রতন কুমার তুরী
দেশের বেকার সমস্যা সমাধানের বিষয়টি প্রতিটি সরকার বলে আসলেও এ সমস্যার আশু সমাধানের বিষয়টি কোনো সরকারই সেভাবে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে কোনো পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে বলে আমাদের মনে হয়না। যদি তাই হতো তাহলে দেশে কলকারখানার সংখ্যা বছরে বছরে বাড়তো। প্রকৃতপক্ষে যে কোনো দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের প্রধান উপকরণ হচ্ছে জন সম্পদ। বিপুলসংখ্যক বেকার শ্রম শক্তি নিয়ে আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন আশা করা যায় না। বেকারত্ব যে কোন দেশের অন্যতম সামাজিক সমস্যা। বেকারত্ব এমন একটি সমস্যা যা অন্যান্য সামাজিক সমস্যারও জন্মদাতা। বাংলাদেশের পরিকল্পিত অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের অন্যতম মৌলিক অন্তরায় হলো বেকারত্ব। আমাদের দেশে প্রায় দুই মিলিয়ন বেকার। বাংলাদেশের বেকারত্বের কারণ খুঁজে বের করে তা সমাধানের পথ খুঁজতে হবে। বেকারত্ব সমস্যা দূর করতে পারলে দেশের মঙ্গল বেকারত্ব দূরীকরণের উপায়ঃ বাংলাদেশে বেকারত্ব ভয়াবহ সামাজিক সমস্যার রূপ ধারণ করেছে। তাই অচিরেই এ সমস্যা সমাধানের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। বাংলাদেশে বিরাজমান বেকার সমস্যা সমাধান এবং ভবিষ্যৎ বেকারত্ব প্রতিরোধে নিচের পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন-বাংলাদেশে জনসংখ্যা অত্যন্ত বেশি। তাছাড়া এদেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারও বেশি। ফলে দেশে বেকারত্ব বেড়ে যাচ্ছে। তাই বাংলা দেশে বেকারত্ব দূর করতে হলে জনসংখ্যা বৃদ্ধি রোধ করতে হবে। জনসংখ্যা বৃদ্ধি রোধ করার মাধ্যমে বেকারত্ব দূর করা সম্ভব।
শ্রমশক্তি জরিপ পরিচালনা : বেকারত্ব নিরসনের জন্য নীতি, প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রম ও উপর্যুক্ত প্রযুক্তি ব্যবহারের ব্যবহারের দিক নির্দেশনার জন্য বেকারত্বের সার্বিক তথ্য সংগ্রহের গুরুত্ব অপরিসীম। বেকার শ্রমশক্তির শ্রেণি ভিত্তিক তালিকা প্রণয়ন এবং সে অনুযায়ী মানব সম্পদ ও শ্রমের যোগান দেওয়ার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নেয়া প্রয়োজন।
শিল্পায়ন : বাংলাদেশে বেকারত্বের অন্যতম কারণ শিল্পায়নের অভাব। তাই এদেশে বেকারত্ব রোধ করতে হলে দ্রুত শিল্পায়ন করতে হবে। তাছাড়া সরকারি শিল্প কারখানা বন্ধ না করে তা চালু রাখতে হবে।
কৃষিক্ষেত্রে নিয়োগ বৃদ্ধি : বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কাঠামো কৃষিনির্ভর। কৃষি হলো কর্মসংস্থানের প্রধান ঘাত। কৃষিতে নিয়োগ বৃদ্ধি ছাড়া বিপুল সংখ্যক গ্রামীণ উদ্বৃত্ত শ্রমশক্তির কর্মসংস্থান সম্ভব নয়।
চুক্তি ভিত্তিক নিয়োগ বাতিল : বাংলাদেশে চুক্তি ভিত্তিক নিয়োগের কারণে বেকারত্ব বাড়ে। তাই বেকারত্ব রোধ করতে হলে চুক্তি ভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করতে হবে। পাশাপাশি নতুন নিয়োগ দান করতে হবে।
শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কার : আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা “Job Oriented” নয়। বরং Degree Oriented” এর প্রভাবে বাংলাদেশে সাধারণ শিক্ষিত বেকারের হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। যে শিক্ষা বেকারত্ব বৃদ্ধির সহায়ক, সে শিক্ষা বাস্তব উপযোগী হতে পারে না। প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্তে উৎপাদন ও বাস্তবমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তনের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। তা না হলে বেকারত্ব পরিস্থিতির মৌলিক পরিবর্তন আনা সম্ভব নয়।
শূন্যপদ পূরণ : বাংলাদেশে সরকারি চাকরিতে অনেক পদ শূন্য রয়েছে। দীর্ঘদিন শূন্য থাকলেও এসব পদে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে না। ফলে দেশে বেকারত্বের সংখ্যাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই অচিরেই সরকারি চাকরিতে শূন্যপদ পূরণ করতে হবে যার ফলে বেকার কর্মহীন মৌসুমে গ্রামীণ পূর্ত কাজ বাস্তবায়ন : গ্রামীণ অব কাঠামো নির্মাণ যেমন- খাল, খনন, রাস্তাঘাট নির্মাণ, বাঁধ দেয়া, কাজের বিনিময় খাদ্য কার্যক্রম, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগের কার্যক্রম ইত্যাদি কর্মহীন মৌসুমে বাস্তবায়ন। এতে কৃষিখাতের মৌসুমী বেকারত্ব অনেকাংশে হ্রাস করা যায়।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষার প্রসার : বাংলাদেশে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষার অভাবে বেকারত্ব বাড়ছে। দেশে মেধাবী ছাত্র ছাত্রীদের জন্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষার ব্যবস্থা করলে শিক্ষা শেষে আর বেকার থাকবে না। তাহলে বেকারত্ব দূর হবে।
বিদেশে শ্রমশক্তি নিয়োগ বৃদ্ধি : বাংলাদেশে কর্মসংস্থানের সম্ভাবনাময় খাত হলো বিদেশে শ্রম শক্তি নিয়োগ। সুষ্ঠু পরিকল্পনা এবং কার্যকর নীতিমালার অধীনে বিদেশে জনশক্তি রপ্তানির মাধ্যমে বিপুল সংখ্যক কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি করা সম্ভব।
শিক্ষার আধুনিকায়ন : বাংলাদেশের ব্রিটিশদের প্রণীত শিক্ষা ব্যবস্থা এখনো প্রচলিত। অথচ যুগ পাল্টাচ্ছে, পাল্টাচ্ছে শিক্ষার ধরন। শিক্ষা ব্যবস্থায় সংস্কার সাধন করে তার আধুনিকায়ন হবে। শিক্ষার আধুনিকায়ন করতে পারলে বেকারত্ব দূর হবে।
বেসরকারি সংস্থাসমূহের কার্যক্রম জোরদার : বাংলাদেশে প্রণীত বিরাজমান আর্থিক অবস্থায় বর্ধিত শ্রমশক্তির একটা ক্ষুদ্র অংশের জন্যও আনুষ্ঠানিক বেতন ভিত্তিক কর্মসংস্থান সম্ভব নয়। বিধায় গ্রামীণ কৃষিবহির্ভূত আত্মকর্মসংস্থানের প্রয়োজন। বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থাগুলোকে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে নিয়োজিত করা গেলে, বাংলাদেশের বেকার সমস্যা অনেকাংশে হ্রাস পাবে।
কারিগরি শিক্ষার প্রসার : কারিগরি জ্ঞানের অভাবেও বাংলাদেশে বেকারত্ব দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই বাংলাদেশের বেকারত্ব দূর করতে হলে কারিগরি শিক্ষার প্রসার ঘটাতে হবে।
নারীর ক্ষমতায়ন : বাংলাদেশের জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক নারী। কিন্তু নারীর ক্ষমতায়নের অভাবে তারা বেকার থাকছে। উচ্চ শিক্ষিত নারীরাও বেকার থাকে। তাই নারীদের বেকারত্ব দূরীকরণের জন্য নারীর ক্ষমতায়ন জরুরি।
স্বকর্মসংস্থান সৃষ্টি : স্বকর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে বাংলাদেশে বেকারত্ব রোধ করা যায়। হাঁস-মুরগি পালন, গাড়ি পালন, নার্সারী, মাছ চাষ ইত্যাদির মাধ্যমে বাংলাদেশের বেকারত্ব রোধ করা যায়। সরকারকে এ ব্যাপারে সাহায্য করতে হবে।
রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা : বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে বেকারত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই বেকারত্ব দূর করতে হলে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও রাজনৈতিক সহনশীলতা আনয়ন করতে হবে।
সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা : সরকার যদি বেকারত্ব দূর করার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করে, তাহলে বেকারত্ব দূর করা সম্ভব হবে। আর এজন্য প্রয়োজন সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা।
প্রকৃতপক্ষে সরকারি এবং বেসরকারি ভাবে বেকারত্ব সমস্যা সমাধানের জন্য বড়বড় উদ্যেগ গ্রহণ না করলে দেশের বেকার সমস্যার স্থায়ী কোনো সমাধান প্রত্যাশা করা যায়না। তাই আমরা প্রত্যাশা করবো দেশের এ বিপুল সংখ্যক বেকারের কর্মসংস্থানের জন্য বিভিন্ন দেশি বিদেশি কোম্পানি এগিয়ে আসবেন এবং সরকার তাদের এ পথ সুগম করে দেবেন।
লেখক : কলেজ শিক্ষক, প্রাবন্ধিক