বৃক্ষ নিধনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ জরুরি

1

চট্টগ্রামের সবুজ পাহাড় ও নদীর সংযোগে যে কয়টি উপজেলা অনন্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লিলাভূমি হিসেবে পরিচিত এর মধ্যে রাঙ্গুনিয়া অন্যতম। কর্ণফুলীর কোলঘেঁষে কোদালা, ওয়াগ্যাছড়িসহ অসংখ্য পাহাড়ের পাদদেশে গড়ে উঠেছে রাঙ্গুনীয়া উপজেলা। প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর এ উপজেলায় রয়েছে দেশের প্রথম এবং প্রধান পেপার মিল। আছে তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র, পানি শোধনাগারসহ বিস্তৃর্ণ সবুজ অভায়রণ্য-ইকো পার্ক। কিন্তু দুর্ভাগ্য এ এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় চলছে পাহাড় নিধন ও সবুজ বৃক্ষ কেটে অবৈধভাবে বিক্রির উৎসব। ৫ আগস্টের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে পর এ এলাকার মানুষ কিছুটা স্বস্তিবোধ করেছিলেন, অন্ততপক্ষে প্রভাবশালীদের কবল থেকে এ এলাকার ভূমি ও প্রকৃতি রক্ষা পাবে। কিন্তু অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, বিষাক্ত সাপের খোলস পাল্টেছে মাত্র, সাপ ঠিকই রয়ে গেছে। গতকাল রবিবার দৈনিক পূর্বদেশে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে অনুমান করা যায়, সশস্ত্র ডাকাতের দল এবার জনপদ ছেড়ে প্রকৃতির সবুজ বৃক্ষ নিধনে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। সংবাদের ভাষ্য অনুযায়ী রীতিমত ত্রাস সৃষ্টি করে ডাকাত দল শতবর্ষী ২৪টি সেগুন গাছ কেটে নিয়ে লাপাত্তা। সূত্র মতে, রাঙ্গুনিয়ায় বনকর্মীদের অস্ত্রের মুখে সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা জিম্মি করে প্রায় শতবর্ষী ২৪টি সেগুন গাছ কেটে নিয়ে গেছে দুর্বৃত্তরা। কেটে নেওয়া গাছের আনুমানিক বাজারমূল্য ২০ লাখ টাকা। বৃহস্পতিবার দিনগত রাতে উপজেলার হোসনাবাদ ইউনিয়নের নিশ্চিন্তপুর এলাকা সংলগ্ন কোদালা বিটে এ ঘটনা ঘটে। কোদালা বিট কর্মকর্তা খোন্দকার মাহবুব পূর্বদেশকে জানান, বৃহস্পতিবার রাত ১২টার দিকে টহল শেষে চন্দ্রঘোনা এভিয়ারি পার্কের সামনে ছয় বনকর্মী নিয়ে অবস্থান করছিলেন তিনি। এসময় হঠাৎ দুই রাউন্ড গুলির শব্দ শুনে সবাইকে নিয়ে পার্কের ভেতরে প্রবেশ করেন। সঙ্গে সঙ্গে ৪০-৫০ জন মুখোশধারী দুর্বৃত্ত আগ্নেয়াস্ত্র ও ধারালো দেশীয় অস্ত্র হাতে পার্ক ঘিরে ফেলে সবাইকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে মোবাইল ফোন কেড়ে নিয়ে বন্ধ করে দেয়। এ সময় ১০ রাউন্ড ফাঁকা গুলি ছুঁড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে দেয়। এরপর বিট সংলগ্ন বিভিন্ন জায়গা থেকে প্রায় ২৪টি সেগুন গাছ কেটে নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। রাত সাড়ে ১২টা থেকে ভোর ৫টা পর্যন্ত কয়েকটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে তারা অত্যাধুনিক কাটার দিয়ে গাছগুলো কাটে। এরপর তাদের সঙ্গে আনা গাড়িতে করে এসব নিয়ে যায়। দুর্বৃত্তরা বনকর্মীদের গায়েও হাত তোলে। রাঙ্গুনিয়া উপজেলা রেঞ্জ কর্মকর্তা মেহেদী হাসান মানিক জানান, দেশের পট পরিবর্তনের পর থেকে ইতিপূর্বে একাধিকবার এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে। গাছগুলো ১৯৫২ সালে লাগানো প্রায় শতবর্ষী গাছ। এই ধরনের পুরাতন গাছ খুবই বিরল এবং দেশের জন্য মূল্যবান সম্পদ।এ ব্যাপারে রাঙ্গুনিয়া মডেল থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়েছে এবং ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানানো হয়েছে। এছাড়া বন আদালতে মামলার প্রস্তুতি চলছে। রাঙ্গুনিয়া থানার পরিদর্শক (তদন্ত) সুজন হাওলাদার বলেন, এ বিষয়ে জিডি নেওয়া হয়েছে এবং জড়িতদের চিহ্নিত করাসহ আইনি প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। আমরা আশা করি, আইনি প্রক্রিয়া সঠিকপথে এগুবে এবং বৃক্ষদস্যুদের গ্রেফতার করে উপযুক্ত শাস্তি নিশ্চিত করবে। বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, আমাদের দেশে যে হারে প্রাকৃতিক পরিবেশ ধ্বংস করা হয়, পৃথিবীর আর কোন দেশে এমনটি ঘটে কিনা সন্দেহ। পাহাড় ও বৃক্ষ নিধনে এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম প্রধান। এমনিতে দেশে ক্রমবর্ধমান হারে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে বাড়ছে তাপমাত্রা। ঋতুবৈচিত্র্য হারিয়ে যেতে বসেছে। ঠিক নেই শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষার। কখনও অতিবৃষ্টি, কখনও তাপদাহ, কখনও বন্যা সারাবছর প্রকৃতির বিরূপ আচরণে বিপর্যস্ত জনজীবন। নির্বিচারে সবুজ প্রকৃতি ধ্বংস করে মানুষ জলবায়ু পরিবর্তনের আগুনে যেন ঘি ঢালছে। নির্বিচারে বন নিধনের ফলে নানা জাতের উদ্ভিদ ও পশু-পাখি বিলুপ্তির পথে। শিয়াল, বেজি, খরগোশ, কাঠবিড়ালি, বানর, হনুমান, চিল, শকুন, ডাহুক, বাবুই, চড়ুই আগের মতো আর দেখা যায় না। বিগত সরকারের নানা খাতে অনিয়ম-দুর্নীতি এবং দখল বাণিজ্যের কালোছায়া পড়েছিল বনভূমিতেও। গত বছরের জুলাইয়ে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন আয়োজিত জলবায়ু, পরিবেশ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিষয়ক থিমেটিক কমিটির সভায় জানানো হয়, দেশের ২ লাখ ৫৭ হাজার ১৫৮ দশমিক ৮৪ একর বনের জমি বেদখল হয়ে আছে। ফলে দেশের বনাঞ্চল দিন দিন সংকুচিত হয়ে আসছে। এর মধ্যে ১ লাখ ৩৮ হাজার ৬১৩ একর সংরক্ষিত বনের জমি। ইতোমধ্যে ৮৮ হাজার ২১৫ জন সংরক্ষিত বনভূমির দখলদার চিহ্নিত। বনের এসব জমি দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে শিল্পকারখানা, রিসোর্ট ও বসতভিটা। যেখানে দেশে পরিবেশ-প্রতিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় অন্তত ২৫ শতাংশ বনভূমি থাকা প্রয়োজন, সেখানে বাংলাদেশে আছে সম্ভবত তার এক-তৃতীয়াংশ। যে হারে বনভূমি দখল হচ্ছে, তাতে বন বলে কিছু থাকবে কিনা সন্দেহ করার অবকাশ যথেষ্ট।
বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার পরিবেশ রক্ষায় নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। দখলদারদের কাছ থেকে বনভূমি উদ্ধারে বর্তমান সরকার ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণ করবে বলে আমরা বিশ্বাস করি। আশা করব, শুধু নামকাওয়াস্তে মামলা নয়; দখলকৃত বনভূমি উদ্ধারে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে।