকে তাঁকে ও তাঁর মনোনিত ব্যক্তিকে বাদ দেয়া, ব্যাংক থেকে তাঁর লোকজনকে বের করে দেয়ার ঘটনায় মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। কেউ খুশি, কেউ বেজার। যতজন খুশি, তার চেয়ে অনেকগুণ বেশি অসন্তুষ্ট, ক্ষুব্ধ। কারণ এস আলম পটিয়া তথা চট্টগ্রামের হাজার হাজার মানুষকে চাকরি দিয়েছেন, সংখ্যাটা নাকি বিশ হাজারের কম হবে না-এমন কথা আমি শুনেছি। এস আলম লোন নিয়ে শিল্প-কারখানা গড়ে তুলেছেন। তাঁর ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-কারখানা চালু থাকলে, ঋণ পরিশোধ করা কোন সমস্যা নয়। এখন সরকার যেভাবে তাঁর ব্যবসা-বাণিজ্যে হস্তক্ষেপ করছেন, লোন, ব্যাংক হিসাব জব্দ করছেন, তাতে তাঁর ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-কারখানা তো বন্ধই হয়ে যাবে। তাতে কী লাভ হবে ? তাঁর যে বিশাল লোনের কথা বলা হচ্ছে সেটা তো কোনদিনই পরিশোধ হবে না। তাঁর ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-কারখানা চালু এবং ব্যাংকে ট্রানজেকশন থাকলে তাঁর আয় হবে এবং লোন রিফান্ড হবে।

শেষ কথা : যাঁরা প্রকৃত ব্যবসায়ী, তাঁরা কখনো রাজনীতির পথে হাঁটেন না। তাদের ব্যবসা-বাণিজ্যের কিসে উন্নতি হবে, সে চিন্তাতেই তাঁরা ব্যাপৃত থাকেন। সে কারণে ব্যবসায়ীরা সরকারঘেঁষা হন। কারণ ব্যবসা-বাণিজ্যের নীতি নির্ধারণ করেন সরকার। জিয়াউর রহমান, জাস্টিস সাত্তার, বেগম জিয়া এবং এরশাদের আমলে প্রায় সব ব্যবসায়ী বিএনপি অথবা জাতীয় পার্টি করেছেন। আওয়ামী লীগে সবেধন নীলমণি একজনই বড় ব্যবসায়ী-আখতারুজ্জামান বাবু। নব্বইয়ের পর থেকে ব্যবসায়ীরাও মনে হয় চালাক হয়ে গিয়েছিলেন, তারা রাজনৈতিক দলে ভিড়ে সংসদ সদস্য এবং মন্ত্রীও হচ্ছিলেন। তারা এক সময় মোটা অংকের চাঁদা দিয়ে নেতানেত্রীদের আস্থাভাজন হওয়ার চেষ্টা করতেন। কিন্তু নব্বইয়ের পরে তাদের নিজেদের মধ্যেই নেতা হয়ে গোটা দল বা রাজনীতিকে ডিকটেট করার দুর্বুদ্ধি হয়েছিলো। রাজনীতি তারা কতটুকু গলাধকরণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন জানি না, কিন্তু রাজনীতি যে তাদেরকে খানিকটা ভক্ষণ করেছিলো তাতে কোন সন্দেহ নেই। চট্টগ্রামে প্যাসিফিক জিন্সের মালিক নাসির সাহেবকে অনেকেই অনেকবার নির্বাচন করার জন্য অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু তিনি সে অনুরোধ বরাবরই প্রত্যাখ্যান করেন। তাঁর বড় ভাই আবুল কাশেম মাস্টার এবং ভায়রা এসএম আবুল কালাম নির্বাচন করতেন। কাশেম মাস্টার দু’তিনবার বিজয়ী হয়েছেন, নাসির সাহেব ভাইকে সমর্থন দিয়ে ক্ষান্ত থাকতেন। কেডিএস’এর মালিক খলিলুর রহমান সাহেবকেও অনেকে অনেকবার নির্বাচনে দাঁড় করানোর জন্য চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হন। তিনি খুব হিসেবী মানুষ, নির্বাচন করলে অনেক শত্রু হয়ে যাবে এবং সরকারের বিরোধীদল থেকে করলে সরকারও অসন্তুষ্ট হবে, এসব চিন্তা করে খলিল সাহেব কখনো নির্বাচন করেননি। খলিল সাহেবের পুতরা বিশিষ্ট শিল্পপতি এশিয়ান গ্রæপের এমডি এমএ সালামও একই কারণে কখনো নির্বাচনমুখো হননি।
যাই হোক, ব্যবসায়ীদের সাধারণ প্রবণতা হলো সরকারের তোয়াজ করা। আজকে যাদের শেখ হাসিনার সহযোগী বা সমর্থক হিসেবে চিত্রিত করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের কাছে রিপোর্ট দেওয়া হয়েছে, তারাও হয়তো দেখা যাবে কালকে তারা বর্তমান সরকারের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেছে কিংবা পরে যদি নির্বাচনে বিএনপি ক্ষমতাসীন হয় তাহলে তারা বিএনপির পক্ষাবলম্বন করেছে। সুতরাং এস আলমের টুটি টিপে না ধরে ব্যবসা করতে দিলেই বোধ হয় সরকার লাভবান হবেন। সরকারের লোন শোধের বা পাচারকৃত অর্থ ফেরত আসার একটা উপায় সৃষ্টি হবে। মাননীয় উপদেষ্টা হয়ত সেদিকেও একটি উইন্ডো খুলে রাখলে ভালো করবেন।
লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সিনিয়র সাংবাদিক