এম. আমিন উল্লাহ মেজু
স্বাধীন বাংলাদেশে সর্বত্র বৈষম্যের পরিণতি কত যে ভয়াবহ দৃশ্য দেশ-বিদেশের মানুষ অবলোকন করেছে। রক্তস্নাত ৫ আগস্ট জাতি ও দেশ সংস্কারে এক বিরাট সুযোগ এনে দিয়েছে নিঃসন্দেহে। একে কোন ভাবে হাত ছাড়া করা যাবে না। দীর্ঘ সময় জাতির বুকে জগদ্দল পাথর হয়ে চেপে বসেছিল ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা সরকার। পাথরটা এতোটাই ভারী ছিল যে, যে কোন রাজনৈতিক দলের পক্ষেই সেটা সরানো ছিল অসম্ভব। তার পরও বিরোধী দল আপ্রাণ চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হইনি। সকল কর্মসূচি বিফলে গেছে। কারণ দুটি প্রথমতঃ ফ্যাসিবাদী সরকারের পেটোয়া পুলিশ বাহিনী দমন-পীড়নকে তারা সাহসিকতার সাথে মোকাবেলা করতে পারেনি। দ্বিতীয়তঃ দেশের সকল শ্রেণীর পেশার মানুষকে আন্দোলনের মাঠে নামাতে জনগণের আবেগকেও তারা ছুঁতে পারেনি। সত্য বলতে কী? জনগণের আবেগ ছুঁতে চাইলে রাজপথে সাঈদ, মুগ্ধ, ওয়াসিম, ফারুক, মেহেদী হাসান, ওমর হতে হয়। বিরোধী দল সেটা পারেনি। কিন্তু বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতা সেটা পেরেছে। গুলির মুখে বুক পেতে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করা সৎ সাহস বিদ্যুৎ গতিতে এক বুক থেকে শত সহস্র বুকে ছড়িয়ে দিয়ে ফ্যাসিবাদী হাসিনা সরকারকে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য করেছে। ১ জুলাই থেকে আন্দোলন শুরু হয়েছিল। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার ইস্যু নিয়ে, শুরুতেই সরকার সেটাকে গুরুত্ব দিয়ে আমলে নেয়-নি। বরং আন্দোলন নিয়ন্ত্রনে তারা বল প্রয়োগ করেছে। ছাত্রলীগ লেলিয়ে দিয়ে হামলা নির্যাতন চালিয়েছে। রাতের আধারে ছাত্রী নিবাসে শিক্ষার্থীদের ওপরে বর্বর হামলা অব্যাহত রেখেছিল। পুলিশ দিয়ে নির্বিচারে ছাত্র-জনতা হত্যা করেছে। পতনের শেষ কয়েক দিনে রক্তের হোলি খেলায় মেতে উঠেছিলো স্বৈরাচারি হাসিনা সরকার। কিন্তু অপ্রতিরোধ্য ছাত্র-জনতা। অন্যদিকে, সুযোগের অপেক্ষায় থাকা নির্যাতিত বিএনপি-জামায়াতও তাদের সাথে যোগ দিলে আন্দোলনের প্লাবণে ঢেউ জাগে। ফ্যাসিস্ট সরকার জামায়াত-বিএনপিকে দমাতে যেয়ে নির্মম হত্যাযজ্ঞের পথে জুলাই-আগস্ট বিপ্লবে ১৩৫ শিক্ষার্থীসহ ১৫৮১ জনকে হত্যা করে রক্ত পিপাসু সরকার এতেও ক্ষান্ত হয়নি গুরুতর আহত করেছে প্রায় ৩১ হাজার আন্দোলনকারীকে। নারী-শিশুসহ সমাজের সকল শ্রেণীর পেশার বিক্ষুব্ধ জনতা এক সাথে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়লো। বানের পানিতে সরকার পতনের মহাপ্লাবনে রূপ নিলো। অবশেষে জাতি হাফ ছেড়ে বাঁচলো, জনমনে স্বস্তি ফিরলো। দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভ‚ত আক্রোশ থেকেই বিক্ষুব্ধ জনতা মুহূর্তেই গণভবন, সংসদ ভবনসহ সারাদেশে পুলিশ স্টেশনে হামলা, ভাংচুর, লুটপাট, রাহাজানি সংগঠিত করে। দুঃখজনকভাবে, একই ইতিহাস বারবার ফিরে আসে। বিগত ১৫ বছরে বিরোধী পক্ষের ওপর অনেক জুলুম-নির্যাতন হয়েছে। আওয়ামীলীগ-বিএনপি মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ। দেশের মানুষ স্বৈরাচারি পরিবেশ আর সন্ত্রাসের রাজনীতি দেখতে চাই না। বিশ্বের স্বৈরাচারি পতিত দল পুনরায় দাঁড়াতে পারেনি। ছাত্র-জনতা ও সাঈদ, মুগ্ধ, ফাইয়াজ, ওয়াশিমদের আত্মত্যাগে অর্জিত এই গে․রবময় ইতিহাস। ছাত্র-জনতার ৩৬ দিনের আত্মত্যাগেই গঠিত এই বিপ্লবী সরকারকে কাজে লাগিয়ে নতুন বাংলাদেশকে একটি মানবিক রাষ্ট্রে পরিণত ও সু-শাসন প্রয়োজন। গণতন্ত্র বিপদমুক্ত নয়। বৈষম্যমুক্ত সমাজ গড়ার অঙ্গীকার করতে হবে সর্বত্র। নব উদ্যামে গঠিতব্য নতুন বাংলাদেশকে আর ভুলের কালিমায় কলংঙ্কিত করা সমীচীন হবেনা। ইতিমধ্যে একে একে দুর্নীতির মহানায়কদের গ্রেফতার করে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে বিপ্লবী সরকার যেভাবে দেশ সংস্কারের পথে হাঁটছে যা প্রশংসাযোগ্য। শহীদ আবু সাঈদ, মুগ্ধদের বীরগাঁথা ইতিহাস পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করার দাবী দেশপ্রেমিক সচেতন মহলের। সাঈদ, মুগ্ধ, ওয়াসিমরা বাংলাদেশের বিপ্লবী আইকন। তরুণরা বাংলাদেশকে দ্বিতীয়বার স্বাধীন করেছে। গণ-অভ্যুত্থানে শহীদ ও আহত পরিবারের পাশে থাকতে হবে। এবং তাদের রক্তের মর্যাদা দিতে হবে। পরিশেষে, গণ-অভ্যুত্থানে তার ইতিহাস হয়ে সাক্ষ্য দেবে-যেন ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি না ঘটে। রক্তই সমাধান নয়-সংলাপের মাধ্যমেই সকল সমস্যার সমাধান করতে হবে। আলাপ-আলোচনা আর সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে যেমনি স্বাধীন হয়েছিল ভারত-পাকিস্তান। আমরাও চাই উদার গণতন্ত্র, চাই সত্যিকারের বৈষম্যমুক্ত সমাজ। গণতন্ত্র কখনো পালায় না। স্বাধীন বাংলাদেশের ১৭ কোটি মানুষ স্ব স্ব অবস্থান থেকে সকল বৈষম্য দূর করে ক্ষমা-সমঝোতা ও উদারতা প্রদর্শনের মাধ্যমে দুর্বল জাতি নয়- সুস্থ জাতি আর পরনির্ভরতা ত্যাগের মধ্য দিয়ে আত্মনির্ভরশীল জাতি হিসেবে বেঁচে থাকতে চাই- ইনশাআল্লাহ। জয়তু ছাত্র-জনতা।
লেখক: গণমাধ্যম কর্মী