বৈশাখের ‘নিজের পথে’ ফেরা

5

আবু মোশাররফ রাসেল

ক্যালেন্ডারের পাতায় আমরা যে মাসগুলোকে ‘বাংলা মাস’ আর মাসের সমন্বিত রূপকে ‘বাংলা সন’ বলি সেটি যে আসলে ‘ফসলি সন’-তা অনেকে খুব একটা জানেন না। আজকের বাংলাদেশ বা এই অঞ্চলটি প্রাচীনকাল থেকেই প্রধানত কৃষির ওপর নির্ভরশীল ছিল। কৃষিই ছিল এই অঞ্চলের প্রধান জীবন-জীবিকার উৎস। সুতরাং, এখানে যা কিছু হতো, ঘটতো বা দরকার পড়তো-সবই ছিল কৃষক জীবন ও কৃষি ব্যবস্থাকে কেন্দ্র করেই। বাংলা সনও সে রকম একটি ব্যাপার। এখন থেকে প্রায় ৫শ বছর আগে সুষ্ঠুভাবে খাজনা আদায়ের প্রয়োজনে মুঘল সম্রাট আকবর বাংলা সনের প্রবর্তন করেছিলেন।
‘বৈশাখ’Ñবাংলা সনের প্রথম মাস, ক্ষেত থেকে ফসল ঘরে তোলার মৌসুম। বাংলা সন প্রবর্তনের পর মাসটিতে খাজনা আদায়কে কেন্দ্র করে এ দেশে ধীরে ধীরে নানা ধরনের উৎসব-আয়োজন এর সূচনা ঘটে। সেসব উৎসবের সব কেন্দ্রবিন্দুই ছিলÑকৃষক পরিবার অথবা কৃষিজমি। বৈশাখ মাসে ধান কিংবা অন্যান্য ফসল ঘরে তোলার পর, নতুন ফসল বোনার আগে যখন বিস্তীর্ণ জমি খালি হতো, সে সময়েই মাঠজুড়ে খেলাধুলার ধুম আর উৎসবের ঢেউ উঠতো। খালি মাঠে শিশু-কিশোররা কাবাডি, ফুটবলসহ বিভিন্ন খেলায় মেতে থাকতো প্রতিদিন, কিশোরীরা কাবাডি ছাড়াও খেলতো বউচি, দড়িলাফ। আর তরুণ-যুবাদের (ক্ষেত্র বিশেষে বুড়ো মানুষদেরও) অংশগ্রহণে আয়োজন হতো কুস্তি প্রতিযোগিতা বা বলী খেলা, হতো গরুর লড়াই। সেসব খেলা ঘিরে বসতো বৈশাখী মেলা, মেলায় বিক্রি হতো মাটির তৈরি বিভিন্ন তৈজসপত্র আর সংসারের প্রয়োজনীয় অনেক জিনিসপত্র; যেগুলো তৈরির উপকরণ ছিল প্রধানত গাছ-বাঁশ, লতা-গুল্ম। মেলায় শিশুদের জন্য নানা ধরনের খেলনা মিলতো, সেগুলোও প্রাকৃতিক উপাদানেই স্থানীয়ভাবে তৈরি হতো। মেলায় আসতো নাগরদোলা, হতো পুতুল নাচ। এসবের মাঝেই সারা বছরের আনন্দ খুঁজে পেতেন কৃষির শ্রমে বিপর্যস্ত, ক্লান্ত-শ্রান্ত সব শ্রেণীর মানুষ। মূলত এটাই ছিল বৈশাখের চিরন্তর রূপ-‘নিজস্ব পথ।’
বৈশাখের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ-ব্যবসায়ীদের হালখাতা। সেকেলের খাজনা আদায়ের আদলে ব্যবসায়ীরা সারা বছরের বকেয়া আদায় করার জন্য ‘হালখাতা উৎসব’ এর আয়োজন করতেন। বৈশাখের প্রথম দিনটিতে পুরোনো খাতা বদলে নতুন খাতায় নতুনভাবে লেনদেন শুরু করতেন। সেদিন ব্যবসায়ীরা তাদের গ্রাহকদের কাছ থেকে বকেয়া আদায়ের পর মিষ্টিমুখ করাতেন-তা নিয়ে পরস্পরের মধ্যে আনন্দের ভাগাভাগি হতো, সম্প্রীতি ছড়িয়ে পড়তো। এই অঞ্চলে কবে থেকে হালখাতা প্রচলন হয়েছে তার সঠিক কোনো তথ্য জানা যায় না। তবে হালখাতার ঐতিহ্যও এই অঞ্চলের বহুদিনের, বিশেষ করে প্রাচীনকাল থেকে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে অধিষ্ঠিত থাকা বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামের বাণিজ্যিক কেন্দ্রগুলোতে হালখাতার ঐতিহ্য বেশ পুরোনো একটি ব্যাপার। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সেই হালখাতা অনেকটা ফিকে হয়ে গেছে নানা কারণে। তা নিয়ে বিস্তারিত এই লেখায় বলতে চাই না।
বাংলা সনের মতো বৈশাখের উৎসব হয়তো পাঁচশ বছরের পুরোনো নয় কিন্তু এসবই ছিল এই অঞ্চলের প্রাচীন ঐতিহ্য। আমাদের শৈশবে, আশির দশক কিংবা নব্বইয়ের দশকেও গ্রামীণ জনপদে বৈশাখী উৎসবের এই দৃশ্যপটই দেখেছি। তারপর…এই শতাব্দীর শুরুর দিক থেকে বিশ্বায়ন, নগরায়ণের হাওয়া এই দেশে জোরেশোরে বইতে থাকে। সেই হাওয়ায় শিল্পায়নের পথ ত্বরান্বিত হয়, ধীরে ধীরে কৃষিজমি আর কৃষক পরিবার কমতে থাকে। গ্রামের কৃষকের সন্তানরা গ্রাম ছেড়ে শহরে আসতে থাকে। শহরেও বিনোদনের আয়োজন হিসেবে বৈশাখী উৎসবের সূচনা ঘটে। শুরুর দিকে শহুরে আর গ্রামীণ জনপদের ঐতিহ্যের মিশেলে শুরু হয় পহেলা বৈশাখ উদযাপন। ধীরে ধীরে ‘ক্ষেতের মাঠ’ থেকে বৈশাখের উৎসব উঠে আসে ‘ইটপাথরে বন্দী’ শহুরের মানুষদের কাছে। শহুরে মানুষরাই ধীরে ধীরে বৈশাখী উৎসব-আয়োজন বদলে দিতে থাকেন, নতুন রূপ-রঙ লাগাতে থাকেন। তার ঢেউয়ে গ্রাম থেকে এক এক করে হারিয়ে যেতে প্রাচীন সব ঐতিহ্যবাহী আয়োজন। এভাবে…বৈশাখ তার ‘নিজস্ব পথ’ হারাতে থাকে। গত কয়েক দশক ধরে বৈশাখী উৎসব শহরে বড় ধরনের আমেজ ছড়িয়েছে প্রতি বছরই। দিনে দিনে শহুরে মানুষের মূল উৎসবের জায়গায় স্থান করে নেয় পহেলা বৈশাখের আয়োজন। এই সুযোগে বৈশাখের উৎসবের সাথে মিশে যেতে থাকে ভিনদেশী সংস্কৃতিও। সময়ের বিবর্তনে ‘পহেলা বৈশাখ’ বর্ষবরণ উৎসব বাঙালির সর্বজনীন উৎসবে রূপ নেয়। তবে তাতে শহুরে সংস্কৃতি প্রাধান্য পেতে থাকে, ঐতিহ্যের পরম্পরায় নতুন নতুন উপকরণ-দৃশ্যপটের অনুপ্রবেশ ঘটতে থাকে।
এই যে ইতিহাসের পরম্পরায় আবহমান বাঙালির চিরন্তন ঐতিহ্যবাহী আয়োজনগুলো বদলাতে থাকে, তার ধারাবাহিকতা দেখেছি গত বছর পর্যন্তও। কিন্তু হঠাৎ যেন সম্বিত ফিরে পেলাম এ বছর। এবারের পহেলা বৈশাখের দৃশ্যপট ধরা দিল ভিন্ন আমেজে, আরেক রূপে। সেটা যে কারণেই হোক, এবার আনন্দ শোভাযাত্রা কিংবা শহুরে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে ‘দর্শক-দশনার্থীর খরা’ স্বীকার করেই নিতে হবে।
পহেলা বৈশাখে সকাল থেকেই চট্টগ্রাম শহরের বিভিন্ন অনুষ্ঠানস্থল, বিনোদন কেন্দ্র আর কাছাকাছি উপজেলাগুলোর উৎসব আয়োজনে নজর রেখেছিলাম…তুলনামূলক দৃশ্যপট মূল্যায়নের লক্ষ্যে। খবর নিয়েছি গ্রামীণ জনপদের আয়োজন নিয়েও। সব মিলিয়ে যা জানতে পেরেছি, তার সারমর্ম হলোÑবৈশাখ যেন এবার তার ‘নিজের পথে’ ফিরেছে।
চট্টগ্রামের প্রধানতম উদ্যোগ-সিআরবি সিরীষতলায় আয়োজিত বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে এবার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পাশাপাশি ছিল ঐতিহ্যবাহী ‘কাবাডি’ আর বলীখেলা (কুস্তি প্রতিযোগিতা)। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আনন্দ শোভাযাত্রা আর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে থেমে থাকেনি বর্ষবরণ, সেখানে হয়েছে গ্রামীণ ঐতিহ্যের সবচেয়ে ভালো আয়োজন। চবি বর্ষবরণ উৎসবে কাবাডি, বউচি আর বলীখেলা-ই ছিল অন্যতম আকর্ষণ। এসব আয়োজনে শিক্ষার্থীরা স্বতঃস্ফ‚র্ত অংশগ্রহণ যেমন করেছেন, তেমনি সবাই মিলে উপভোগও করেছেন বেশ। গ্রামীণ জনপদে এবার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের সুর-মূর্ছনা ছাপিয়ে ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলায় বৈশাখী উৎসব কেটেছে, অনেক স্থানে বসেছিল বৈশাখী মেলাও। পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীরা অনেক বছর ধরেই সম্মিলিত বৈসাবি উৎসব (বৈসুক, সাংগ্রাই, বিজু) উদযাপন করে পাহাড়কে মাতিয়ে রাখে। তারা নিজস্ব সংস্কৃতির ধারায় বর্ষবরণ করেন ব্যাপক উচ্ছ¡াসে। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি।
বৈশাখের ‘নিজের পথে’ ফেরার অথবা বৈশাখের ঐতিহ্য ফিরে আসার যে কথা বলছি তার ভিত্তি বুঝতে গেলে আমাদের একটু করে ইতিহাসের দিকে ফিরতে হবে। গত কয়েক দশক ধরে পহেলা বৈশাখ আসলেই ‘পান্তা-ইলিশ’ বেশ প্রচার পেতে থাকে, শহুরে জীবনে পহেলা বৈশাখের দিন পান্তা-ইলিশ খাওয়ার রীতি আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতিরই যেন অংশ হয়ে গেছে। আবার কেউ কেউ বলেন, পান্তা-ইলিশের সাথে বৈশাখের কোনো সংযোগ নেই। ব্যাপারটিকে আমি একটু অন্যভাবে দেখি। যেহেতু ফসলি সন প্রবর্তন হয়েছিল কৃষি-কৃষককে কেন্দ্র করে, সুতরাং বৈশাখের সাথে পান্তাভাতের যোগসূত্র ঐতিহাসিকভাবেই আছে। আর ‘মাছে-ভাতে বাঙালি’ প্রবাদে থাকলেও কয়েকশ বছর আগেও সাগর থেকে বর্তমান সময়ের মতো টনে টনে ইলিশ ধরে আনার সক্ষমতা এ দেশে তখন ছিল না। গরিব কৃষক ভোর-সকালে পান্তাভাতে এক চিমটি লবণ মিশিয়ে, একটি মরিচ পোড়ে খেয়েই ক্ষেতের কাজে নেমে পড়তেন। সুতরাং পান্তাভাত বৈশাখের ঐতিহ্য। ফসলি সনের সাথে পান্তাভাতের যোগসূত্র থাকলেও ইলিশের হিসাবটি মিলে না। এভাবেই হয়তো আমাদের বৈশাখে অনেক নতুন অনুষঙ্গ মিশে গিয়েছিল, ভিনদেশী সংস্কৃতিকে নিজেদের মনে করে উৎসাহিত-উদযাপিত করেছি আমরা অথচ ইতিহাসের রায়ে তার সত্যতা মিলে না। ফসলি সনের প্রথম মাস ঘিরে আমাদের যেসব ঐতিহ্য প্রাচীনকাল থেকে পথ বেয়ে ধীরে ধীরে ইতিহাসের অতলে হারিয়ে যাচ্ছিলÑসেই কাবাডি, বলীখেলা, গরুর লড়াই, বউচি হঠাৎ এবার ঝলকানি দিয়ে গেল, বৈশাখের নতুন দৃশ্যপট, নতুন আলো দেখলাম। আগামীতে হয়তো…আরও বেশি ঐতিহ্যের উদযাপনে মত্ত হবে পুরো জাতি, তাতেই আসবে সমৃদ্ধিÑকারণ, নিজের ঐতিহ্যের মাঝেই লুকিয়ে থাকে আত্মমর্যাদার, আত্মউন্নতির সমস্ত উপাদান।
হারানো ঐতিহ্য ফিরে আসার মাঝে, বৈশাখের নিজের পথে নতুনভাবে ফেরার মাঝেও আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা-ই প্রাসঙ্গিক।
‘তোরা সব জয়ধ্বনি কর!
তোরা সব জয়ধ্বনি কর!
ঐ নূতনের কেতন ওড়ে কালবোশেখির ঝড়
তোরা সব জয়ধ্বনি কর!!’