
সুমন গোস্বামী
শতাব্দীর বিস্ময়কর আবিষ্কার টেলিভিশন। বাংলাদেশে নব্বই দশকের শুরু থেকে ধীরে ধীরে অন্দরমহলে ঠাঁই পেতে শুরু করে টেলিভিশন। হয়ে উঠে জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এরপর এলো কম্পিউটার। তারপর ল্যাপটপ আর সবশেষে মোবাইল ফোন। আর যুগের আধুনিক সংযোজন ইন্টারনেট। সাদা কালো ছবির দিনগুলো থেকে হালের লাইভ স্ট্রিমিংয়ের যুগ পর্যন্ত টেলিভিশন একদিকে যেমন সামাজিক পরিবর্তনে ভূমিকা রেখেছে, অন্যদিকে সেসব পরিবর্তন পর্দার মধ্যদিয়ে মানুষের সামনে তুলেও ধরেছে। টেলিভিশনের যাত্রা শুরু হয় ক্যাথোড রে টিউব তথা সিআরটি সংস্করণের মাধ্যমে। এরপর বাজারে আসে রঙিন সিআরটি টিভি। পরবর্তী সময়ে বড় বাক্সের মতো সেসব টিভির পরিবর্তে আসে লাইট এমিটিং ডায়োড মানে এলইডি টিভি। খুব দ্রæতই সে সংস্করণেরও জায়গা নেয় লিকুইড ক্রিস্টাল ডিসপ্লে বা এলসিডি টিভি। এখন সে জায়গা দখল করছে স্মার্ট টিভির নানান সংস্করণ। এরই মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে অ্যান্ড্রয়েড অপারেটিং সিস্টেমের স্মার্ট টিভিগুলো। জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে টেলিভিশন। তথ্যের আদান প্রদান ও স¤প্রচার এবং বৈশ্বিক সাংস্কৃতিক বিনিময়ের ক্ষেত্রেও অপরিসীম ভূমিকা রেখে চলেছে এটি। যার স্বীকৃতি দিতেই প্রতি বছরের ২১ নভেম্বর সারা পৃথিবীতে উদযাপিত হয় বিশ্ব টেলিভিশন দিবস।
১৯৯৬ সালে জাতিসংঘ দিবসটির উদযাপনে সূচনা করে। যার লক্ষ্য গণমাধ্যম হিসেবে টেলিভিশনের ভূমিকা এবং শিক্ষা, বিনোদন ও মানুষের সঙ্গে মানুষের যোগাযোগের একটি উন্নত মাধ্যম হিসেবে এর নানা ইতিবাচক দিক আলোকপাত করা হয়। তথ্য ও প্রযুক্তি তথা ডিজিটাল অগ্রগতির এই যুগে টেলিভিশন চ্যানেলগুলো এখন দর্শক খরাতে পড়েছে। একটা সময় দেশে ছিল একটাই চ্যানেল- বিটিভি। সেখানে যা প্রচারিত হত তার সবই থাকত দর্শকের মুখস্থ থাকতো। এখন টেলিভিশনের সংখ্যা অনেক বেশি কিন্তু আগের মতো দর্শক নেই কোনো চ্যানেলেই। বর্তমানে শহর বা গ্রামের এলাকায় টিভি দর্শক ব্যাপক হারে টেলিভিশন বিমুখ হয়েছে। ইন্টারনেটের প্রসার এবং ওটিটি প্ল্যাটফরমের আধিপত্য কারণে ফেসবুক ইউটিউব নজর বেশি তাই টেলিভিশনে কোথায় কী প্রচারিত হচ্ছে, তার খোঁজ রাখে না দর্শকরা।
বর্তমানে টেলিভিশনের দর্শক হারিয়ে গেছে বলার চেয়ে টেলিভিশন তার দর্শক ধরে রাখতে পারেনি, এটা বলা বেশি যুক্তিযুক্ত। মানুষ এখনো টেলিভিশন দেখতে চায়, বিশেষ করে খবর খুব গুরুত্বপূর্ণ হলে। বিনোদনের জন্য নানা মাধ্যমকেই বেছে নিচ্ছে দর্শকরা। দেশে শুধু নতুন প্রজন্ম নয় এখন বয়োবৃদ্ধ মানুষের কাছেও স্মার্ট ফোন আছে, খবর তারা সেখানেও দেখতে পারে। মানুষ দিন দিন আরো বেশি কর্মব্যস্ত হয়ে পড়ছে, সময় নির্ঘণ্ট বেঁধে টিভির সামনে বসে অনুষ্ঠান দেখা অনেকের পক্ষেই সম্ভব না। ইউটিউব আছে, যখন সুযোগ পাচ্ছে তারা তখন দেখে নিচ্ছে। আগে খবর বা নাটক দেখার একমাত্র উপায় ছিল টেলিভিশন, এখন তো একাধিক বিকল্প। তাছাড়া টেলিভিশনে নাটক দেখা অনেক সময়ের ব্যাপার ছিল, বিজ্ঞাপনের যন্ত্রণা ভোগ করতে হতো। তখনো যদি বিকল্প ব্যবস্থা থাকত, দর্শক নাটক দেখা হয়ত কমিয়ে দিত। সংবাদ ও অনুষ্ঠানের মান দিন দিন কমেছে, কারণ সব কিছু দেখতেন মার্কেটিং বিভাগের লোকেরা। সময়ের চাহিদা অনুযায়ী গল্পের মান বাড়েনি, বাজেট বাড়েনি। সাংস্কৃতিক ও সামাজিক কোনোভাবেই দর্শকের অনুভূতির জায়গা স্পর্শ করতে পারেনি।
টেলিভিশন চ্যানেলগুলো একসময় সম্পূর্ণভাবে চলে গিয়েছিল করপোরেট জগতের হাতে। টেলিভিশনে আবার কিভাবে দর্শক ফিরবে সেটা বলার জন্য বিশেষজ্ঞরা আছেন। তবে আমার মনে হয়, চ্যানেলগুলো একটা নিয়মের মধ্যে থাকলে দর্শকের আগ্রহ বাড়বে। আমাদের চিহ্নিত করতে হবে কোন কোন অনুষ্ঠানে দর্শক আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে।
প্রথমেই আসে সংবাদ এর কথা। দর্শক যদি দেখে চ্যানেলটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর হয়ে কথা বলছে। সত্য প্রকাশ করে না, নিরপেক্ষতা বজায় রাখছে না, চারপাশে যা ঘটছে বা দেখছে তার প্রতিফলন সংবাদে ঘটছে না তখন স্বাভাবিকভাবেই দর্শক সংবাদ দেখা বন্ধ করে দেয়। এখন আসে ফিকশন বা নাটকের কথা। বিশ্বব্যাপী টেলিভিশনে যে ড্রামা বা সিরিয়াল দেখায়, তার থেকে বেরিয়ে এসেছে বাংলাদেশের চ্যানেলগুলো।
ব্যতিক্রম কিছু বাদ দিলে পৃথিবীজুড়ে হালকাবোধের গল্পই বেশি প্রচারিত হয়। এখানে হয়েছে উল্টো, সিনেমা নির্মাণের প্রতিবন্ধকতা থাকায় বেশি গভীর বা জটিল গল্পগুলো প্রচারিত হচ্ছে টিভিতে। আমাদের দেশের নারীরা এ ধরনের গল্প তেমন পছন্দ করেন না, যার কারণে তাঁরা ভারতীয় চ্যানেলের দিকে ঝুঁকে যান। তবে ইউটিউব ফেসবুকের কারণে এখন বিদেশের চ্যানেল থেকে কিছু দর্শক ফিরে আসছে।
এছাড়া এখন টেলিভিশনের বিকল্প আছে অনেক হাতে হাতে মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ। এখানে চাইলে দর্শক নিজের পছন্দমতো যেকোনো দেশের যেকোনো অনুষ্ঠান দেখতে পারে। সেই তুলনায় আমাদের টেলিভিশন চ্যানেল তো শক্ত প্রতিদ্ব›দ্বী নয়। আরেকটি কারণ বলব, টেলিভিশন চ্যানেলের লাইসেন্স মিডিয়া ব্যবসায়ীদের হাতে না গিয়ে রাজনীতিবিদদের হাতে চলে গেছে। লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে রাজনৈতিকভাবে তিনি কোন দলকে পছন্দ করেন তা বিবেচনা করে। যাকে দেওয়া হয়েছে, তার তো টিভি চ্যানেলের উন্নতি নিয়ে কোনো ভাবনা ছিল না। এটা ছিল তার ক্ষমতা দেখানোর জায়গা। তাই আমি মনে করি যে একটি শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে টেলিভিশনের আজ ও সমান প্রভাব রয়েছে। যা পুরো বিশ্বকে আমাদের চোখের সামনে তুলে ধরে। জ্ঞানের প্রসার ঘটায় ও সাংস্কৃতিক ব্যবধান দূর করে।
একইসাথে টেলিভিশনের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায় এটি প্রতিনিয়তই একটা রূপান্তরের মধ্যদিয়ে সামনে এগিয়েছে। যা এখনও সমানভাবে বাস্তব ও সত্য। তাই বলা যায় টেলিভিশনের ভবিষ্যৎ হুমকি নয় আগামী দিনগুলোতে ও নানা পরিবর্তনের মধ্যদিয়ে এটি টিকে থাকবে। তবে এ কথা সত্য যে, টেলিভিশনের প্রথাগত এক রৈখিক মডেল সাম্প্রতিক লাইভ স্ট্রিমিং পরিসেবার মাধ্যমে একটা বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। দর্শকের রুচি ও অভ্যাসের পরিবর্তন হয়েছে। সেক্ষেত্রে টিভির পুরনো ধারণা হ্রাস পেলেও পেতে পারে। তবে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলোতে এর অভিযোজনের ফলে নতুন নতুন উদ্ভাবন ও নানা ধরনের কনটেন্ট তৈরির সুযোগ আরও অবারিত হবে। তবে এই মুহূর্তে পরিসংখ্যান হয়তো ল্যাপটপ ও মোবাইলের জনপ্রিয়তার কথাই বেশি হচ্ছে। কিন্তু পাশাপাশি একথাও সত্য যে কিছু ক্ষেত্রে টেলিভিশন এখনও দর্শকদের প্রথম পছন্দ। যেমন পারিবারিক অনুষ্ঠান দেখার ক্ষেত্রে বা ওটিটি শো বা ক্রিকে বা ফুটবল ম্যাচ দেখার ক্ষেত্রে টিভি এখনো মূল পছন্দ। প্রযুক্তিগত অগ্রগতির সাথে সাথে নতুন নতুন উদ্ভাবনের সমন্বয়, ভোক্তাদের আচরণগত পরিবর্তন ও কনটেন্ট সরবরাহের মডেলগুলোর ওপর ভিত্তি করে প্রথাগত টেলিভিশনকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম।
বর্তমানে প্রায় সবার হাতেই স্মার্টফোন। একই সঙ্গে এই ধরনের সহজে বহনযোগ্য ডিভাইস দেখা যায়। ফলে দর্শক যেখানে খুশি সেখানে বসেই তাদের পছন্দের কনটেন্ট দেখতে পারে। তাছাড়া টিভি যেখানে ঘরের কোণে, মোবাইল বা স্মার্টফোন সেখানে সর্বত্রই বহনযোগ্য। আর এ বিষয়টিই প্রথাগত টিভির চেয়ে ডিজিটাল প্লাটফর্ম এগিয়ে যাচ্ছে সবখানে। এতে করে দর্শক চলে যাচ্ছে ফেসবুক আর ইউটিউব দিকে রাখছে টেলিভিশন হয়ে পড়ছে বাসাবাড়িতে শোপিস মত একটা জিনিস মাত্র। টেলিভিশন মাধ্যমকে টিকিয়ে রাখতে হলে তাই আধুনিক প্রযুক্তি, নতুন অনুষ্ঠান ভাবনা ও যুগের চাহিদা মাথায় রেখে বিবর্তিত হতে হবে।
লেখক: সংবাদকর্মী











