লিটন দাশ গুপ্ত
বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন-
‘প্রেমের ফাঁদ পাতা ভুবনে,
কে কোথা ধরা পড়ে কে জানে-’
বিচিত্র এই পৃথিবীতে নারী পুরুষ পরস্পরের প্রতি আকর্ষণ কিংবা সম্পর্ক বড়ই বৈচিত্র্য। তাই প্রেমের ক্ষেত্রে দেখা যায়, জাতি ধর্ম বংশ গোত্র মত বয়স বর্ণ উচ্চতা ওজন শিক্ষা দীক্ষা ইত্যাদি কোন কিছুই বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনা। ইতিহাসে এমন অনেক প্রেমের দৃষ্টান্ত রয়েছে, যা আমরা অনেকেই শুনেছি বা জেনেছি। যেমন- রানু অধিকারীর বয়স যখন বারো বছর, তখন বিচিত্র ভাষায় গভীর আবেগে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের কাছে চিঠি লিখতে শুরু করেছিল। আর এই সময় নোবেল পুরস্কার বিজয়ী রবীন্দ্রনাথের বয়স ছিল সাতান্ন বছর। তখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন; ‘তুমি ছোট মেয়ে, আমি দাঁড়ি-গোফ ওয়ালা মানুষ, আমাকে দেখলে ভয় পাবে।’ অন্যদিকে রানু লিখেছেন, ‘আমি মনে করি আপনার বয়স সাতাশ বছর। তাছাড়া কবি সাহিত্যিকের আবার বয়স হয় নাকি!’ এইভাবে ১৯১৭ সাল থেকে ১৯২৫ সাল পর্যন্ত অনেক অনেক বৈচিত্র কথায় ৮ বছরের পরিপূর্ণ প্রণয়ের সম্পর্ক, ১৫৯ তম আবেগিক এক চিঠির মাধ্যমে ছিন্ন করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। অতঃপর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিখ্যাত অধ্যাপকের কন্যা, সেরা সুন্দরী এই রানুর সাথে বিয়ে হয় স্যার বীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের সাথে। যিনি ভারতবর্ষে একজন খ্যাতিমান শিল্পপতিও ছিলেন।
শুধু তাই নয়, আমাদের দেশে জনপ্রিয় লেখক হুমায়ুন আহমেদ, তাঁর মেয়ের বান্ধবীকে নিয়ে অনেক নাটকীয়তার পর অবশেষে বিয়ে করে নিয়েছেন। কৈশোর বেলায় দেখেছি, বারো বছর বয়সী রূপবানের সাথে, বারো দিনের রহিমের বিয়ের কল্প কাহিনী নিয়ে নির্মিত ‘রূপবান’ চলচ্চিত্র দর্শক শ্রোতার মন কেড়ে নিয়েছিল। এই রকম আরো কত দৃষ্টান্ত- গল্পে ইতিহাসে কিংবা বাস্তবে রয়েছে তার হিসাব নাই। তবে এই সকল ঘটনা অধিকাংশক্ষেত্রে নারী অপেক্ষা পুরুষের বয়স অতি বেশী বলে আলোচনায় এসেছে। আর যদি পুরুষ অপেক্ষা নারীর বয়স অতি বেশী হয় তাহলে কেমন হয়! নিশ্চয় সকলের দৃষ্টি আরো বেশী আকর্ষিত হবে। আলোচনা সমালোচনা বেশী করে বাড়বে। আর যদি হয়ে থাকে কলেজের অধ্যাপিকার সাথে কলেজের ছাত্র, তা হলে তো আর কথায় নাই! বছর কয়েক আগে নাটোরের গুরুদাসপুর ইউনিয়নের পাটপাড়া গ্রামের ২০ বছর বয়সী ছাত্র মামুনের সাথে যেমনটি ঘটেছিল খুবজিপুর ডিগ্রী কলেজের সহকারি অধ্যাপিকা ৪১ বছর বয়সী খায়রুন নাহারের সাথে! একই কলেজের সহকারি অধ্যাপিকা খায়রুন নাহারের সাথে কলেজ ছাত্র মামুনের বাস্তব প্রণয় আর পরিণয়ের মধ্যে ছিল বাস্তব নাটকীয় ঘটনা। এই ঘটনা প্রথমে নিরবে হলেও ছয়মাস পর সরব হয়ে উঠে সোশ্যাল মিডিয়া ফেসবুকের কল্যাণে। সবশেষে রহস্যজনক মৃত্যুর মধ্যদিয়ে ছয় মাসের প্রেমকাহিনী ও বিবাহোত্তর দাম্পত্য জীবন পরিসমাপ্তি ঘটে। শুধু খায়রুন মামুন নয়; মাত্র কয়েকদিন আগে পশ্চিমবঙ্গের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা ও বিভাগীয় প্রধান পিয়ালী ব্যানার্জীর সাথে ঘটে ১ম বর্ষের ছাত্রের প্রণয়োত্তর বিয়ে।
আসলে ভালোবাসার সুনির্দিষ্ট কোন সংজ্ঞা নাই। আমরা অনেকেই মনেকরি, ভালোবাসা মানে একটি সুনির্র্দিষ্ট বয়সে বিপরীত লিঙ্গের প্রতি দুনির্বার আকর্ষণ! অর্থাৎ তরুণ বা যৌবনে ছেলে ও মেয়ের প্রতি অদৃশ্য এক মোহ, যার কারণে একে অপরকে কাছে পাবার প্রবণতা। আসলে ভালোবাসা কেবল প্রেমিক প্রেমিকার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। মা-বাবা, স্বামী-স্ত্রী, সন্তান-সন্ততি, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব সকলের প্রতি ভালোবাসা হতে পারে। আবার ভালোবাসা কেবল মানব মনে নয়, হতে পারে কোন পোষা অপোষা প্রাণীর প্রতি। কিংবা হতে পারে ব্যবহার্য শখের কোন জিনিস বা সম্পদ আর পৃথিবীতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্রকৃতির প্রতি। আবার আধ্যাত্মিক জগতে নিজ নিজ স্রষ্টার প্রতিও হতে পারে ভালোবাসা। এক কথায় জীব ও জড়ের প্রতিও ভালোবাসা হতে পারে। যা একটি অদৃশ্য অনুভুতি, যা অনুভব করা যায়, দেখা যায়না। অন্যদিকে ভালোবাসা কোন একটি নির্দিষ্ট দিনে বা তারিখে নয়, ভালোবাসা হতে পারে প্রতিদিন, প্রতিক্ষণে প্রতি মুহূর্তে।
আমরা জানি, গোলাপ ফুলে কাঁটাও থাকে। মানে ভালোবাসায় বিরহ থাকে। এখন কথা হচ্ছে ভালোবাসার সার্থকতা প্রাপ্তিতে নাকি অপ্রাপ্তিতে; মিলনে না বিরহে। অনেকে বলে থাকে মিলনে প্রেম মলিন হয়, বিরহে হয় উজ্জ্বল। তবে এটা সত্য, ভালোবাসা জীবনকে জয় করে, মরণকে করে পরাজয়! তাই প্রিয়জন চলে যায় ওপাড়ে, এপাড়ে শ্বাশত চিরন্তন প্রেম থেকে যায় জীবন মরণের মাঝে। একটি দৃষ্টান্ত দিয়ে যদি বলতে হয়, তাহলে সেই খায়রুন মামুনের উদাহরণটা দেয়া যায়। ওদের সম্পর্কটা ছিল অতি গভীর মধুর অকৃত্রিম! মৃত্যুর সপ্তাহ দুয়েক আগে বিয়ে হবার বিষয়টি প্রকাশ্যে এলে, ঝড়ের গতিতে ঘটনাটি সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়। ছাত্র-শিক্ষিকা সম্পর্ক ও অসম বয়সের কারণে বিভিন্ন জনের আলোচনা সমালোচনার মধ্যে খায়রুন নাহার বলেছিল, ‘ভালোবাসায় আবার বয়স থাকে নাকি।’ অন্যদিকে নানান জনের নানান মন্তব্য প্রসঙ্গে মামুন বলেছিল, ‘মন্তব্য কখনো প্রেমের গন্তব্যে পৌঁছাতে বাধা হতে পারেনা।’ আবার দুজনেই প্রতিজ্ঞা করেছিল, শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত দুটি জীবন একসাথে থাকবে। কিন্তু না, তা হলোনা। অবশেষে ছয়মাস কাহিনীর চিত্রনাট্য শেষ হলো নায়িকার মৃত্যুর মধ্যদিয়ে। চলে গেল খায়রুন রয়ে গেল মামুন! তাই শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বলেছেন বড় প্রেম শুধু কাছেই টানেনা, দূরেও ঠেলে দেয়। আর এই ঘটনার প্রেক্ষিতে মনে মনে আমিও ভাবছি, অসম প্রেমে যে পরিমাণ রস থাকে, ঠিক সেই পরিমান কষ-ও থাকে!
লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট