বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সামাজিক প্রেক্ষাপট এবং ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের অবনতি

1

প্রফেসর ড. নারায়ন বৈদ্য

একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে কতগুলো অনুষদ থাকে। যেমন- কলা অনুষদ, বিজ্ঞান অনুষদ, সমাজ বিজ্ঞান অনুষদ, আইন অনুষদ ইত্যাদি। আমি যেহেতু সমাজবিজ্ঞান অনুষদের একজন শিক্ষক, সেহেতু যে কোনো বিষয়ের সামাজিক প্রেক্ষাপট আলোচনা করা আমার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। অতিসম্প্রতি সময়ে বাংলাদেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের আন্দোলনের প্রেক্ষিতে রাষ্ট্রীয় নীতিতে যেমন এক বিরাট পরিবর্তন এসেছে, তেমনি সামাজিক রীতিনীতিতেও এক বিরাট পরিবর্তন দেখা যায়। কিন্তু এই বিশাল আন্দোলনের সামাজিক প্রেক্ষাপট কী ছিল? তা আলোচনা করতে গেলে সমাজের অনেকগুলো দিক নিয়ে আলোচনা করতে হবে।
গ্রামে বসবাসরত একজন সাধারণ মানুষ আশা করে যে, সে শান্তিতে জীবন জীবিকা নির্বাহ করবে। কিন্তু, মানুষের ভবিষ্যৎ জীবন অনিশ্চিত। এ অনিশ্চিতয়তার গর্তে পতিত হয়ে অথবা কন্যা সন্তানের বিবাহ উপলক্ষে ব্যয় নির্বাহ করার জন্য অথবা পুত্র সন্তানকে বিদেশে পাঠানোর জন্য এক খন্ড জমি (ভিটা বাড়ী অথবা চাষের জমি) বিক্রয় করতে চায়। কিন্তু তিনি কি পেরেছেন? হ্যাঁ তিনি বিক্রয় করতে পেরেছেন অন্যের কাছে নয়। বরং কম দামে সেই নেতার কাছে যে নেতা প্রচন্ড প্রভাবশালী। এ বিষক্রিয়া সমাজের প্রতিটি রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে গিয়েছিল। আর শহর বা শহরতলীর অবস্থা তো আরো খারাপ। আপনি সারা জীবনের কষ্টার্জিত অর্থ দিয়ে নিজ জায়গায় একটি একতলা বা দ্বিতল বাড়ি নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়েছেন। তা আপনি করতে পারবেন না। আপনাকে চাঁদা দিতেই হবে। কাকে আপনি চাঁদা দিবেন? শুনলে অবাক লাগে। যাকে আপনি ভোট দিয়ে এলাকার জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত করেছেন তাকে। তিনি লজ্জায় আপনার কাছে আসেনি। বরং একজন দালাল বা পাতি নেতাকে পাঠিয়েছেন। আপনি যখন টাকা দিলেন না, তখন আপনাকে কিছুতেই কাজ করতে দেবে না। বড় বড় এলাকার নেতাদেরকে দেখেছি তারাও আপনার ক্রয়কৃত জায়গায় বস্তি তোলার নাম করে বিশাল অংকের উৎকোচ গ্রহণ করেছে। অথচ তিনি বাইরে বিরাট দানবীর। শুধু তাই নয়, অধিকাংশ অফিসে ঘুষ বা উৎকোচ ছাড়া কোনো কাজ হয়েছে বলে মনে হয় না। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির প্রধান কারণ কিন্তু উৎপাদন হ্রাস নয়। বরং পরিবহন খাতে চাঁদাবাজি। তাছাড়া ঘুষ ও দুর্নীতি এমনভাবে বৃদ্ধি পেয়েছিল যে, ছোট থেকে বড় পর্যন্ত সবাই টাকা আয়ের নিত্য নতুন কৌশল আবিষ্কার করতে থাকে। ক্যাসিনো কাÐ, মাদক দ্রব্য, আইস, হেরোইন ইত্যাদি অর্থনীতিকে করেছে দূষিত: আর সমাজকে করেছে আকাশ-পাতাল বৈষম্য। এমন অনেক সরকারি প্রতিষ্ঠান আছে যে সব প্রতিষ্ঠানের কর্তা ব্যক্তিরা অর্থ ও প্রতিপত্তির দিক থেকে হয়ে উঠেছিল রাজা বা বাদশা। আবার ক্ষমতার দাপটও ছিল তাদের বেশি। ফলে সমাজের নিঃস্ব জনগোষ্ঠী ছিল নির্যাতিত এবং নিষ্পেষিত। বিশেষ করে মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির মনে জমা হয়েছিল ব্যাপক হতাশা এবং ক্রোধ। সরকার সংশ্লিষ্ট ছাত্র রাজনীতির দাপটে অধিকাংশ ছাত্র-ছাত্রী ছিল বিমুঢ়। পারছিল না কথা বলতে, পারছিল না প্রতিবাদ করতে। তবে গ্রামের ব্যাপক দরিদ্র জনগোষ্ঠির জন্য সরকার বেশ কিছু প্রকল্পও হাতে নিয়েছিল যা বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজ ব্যবস্থাকে প্রান্তিক জনগোষ্ঠি হিসেবে টিকিয়ে রেখেছিল। তাতেও যে দুর্নীতি হয়নি তা কিন্তু নয়। স্বর্ণের মেডেলে স্বর্ণ ছিল না। দরিদ্রের জন্য নির্মিত বাড়িসমূহে পর্যন্ত অর্থ প্রদান করা সত্তে¡ও কাঠামোগত দুর্বল বাড়ি নির্মাণ করে দিয়েছিল। এই অনিয়মতান্ত্রিক বিষয়গুলোকে দূর করা কিছুতেই সম্ভব হয়নি। সামাজিক এই প্রেক্ষাপটে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন এদেশের ছাত্র-জনতাকে আকর্ষণ করেছে বেশি।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাফল্য লাভের সাথে সাথে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের অবনতি হতে শুরু করেছে। বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় দেখা যাচ্ছে, জোর করে শিক্ষকদের পদত্যাগ করানো হচ্ছে অথবা পদত্যাগে বাধ্য করা হচ্ছে। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে ভিন্নতা আছে। প্রাচ্যের শিক্ষা ব্যবস্থায় একটি কথা প্রচলন আছে। বলা হয়ে থাকে যে, পিতা-মাতার পরে শিক্ষকের স্থান। কিন্তু বিভিন্ন মিডিয়াতে এখন যে অবস্থা দেখা যাচ্ছে তাতে স্পষ্ট যে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনের পরবর্তী সময়ে ছাত্র ও শিক্ষকের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে এবং এখনো ঘটছে। অনেক স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পুরোদমে ক্লাশ চালু হয়নি। শ্রেণিকক্ষগুলো ফাঁকা পড়ে আছে। বেঞ্চগুলোয় পড়ে গেছে ধূলার স্তর। হয়তো এক সময় ছাত্ররা শ্রেণিকক্ষে ফিরবে। কিন্তু থাকবে না সাঈদ, মুগ্ধ, হ্রদয়দের মত তরুণেরা। তাদের বুকের মাঝে থাকবে এক প্রকার শূন্যতা। এ অবস্থার প্রেক্ষিতে আগের মত ছাত্র-শিক্ষকদের সম্পর্ক বজায় থাকবে কিনা- তা বলা মুশকিল। আমি একজন শিক্ষক হিসেবে নির্বিঘ্নে বলতে পারি- বিভিন্ন কারণে এ সম্পর্কের অবনতি ঘটবে। দীর্ঘদিনের জমে থাকা ক্ষোভ, বর্তমান সময়ে বৃদ্ধি পাবে। কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের লেকচার অপছন্দ হলেও ছাত্রদের তা প্রকাশ করার সুযোগ ছিল না। কোনো টিচারকে কোনো কোর্সের জন্য উপর্যুক্ত মনে না হলেও ছাত্রদের তা বলার ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে নেই কোনো স্বচ্ছতা বা আন্তর্জাতিক মানদন্ডের প্রতিফলন। নির্ধারিত সময়ে কোনো কোর্সের সিলেবাস শেষ হচ্ছে কিনা তা নিয়ে কলেজ শিক্ষকদের যেমন কোনো মাথা ব্যথা নেই তেমনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদেরও কোনো মাথাব্যথা নেই। কথায় এবং ব্যবহারে প্রতিটি শিক্ষক যেন রাজা। আমি এমন কলেজ শিক্ষকদের দেখেছি, যারা ক্লাশে যথাযথভাবে পড়ানোর জন্য তেমন চেষ্টা করে না। কিন্তু কলেজের পার্শ্ববর্তী কোচিং সেন্টারে প্রতিটি চ্যাপ্টার গুরুত্ব সহকারে পড়িয়ে থাকেন। কলেজে সময় যথাযথ না দিলেও কোচিং এ যথাযথ সময় দিয়ে থাকেন। এসব বিষয়গুলো ছাত্র-ছাত্রীদের মনে গভীর রেখাপাত করে। কিন্তু ছাত্র-ছাত্রীদের বলার কিছু ছিল না। এখন সময়ের প্রেক্ষিতে ছাত্র-ছাত্রীদের বলার সময় এসেছে। ফলে ছাত্র-শিক্ষকদের সম্পর্কের অবনতি অনিবার্য। এই অস্বস্তিকর অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে, হতে হবে আরো আন্তরিক। সন্তানের মত সবকিছু ভুলে গিয়ে বুকে টেনে নিতে হবে। ক্লাশের প্রতি হতে হবে আরো যত্নবান। উত্তরপত্র পরীক্ষণ করতে হবে স্বল্প সময়ে, ফলাফল প্রদান করতে হবে স্বল্প দিনের মধ্যে। অর্থাৎ অলসতা করে শিক্ষকতা করার কোন সুযোগ নেই।
আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন শিক্ষকদেরকেও দেখেছি যারা খুবই জ্ঞানী। পড়ালেখায় আন্তরিক। গবেষণায় এতই মনোযোগী যে বাইরের কিছুই চিন্তা করার সুযোগ তাদের নেই। আবার কিছু কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষককে দেখেছি, যারা ক্লাশের ব্যাপারে উদাসীন। যেন ক্লাশ না নিতে পারলেই বাঁচে। তবে এর সংখ্যা খুবই কম। এই বিষয়গুলো ছাত্র-ছাত্রীরাও অবগত। আর এই সংকটময় পরিস্থিতিতে ছাত্ররা যদি কিছু বলে তা অন্যায় হবে না। ফলে আমাদের শিক্ষক সমাজকে হতে হবে আরো যত্নবান। নিজ বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজকে ভালবাসতে হবে। ছাত্র-ছাত্রীদেরকে আপন করে নিয়ে শিক্ষায় মনোযোগী হতে হবে। একই সময় পড়ালেখার সাথে সাথে মেধাভিত্তিক প্রতিযোগিতা, সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড বৃদ্ধি করতে হবে। তবেই সংকট উত্তরণ সম্ভব।
লেখক : ইউএসটিসি, চট্টগ্রাম