বৌদ্ধধর্মের মৌলিক ভিত্তিই হচ্ছে, জীব হত্যা মহা পাপ, অহিংসা পরম ধর্ম। গৌতম বুদ্ধ প্রদত্ত এই বাণী বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের মাঝে সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য এবং ক্রিয়াশীল বলেই আমরা জানি। কিন্তু পৃথিবীর দেশে দেশে এ ধর্মের কিছু অনুসারির প্রতিক্রিয়াশীল মনোভাব, সাম্প্রদায়িকতা ও অসহিষ্ণুতা এমন পর্যায়ে যেতে দেখা গেছে ভিন্ন ধর্ম বা মতাবলম্বিদের স্বয়ং নিজের জন্মভূমি ত্যাগ করতে হয়েছে। সম্প্রতি মিয়ানমার তারও আগে শ্রীলঙ্কার ইতিহাস অন্তত তাই বলে। প্রাচীন ইতিহাসে দেখা যায়, সম্রাট অশোক বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত-নিবেদিতপ্রাণ হয়েও অপরাপর ধর্মের প্রতি সহিষ্ণুতা স্থাপনে ব্যর্থ হয়েছিলেন। অপর ধর্মাবলম্বীদের ওপর নানা কলাকানুন আরোপসহ নির্যাতন-নিপীড়নেরও অসংখ্য দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন। এরপরও এ ধর্ম বিশ্বাসের বড় একটি অংশ গৌতম বুদ্ধের কঠোর সাধনা ও আদর্শকে ধারণ করে আধ্যাত্মিক ব্রত সাধন করে, প্রাণী হত্যার মত পাপ কাজ থেকে দূরে থাকা ও অহিংসাকে পরিত্যাগ করার আহবান জানিয়ে শান্তি ও সহিষ্ণুতাকে লালন করে আসছেন। আমাদের প্রিয় দেশ মাতৃকার দিকে থাকালে পুরোপুরিই বলা যায়, গৌতম বুদ্ধের অহিংস নীতি এ ধর্মের অনুসারীরা ভালোভাবেই চর্চা করে আসছেন। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে তারা সকল ধর্মাবলম্বীদের সাথে সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ থেকে শান্তিপূর্ণ জীবনযাপন করে আসছেন। সবচেয়ে বড় কথা, এ দেশে মাঝেমধ্যে কিছু কিছু মুসলিম ও সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে ছোটখাট বিষয়ে উত্তেজনা দেখা দিলেও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের সাথে তেমন কোন বিরোধ লক্ষ করা যায়নি। কিন্তু চট্টগ্রাম নন্দনকানন বৌদ্ধ মন্দিরের দখলদারিত্ব নিয়ে কয়েকমাস ধরে বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারিদের মধ্যে যে বিরোধ, সংঘাত ও সংঘর্ষের মত ঘটনা ঘটছে, তা রীতিমত ভয়ঙ্কর পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। কারণ এ বিরোধের জের স্বয়ং বৌদ্ধ বিহারে রক্ষিত বুদ্ধমূর্তির উপর গিয়ে ঠেকেছে। রবিবার দৈনিক পূর্বদেশে প্রকাশিত এ সংক্রান্ত শীর্ষ খবরে উল্লেখ করা হয়, শনিবার বিকালে নগরীর নন্দনকাননে চট্টগ্রাম বৌদ্ধ বিহারের দখল নিয়ে আবারও দু’পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে। এতে বৌদ্ধ ভিক্ষুসহ উভয়পক্ষের অন্তত ১২ জন আহত হয়েছেন। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে বৌদ্ধ সমিতির লোকদের বিহার থেকে বের করে দিলে পরিস্থিতি শান্ত হয়। এ ঘটনায় পুলিশের ৪-৫ জন সদস্যও আহত হন। লক্ষ করার বিষয়, নগরীর নন্দনকাননের পুরনো এ বৌদ্ধ বিহারের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বৌদ্ধ ভিক্ষু ও বৌদ্ধ সমিতির মধ্যে কয়েক মাস ধরে বিরোধ চলে আসছে। বৌদ্ধ সমিতির লোকজন গতকাল বিহারে প্রবেশ করে তাদের অফিস পুনঃদখল করে।
ভিক্ষুদের অভিযোগ, শনিবার দুপুরে চট্টগ্রাম বৌদ্ধ বিহার দখলের জন্য অবৈধ বৌদ্ধ সমিতির কর্মকর্তারা শতাধিক ভাড়াটিয়া সন্ত্রাসী দিয়ে চট্টগ্রাম বৌদ্ধ বিহারে হামলা চালায়। এসময় তারা চট্টগ্রাম বৌদ্ধ বিহারের নিচতলায় রক্ষিত বুদ্ধমূর্তি ভাঙচুর করে কক্ষ দখলে নেয়ার চেষ্টা করে। বিহারে অবস্থানরত আবাসিক ভিক্ষুদের কক্ষ থেকে জোরপূর্বক বের করে দেয় এবং ভিক্ষুদের মারধর করে। বৌদ্ধ বিহার ও ভিক্ষুদের উপর হামলার সংবাদটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দ্রæতগতিতে ছড়িয়ে পড়লে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। অনেকেই ভিক্ষু ও সমিতির অতি বাড়াবাড়ির কারণে তাদের প্রাণের বিহারের পবিত্রতা নষ্ট হচ্ছে বলে অভিযোগ করে দ্রæত এ সংকটের সমাধানের দাবি জানান। উল্লেখ্য যে, বিহারের উপাধ্যক্ষ জিনবোধি ভিক্ষু এবং তার অনুসারীদের সাথে বৌদ্ধ সমিতির বিরোধ চলে আসছিল দীর্ঘদিন ধরে। ভিক্ষুদের দাবি বিহার পরিচালিত হবে ধর্মীয় অনুশাসনে, ভিক্ষুদের দ্বারা। অপরপক্ষে বৌদ্ধ সমিতির দাবি তারাই এ বিহারের নিয়ন্ত্রক। তারা অতীতের ন্যায় এ বিহার পরিচালনা করবে। উভয়পক্ষের অনমনীয় মনোভাব সংঘাত অনিবার্য হয়ে উঠে। গত ৮ মার্চ চট্টগ্রাম বৌদ্ধ বিহারের দখল নিয়ে দু’পক্ষের মধ্যে প্রথম সংঘাত হয়। এরপর থেকে এই বৌদ্ধ বিহারের দখলকে কেন্দ্র করে উভয়পক্ষের মধ্যে বিরোধ চলে আসছিল। সর্বশেষ গত শনিবার এ বিরোধের বড় ধরনের বিষ্ফোরণ ঘটে। যা কারো কাম্য নয়। আমরা জানি, এ ধর্মের অনুসারীদের বড় একটি অংশ প্রভাবশালী ও নেতৃস্থানীয়। ঐতিহ্যবাহী একটি ধর্মীয় স্থাপনার দখল বেদখল নিয়ে দীর্ঘ দুই মাস প্রায় যে সব ঘটনা ঘটছে তা মিমাংসা করার ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকা কী, তা মোটেই দৃশ্যমান নয়। এ সংঘাত আমাদের জন্য অশনি বার্তা নয় কি? আমরা মনে করি, একটি ধর্মীয় উপাসনালয় এভাবে চলতে পারে না। এর একটি যৌক্তিক সমাধান প্রয়োজন। গৌতম বুদ্ধ নিজের ধর্মের অনুশাসনে যুক্তিকে প্রাধান্য দিয়েছেন। লোভ-লালসা ও হিংসাত্মক কার্যক্রমকে পরিত্যাজ্য করেছেন। কিন্তু নন্দনকানন বৌদ্ধ বিহার নিয়ে যা হচ্ছে, তা ধর্মীয় অনুসারী নয় শুধু চট্টগ্রামবাসীকেও হতাশ করছে। পরস্পরের মধ্যে বিদ্যমান বিরোধ নিরসন করে দ্রæত সংকটের সমাধান করার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টরা এগিয়ে আসবে-এমনটি প্রত্যাশা আমাদের।