ডা. হাসান শহীদুল আলম
(৩য় পর্ব)
বেগমপাড়া : অনারেবল স্যারদের রেস্টহাউস : বিশালাকার অফিসের কামরা। এসির মৃদু ঝিরঝিরে শব্দ। শীতল বাতাস উপভোগ করছেন অনারেবল স্যার আরাম কেদারায় গা এলিয়ে দিয়ে। গতকাল রাতে সংবাদটা নিশ্চিত করা গেল। কানাডায় ত্রিশ কোটি টাকার বাড়ির মালিক হয়েছেন তিনি। লোকে বলে বেগমপাড়া। বলছে বলুক কিছু আসে যায় না। বেগম সাহেবাকে এখনও বলা হয়নি সংবাদটা। প্রথম রাতের লাজুক চেহারাটা ক্ষণিকের জন্য ভেসে উঠল। বিমানে আরোহনের পূর্ব মুহূর্তে বললেই চলবে। স্যারের ঠোঁটের কোণায় হাসি ফুটেউঠে পরক্ষণেই মিলিয়ে গেল পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাংবাদিক সম্মেলনে দেয়া বক্তব্য মনে পড়ায়- ‘বিগত ১৯শে নভেম্বর ২০২০ পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কেএ মোমিন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘আমাদের সচরাচর ধারনা যে, বেগমপাড়ার বাড়িগুলো হয়তো রাজনীতিবিদরা করেন। কিন্তু সেখানে দেখা গেল এদের অধিক সংখ্যক সরকারী চাকুরী করেন। অবসর নিয়েছেন বা এখনো চাকুরীতে আছেন, তারা বাড়ি কিনেছেন। তাদের ছেলেমেয়েরা সেখানে থাকেন বড় বড় বাড়িতে। কিছু বাড়ি কিনেছেন আমাদেরব্যবসায়ীরা (দ্য ডেইলী স্টার, ২৪-১১-২০)।’ পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুর মোমেন জানিয়েছেন,কানাডায় অর্থ পাচারকারী যে ২৮ জনের তালিকা তার কাছে আছে তারমধ্যে ২৪ জনই সরকারী কর্মকর্তা। বাকিরা রাজনীতিবিদ। সরকারি কর্মকর্তারা এত টাকা কোথায় পেলেন (ডি ডাবলিউ ডট কম, ২৭-১১-২০)?
মান্যবর মন্ত্রীর বক্তব্যের সুত্র ধরে আমাদের আলোচনা চলতে থাকুক।
পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যের পর জানা গেল টাকা পাচারে সরকারি কর্মকর্তারাই এগিয়ে। এতদিন ধারনা ছিল ব্যবসায়ী এবং একশ্রেণীর রাজনীতিবিদ অর্থ পাচার করেন। টাকা পাচারের পথটা চওড়া করেছেন সরকারি কর্মকর্তারা যারা নানা নীতির বাস্তবায়ন করে থাকেন। ঢাকা বা বড় শহরগুলির দিকে তাকালে দেখা যায় জমি, প্লট, ফ্ল্যাটের বেশীর ভাগ মালিক সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এমনকি ড্রাইভার, কেরানী, পিওন, দারোয়ান যে পরিমান অর্থের মালিক তা কল্পনাও করা যায় না। সরকারি কর্মকর্তাদের ঘুষ আর দুর্নীতি বন্ধ করতে তাদের বেতন-ভাতা ও সুবিধাদি আকাশ ছোঁয়া করা হয়েছে। কিন্তু দুর্নীতি বন্ধ হয়নি। কারণ পুরো সিসটেমটাই কব্জা করে নিয়েছে সরকারি আমলাতন্ত্র। আমলাদের জবাবদিহিতা নেই। উল্টো আছে সুরক্ষা। মামলা করতেও অনুমতি লাগবে। তা নাহলে অনারেবল স্যার কেন হলেন ?
বেগমপাড়ায় অনারেবল স্যাররাই সংখ্যাগরিষ্ঠ : নিম্নের সংবাদচিত্রসমূহ দ্রষ্টব্য-
ক) ‘নিউইয়র্ক শহরে বাংলাদেশ মিশনে কর্মরত জনৈক ক‚টনীতিক নগদ অর্থ দিয়ে তিনটি বাড়ি ক্রয় করে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছিলেন (ডেইলী খবর, ৩১-১২-২০)।’
খ) দেশের টাকা পাচার করে যুক্তরাষ্ট্রে বাড়ি কিনেছেন ২৫২ জন আমলা।এদেরমধ্যে ৩০-৪০ জন পুলিশের ওসি রয়েছেন। সরকারের সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তা আছেন এই তালিকায়।আমলাদের অর্ধেকের বেশীর সন্তান বিদেশে লেখাপড়া করে (বিবিসি ডট কম, ০৭-০৯- ২৩)
গ) ‘স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জনৈক কর্মচারী ও তার স্ত্রী শুধু ঘুষ উপহারের টাকায় অষ্ট্রেলিয়ায় সেকেন্ড হোম ও দুবাই এর সারজাহতে থার্ড হোম গড়েছেন।এই দম্পতি অবকাশ যাপনের জন্য সর্বশেষ নেপালে গড়ে তুলেন ফোর্থ হোম। এমন ফোর্থ হোম মালিক বনেছেন আরো বহু বাংলাদেশী আমলাগন (দৈনিক রূপালী সৈকত ডট কম, ০৭-০৭-২৪)।’
ঘ) সুইস ব্যাংকে অনারেবল স্যাররাই শীর্ষে : ‘প্রকাশিত সুইজারল্যান্ডের ন্যাশনাল ব্যাংক বার্ষিক প্রতিবেদনের ডাটা অংশে বাংলাদেশ থেকে টাকা পাঠানোর ভয়াবহ তথ্য এসেছে।প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২১ সালের ডিসেম্বরে সুইজারল্যান্ডে বাংলাদেশি আমানত দাঁড়িয়েছে ৮৭ কোটি ১১ লাখ ফ্রাংক যা বাংলাদেশি টাকায় ৮ হাজার ২৭৫ কোটি টাকা। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, সুইস ব্যাংকে গত এক বছরে যে টাকা পাঠানো হয়েছে তার সিংহভাগই আমলাদের নিয়ন্ত্রনে। বিদেশে অভিবাসন গ্রহন, বাড়ি-গাড়ি ইত্যাদি ক্রয়েও আমলারা শীর্ষে রয়েছেন বলে জানা গেছে। গত এক বছরে অবসর গ্রহণ করা অন্তত পাঁচজন সচিব সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশী টাকায় প্রায় এক হাজার কোটি টাকা জমা দিযেছেন। এরা সবাই প্রভাবশালী সচিব ছিলেন (এডিটর ডট কম, ১৭- ০৬-২২)।’
দেখা যাচ্ছে, বেগমপাড়ায় অনারেবল স্যাররাই সংখ্যাগরিষ্ঠ।
অর্থ পাচার কি ?
বিদেশে টাকা পাঠানোর বৈধ নিয়ম রয়েছে। বাংলাদেশের বাইরে ভ্রমনের সময় একজন ব্যক্তি প্রতি বছর ১২ হাজার ডলার পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারেন। এ ছাড়া শিক্ষা ও চিকিৎসার জন্য নিয়ম মেনে অর্থ নেয়া যায়। তবে বিদেশে সম্পদ কেনার জন্য অর্থ নেয়া নিষিদ্ধ। অর্থ পাচার বলতে বৈধ কর্তৃপক্ষের আনুষ্ঠানিক অনুমতি ছাড়া এক দেশ থেকে অন্য দেশে অর্থ স্থানান্তরকে বুঝায়। এটি একটি দ্বিপাক্ষিক লেনদেন কার্যক্রম।
অর্থ পাচার বলতে কি বুঝায় ?
অর্থ আসলে ক্রয় ক্ষমতার সক্ষমতা। যেমন আমরা বৈধভাবে অর্থ এক দেশ থেকে আরেক দেশে পাঠাচ্ছি। এক শহর থেকে আরেক শহরে পাঠাচ্ছি। কিংবা একজনের কাছ থেকে আরেকজনের কাছে পাঠাচ্ছি। ধরা যাক একজন যুক্তরাজ্যে আছে। এখানে আয় করেন পাউন্ডে। ধরা যাক তিনি ওয়েস্টার্ন ইউনিয়নের কাছে গেলেন। দেশের কাউকে তিনি বললেন, আপনার কাছে ৫০০ পাউন্ড পাঠাচ্ছি। কিন্তু দেশে সে পাচ্ছে টাকা। মানে পাউন্ডটা তার কাছে গেল না। এ থেকে বুঝা গেল যে,অর্থ আসলে নোটের বান্ডিল বা কয়েন নয়।আমি বাংলাদেশে ৫০০ পাউন্ড পাঠাচ্ছি মানে আমি আমার ৫০০ পাউন্ডের ক্রয়ক্ষমতা পরিত্যাগ করলাম।বাংলাদেশে যিনি টাকাটা পাচ্ছেন তার ব্যাংক একাউন্টে ৫০০ পাউন্ডের সমমূল্যের টাকা জমা দিলো ওয়েস্টার্ন ইউনিয়ন। এতে বাংলাদেশের গ্রাহকের ৫০০ পাউন্ডের সমমূল্যের ক্রয়ক্ষমতা বাড়লো। এটা হচ্ছে টাকা পাঠানোর বৈধ পন্থা। এই পন্থায় বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে ৫০০ পাউন্ড এর ক্রয়ক্ষমতা যোগ হলো। এই ক্রয় ক্ষমতা অর্থনীতিতে সার্কুলেট হয়ে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকান্ডকে ত্বরাম্বিত করে। কিন্তু হুন্ডিতে পাউন্ড পাঠালে পাউন্ডটা বাংলাদেশ ব্যাংকে যোগ হয় না। পাউন্ড এর সমমূল্যের টাকা গ্রাহকের কাছে পৌঁছিয়ে দেয়া হয়। এতে যেহেতু বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ বৃদ্ধি ঘটে না তাই এই ৫০০ পাউন্ড সমমূল্যের ক্রয়ক্ষমতা দেশে বেআইনী ভাবে পাচারকৃত হলো। এটাই অর্থ পাচার। এ কারণেই হুন্ডি দেশের অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর।
বাংলাদেশে কালো টাকা কিভাবে গঠিত হয় : ‘২০১৭ সালে বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশে রাস্তা তৈরী ও সংস্কারের ব্যয় বিশ্বেরমধ্যে সর্বোচ্চ। এর অন্যতম কারণ কাজের দীর্ঘসূত্রতা ও দূর্নীতি (মানবজমিন, ০৮-০৫-২৪)।’ ধরা যাক একটি হাইওয়ের নির্মাণব্যয় আমেরিকান স্ট্যান্ডার্ডে ধরলে ৫০০ কোটি টাকা। কিন্তু নির্মাণব্যয় ধরা হলো ২৫০০ কোটি টাকা। অতএব বাড়তি ২০০০ কোটি টাকার সিংহভাগ যাবে প্রকল্প পরিচালক সরকারী কর্মকর্তাগণ ও উপরওয়ালাদেরপকেটে এবং বাকীটা যাবে কন্ট্রাক্টর, সুপারভাইজারদের পকেটে। অবৈধ কার্যকলাপ বা বেআইনী মাধ্যমে অর্জিত আয় যেগুলি ট্যাক্সের উদ্দেশ্যে নিবন্ধিত নয় সেগুলি কালো টাকা। (চলবে)
লেখক: ডায়াবেটিস ও চর্মযৌনরোগে স্নাতকোত্তর
প্রশিক্ষনপ্রাপ্ত চিকিৎসক চট্টগ্রাম