বীর মুক্তিযোদ্ধা রবিউল হোসেন কচি : চট্টগ্রাম, নোয়াখালী সবখানে তিনি নেতা

1

নাসিরুদ্দিন চৌধুরী

মিষ্টি হাসিমাখা মায়াবি মুখাবয়বের অধিকারী রবিউল হোসেন ছিলেন ষাটের দশকের চট্টগ্রামের ছাত্র রাজনীতির একজন প্রিয়ভাজন নেতা। ষাটের শেষভাগে উদ্ভূত হয়ে তিনি নিজের জন্য আলাদা আসন করে নিয়েছিলেন জ্বলন্ত সময়ে। রবিউল হোসেন কচিরা সেই জাতের নেতা, নেতৃত্বের ওপর থাকে যাঁদের সহজাত অধিকার। তারা ব্যাক বেঞ্চার নন; পরে এন্ট্রি নিলেও তারা সামনে চলে আসেন নেতৃত্বের সারিতে। পাকিস্তানি রাজনীতির শেষ দশকটিতে বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা দাবি থেকে বাঙালি জাতীয়তাবাদের চূড়ান্ত বিস্ফোরণ ঘটেছিল। স্বায়ত্ত¡শসন, স্বাধিকার ইত্যাদি কথকতার স্তর পেরিয়ে স্বাধীনতা তখন নবজাগ্রত বাঙালি জাতিসত্তার দৃষ্টিসীমার মধ্যে প্রতিভাত হচ্ছিলো। বাঙালি ও পাঞ্জাবি অধ্যুষিত পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী চ‚ড়ান্ত শক্তি পরীক্ষার জন্য তৈরি হচ্ছিলো। তখন অনেক ঘটনা ঘটে যায়– ৬ দফা আন্দোলন, বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ এনে আগরতলা মামলা দায়ের করা হলে তা বাতিলের জন্য অবিলম্বে উত্থাপিত দাবিও ৬ দফার সঙ্গে যুক্ত হয়ে আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ করে। অতঃপর ৬ দফার সঙ্গে সমন্বিত করে ছাত্ররা ১১ দফা দাবি নিয়ে রাজপথে নেমে আসলে দেশে যে অভূতপূর্ব জনবিস্ফোরণ ঘটে, সেই জনতরঙ্গ রোধ করার শক্তি আইয়ুব-মোনায়েমের ছিল না। অতঃপর ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে আইয়ুবের পতন ঘটলে বঙ্গবন্ধুসহ রাজবন্দিরা মুক্ত হয়ে বের হয়ে আসেন। তারপর তো ’৭০-এর নির্বাচনে ভূমিধস বিজয় অর্জন করে আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের রাষ্ট্র ক্ষমতার দাবিদার হয় এবং সেটা না দিয়ে ইয়াহিয়া খান গণহত্যা আরম্ভ করলে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণায় মুক্তিযুদ্ধের সূচনা হয়। ’৬৭ থেকে ’৬৯ অব্দি ধারাবাহিক আন্দোলনের অগ্নি পরীক্ষায় রবিউল হোসেন কচির নেতৃত্বের পরীক্ষা ঘটে এবং তিনি চট্টগ্রামের একজন মেধাবী সৃজনশীল ও প্রতিশ্রুতিবান নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন।
বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ, মুক্তিযোদ্ধা ও নোয়াখালী পৌরসভার সাবেক চেয়ারম্যান রবিউল হোসেন কচি ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দেরনভেম্বর মাসের শেষদিকে তাঁর পিতার কর্মস্থল সৈয়দপুরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈতৃক নিবাস নোয়াখালী জেলার সদর থানার কালিতারা গ্রামে। পিতার নাম মরহুম মোহাম্মদ ইউসুফ মিয়া। তিনি রেলওয়ে বিভাগের কর্মকর্তা ছিলেন। কচির জন্মের এক বছর পরেই তাঁর পিতা ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে বদলি হয়ে চট্টগ্রামে আসেন।এক বছর বয়সে শিশু কচির বেড়ে ওঠা এবং লেখাপড়া সবই চট্টগ্রামেই হয়। দীর্ঘ একযুগেরও বেশি রবিউল হোসেন কচির পরিবার চট্টগ্রামের রেলওয়ে হাসপাতাল কলোনীতে কাটান। তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু হয় বাসার কাছাকাছি একটি প্রাইমারি স্কুলে। তারপর ভর্তি হন সরকারি মুসলিম হাই স্কুলে। ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দে মুসলিম হাই স্কুল থেকে এস,এস,সি পাস করে ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজে (বর্তমানে হাজি মহসিন কলেজ) ভর্তি হন। ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজ থেকে আই,এ পাস করার পর চট্টগ্রাম কলেজে বি,এ ক্লাসে ভর্তি হন। ৭১-এ মুক্তিযুদ্ধ করে বিজয়ীর বেশে দেশে ফিরে আবার চট্টগ্রাম কলেজে ছাত্র জীবনে ফিরে যানএবং ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে বি,এ পাস করেন। রবিউল হোসেন কচি সংস্কৃতি মনোভাবাপন্ন ছিলেন। স্কুলে অধ্যয়নকালেইতিনি বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের সঙ্গে যুক্ত হন।
বীর মুক্তিযোদ্ধা ও ৬০ দশকের ছাত্রনেতা অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ গোফরানুল হক, রেজাউল হক মুশতাক, রায়হান ফিরদাউস মধু, শমসের আলী, মোছলেম উদ্দিন, আনিসুর রহমান খান, ডা. শামসুদ্দিন, মহসিন খান স্কুলে তাঁর সহপাঠী ছিলেন। ৬৬ থেকে ৬৯ আন্দোলনের সময়; ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গবন্ধু ছয় দফা কর্মসূচি ঘোষণা করার পর তার ভিত্তিতে বাংলাদেশে তুমুল আন্দোলন গড়ে উঠেছিল। শিক্ষাঙ্গনও সেই আন্দোলনের আঁচে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল। চট্টগ্রাম শহরের স্কুলগুলির মধ্যে মুসলিম হাই স্কুলের ছাত্ররাই রাজনীতিতে অগ্রণী ছিল। এম.এ মান্নান, আবদুর রউফ খালেদ, কফিল উদ্দিন, শায়েস্তা খান, মোহাম্মদ ইব্রাহিম, নুরুল আলম চৌধুরী, ইদ্রিস আলম, সাইফুদ্দিন খালেদ চৌধুরী, আবদুর রব (চাকসু’র ১ম জিএস এবং মুক্তিযুদ্ধে শহীদ), সালাউদ্দিন মাহমুদ, আবদুল্লাহ হারুন প্রমুখ পরবর্তীকালে চট্টগ্রামের প্রখ্যাত ছাত্রলীগ নেতাগণ মুসলিম হাইস্কুল থেকেই আবির্ভূত হন। এই ধারায় রবিউল হোসেন কচি, অধ্যাপক ডা. গোফরানুল হক, শমসের আলী, মোছলেম উদ্দিন, আনিসুর রহমান খান, ডা. শামসুদ্দিন, মহসিন খান, রেজাউল হক মুশতাক ছয় দফা ভিত্তিক বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। ধীরে ধীরে তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও সাংগঠনিক ক্ষমতা বলে কচি নিজেকে একজন সৎ ও ত্যাগী ছাত্রলীগ নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন। কচি যখন ইন্টামিডিয়েট কলেজে ভর্তি হন, সেখানেও দু’জন বিশিষ্ট ছাত্রনেতার সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা ও বন্ধুত্ব গড়ে ওঠতে সময় লাগেনি, এই দুই বন্ধু হলেন – ওসমান গণি খান ও জাফরুল আলম খান।তারাও প্রথম বর্ষে ভর্তি হন। ইন্টারমিডিয়েট কলেজে পড়লেও চট্টগ্রাম ছাত্র সংসদ নির্বাচনে মিছিল, মিটিং ও বাড়ি বাড়ি গিয়ে কর্মী সংগ্রহে চট্টগ্রাম কলেজের ছাত্রনেতাদের সঙ্গে থাকতেন কচি ও তাঁর বন্ধুরা। ১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ছাত্রলীগের পূর্ণ প্যানেলে বিজয়ের পিছনে রবিউল হোসেন কচি, ওসমান গণি খান ও জাফরদের ভূমিকাও কম ছিল না।
১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দে ইন্টারমিডিয়েট কলেজে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের শাখা গঠন করা হয়। যাঁরা ছাত্রলীগের শাখা গঠনে নেতৃত্ব দেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন রবিউল হোসেন কচি। আরও যারা ছিলেন তারা হচ্ছেন – ওসমান গণি খান, শেখ আহমদ, আনসার আলী, শামসুজ্জামান বাবলু, জামাল উদ্দিন, রেজাউল করিম, মাহবুবুল হক, মোহাম্মদ হোসেন ও ডা. আফছারুল আমীন (সাবেক মন্ত্রী ও এমপি)। সবাই ১ম বর্ষের ছাত্র, কলেজে ভর্তি হয়ে তাঁরা একটি সশস্ত্র বিপ্লবী কর্মকান্ডের সূচনা করেছিলেন। তারা স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র সংগ্রামের পরিকল্পনা করেছিলেন। সেটা ফাঁস হয়ে গেলে ওসমান গণি খান, জাফরুল আলম খান, হারুনুর রশীদ ও খোকন এই চারজন ছাত্রকে আসামী করে তাদের বিরুদ্ধে ‘স্বাধীন সোনার বাংলা ষড়যন্ত্র মামলা’ দায়ের করে গ্রেফতার করা হয়েছিল। ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন কচি এবং ডিগ্রিতে ভর্তি হন চট্টগ্রাম সরকারি কলেজে এবং তাঁর মুসলিম হাই স্কুলের বন্ধু ও সতীর্থ ডা. গোফরানুল হককে আবার সহপাঠী হিসেবে পান। সেখানে কচি আরও বেশি রাজনৈতিক কর্মকান্ডের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে “পাকিস্তান: দেশ ও কৃষ্টি” বই বাতিলের জন্য দেশব্যাপী আন্দোলন শুরু হলে চট্টগ্রামে সেই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন রবিউল হোসেন কচি।
এ সময় মিছিলে শ্লোগান দেওয়া, পোষ্টার-ব্যানার লেখা ও লাগানো, চিকামারা ইত্যাদি কর্মকান্ডে ওৎপ্রোতভাবে অংশগ্রহণের মাধ্যমে চট্টগ্রামের রাজনীতিতে একটি সংগ্রামী মুখের আবির্ভাব ঘটেছিল, যার নাম রবিউল হোসেন কচি। ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দের প্রথম দিকে নিউমার্কেট মোড়ে মিছিল হতে কচিসহ ১৪ জন গ্রেফতার হন, তার মধ্যে অন্যতম ছিলেন দেওয়ান মাকসুদ আহমদ। মিছিলকারীরা জলসা সিনেমায় আগুন দেয়। চট্টগ্রাম কলেজে রবিউল হোসেন কচি যাদের সঙ্গে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে নিয়োজিত থাকতেন, তাদের মধ্যে –শওকত হাফিজ খান রুশ্নি, এ.বি.এম. নিজামুল হক, জালালউদ্দিন আহমেদ, কাজী মনিরুজ্জামান মন্টু, ডা. গোফরানুল হক, কাজী আরিফ (পরবর্তীকালে দেশের প্রখ্যাত আবৃত্তিকার ও স্থপতি), শাহ আলম নিপু, আবদুল্লা আল রায়হান, ফয়েজুল মতিন প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে চট্টগ্রাম শহরের বিভিন্ন অঞ্চলের সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে যারা জড়িত ছিলেন, তারা হলেন – হেনা ইসলাম, হাসান শহীদ, রবিউল হোসেন কচি, মোস্তফা ইকবাল, কাজী আরিফ, সন্তোষ ধর, দেওয়ান মাকসুদ, প্রদীপ খাস্তগীর, আখতারুজ্জামান (পরবর্তীকালে ডাকসুর জিএস ও এমপি), কাজল দেবনাথ, শফিউল আলম ববি, অশোক দাশ প্রমুখ।
১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে ছাত্রলীগের উদ্যোগে প্রথম পহেলা বৈশাখের মিছিল বের করা হয়। এই মিছিলে এ.বি.এম. মহিউদ্দিন চৌধুরী, কাজী ইনামুল হক দানু, হেনা ইসলাম, হাসান শহীদ, রবিউল হোসেন কচি, নঈমউদ্দীন চৌধুরী (পরবর্তীকালে মহানগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি), দেওয়ান মাকসুদ, প্রদীপ খাস্তগীর, আশরাফুল আলম, জয়নাল আবেদীন, কাজল দেবনাথ, সন্তোষ ধর, মোস্তফা ইকবাল, মোহাম্মদ খালেকুজ্জামান খোকন (পরবর্তীকালে মহানগর আওয়ামী লীগের বিশিষ্ট নেতা), মোহাম্মদ ইউসুফ, সাইফুদ্দিন খালেদ চৌধুরী প্রমুখ অংশ নেন।
৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ী হলে বাঙালি বিদ্বেষী পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী বাঙালি নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বাঙালির দল আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে ভেবে সংসদের অধিবেশন আহবান না করে গড়িমসি করতে থাকে। তখন আওয়ামী লীগের চাপে ৭১-এর ৩ মার্চ ঢাকায় পাকিস্তান পরিষদের অধিবেশন ডেকেও পহেলা মার্চ রেডিওতে এক আকস্মিক ঘোষণায় অধিবেশন স্থগিত করে দেন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান। এতে সমগ্র বাংলাদেশ বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে এবং ইয়াহিয়ার ষড়যন্ত্র রুখে দাঁড়ানোর জন্য ঐক্যবদ্ধ হয়। ১ মার্চ পাকিস্তানের শাসন অকার্যকর হয়ে যায় পূর্ব পাকিস্তানে এবং বঙ্গভবন ও ক্যান্টনমেন্ট ছাড়া সবখান থেকে পাকিস্তানের পতাকা নামিয়ে ফেলা হয়। ২ মার্চ ডাকসু ও স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় (বর্তমানে যেখানে অপরাজেয় বাংলা ভাস্কর্য স্থাপিত আছে, সেই স্থান) স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন করেন ডাকসুর ভিপি আ.স.ম আবদুর রব। পরদিন ৩ মার্চ পল্টন ময়দানে স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করেন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান সিরাজ। এরপর ঘোষণা দেওয়া হয় বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে (স্বাধীনতার পর এই ময়দানকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান নামকরণ করা হয়) জাতির উদ্দেশ্যে দিক নির্দেশনামূলক ভাষণ প্রদান করবেন। সারা বাংলাদেশ থেকে বাঙালিরা ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে সমবেত হয়। বঙ্গবন্ধু তাঁর বজ্রকণ্ঠে প্রদত্ত ঐতিহাসিক ভাষণে অসহযোগ আন্দোলনের আহবান জানিয়ে প্রকারান্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। বঙ্গবন্ধুর ঘোষণায় সমগ্র বাংলাদেশে তুমুল উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়। সমগ্র বাংলাদেশে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে ওঠে এবং বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ অনুযায়ী রাস্তাঘাট কেটে, ব্যারিকেড সৃষ্টি করে সমগ্র দেশ অচল করে দেওয়া হয়।
১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ১৫ মার্চ লালদীঘির ময়দানে শিল্পী-সাহিত্যিক-সংস্কৃতি সেবী প্রতিরোধ সংঘ চট্টগ্রাম এর সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এই সমাবেশ আয়োজন ও ব্যবস্থাপনার মূল দায়িত্ব পালন করেন তৎকালীন চাকসু সাধারণ সম্পাদক শহীদ আবদুর রব। তাঁকে সর্বাঙ্গীন সহযোগিতা প্রদান করেন রবিউল হোসেন কচি।অধ্যাপক আবুল ফজল, অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান, ড. এ. আর. মল্লিক, ড. আনিসুজ্জামান, ডাঃ কামাল-এ-খান, অধ্যাপক মমতাজউদ্দিন আহমেদ, সৈয়দ মোহাম্মদ শফি, তাহের সোবহান, মাহাবুব হাসান, সি.এম. রোজারিও, রশীদ চৌধুরী, মাহমুদ শাহ কোরাইশী, ছবিহ উল আলমসহ বুদ্ধিজীবী, শিল্পী নাট্যকর্মী ও সংস্কৃতি কর্মীরা উক্ত সমাবেশে অংশগ্রহণ করেন।
২৫ মার্চ ইয়াহিয়া খান বাংলাদেশে গণহত্যার উদ্দেশ্যে ট্যাংক, বুলডোজার, রি-কয়েললেস রাইফেল, মেশিনগান ও সাজোয়া যান নিয়ে ঘুমন্ত বাঙালি জাতির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লে বঙ্গবন্ধু আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং বাঙালি জাতিকে পাকিস্তানের হানাদারদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে মাতৃভূমি থেকে দখলদার বাহিনীকে নির্মূল না করা পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন। রবিউল হোসেন কচি এ সময় যত আন্দোলন-সংগ্রাম হয়েছে, চট্টগ্রাম কলেজের ছাত্রনেতাদের সাথে সমস্ত আন্দোলনকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য যথাযোগ্য ভূমিকা পালন করেন।
২৬ মার্চ মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার কয়েকদিনের মধ্যে এস.এম ইউসুফ, গোলাম রব্বান, জালাল উদ্দিন, কাজী মনিরুজ্জামান মন্টু ও শওকত হাফিজ খান রুশ্নি প্রমুখ ছাত্রলীগ নেতা ভারতে যাওয়ার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়ে দু-একদিন ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ছিলেন। তাদের সঙ্গে রবিউল হোসেন কচিও ছিলেন। পরে তারা রামগড়ে চলে যান। সেখানে ডা. মাহফুজুর রহমান এবং ডা. গোফরানুল হকের সঙ্গে কচির সাক্ষাৎ হয়। ২ মে রামগড়ের পতন ঘটার পূর্বেই তাঁরা ফেরী নদী পার হয়ে ভারতে যান এবং ত্রিপুরা রাজ্যের হরিণা নামক স্থানে যুব শিবির স্থাপন করে সেখানে থাকা শুরু করেন।
মে মাসের শেষ ভাগে বি.এল.এফ. এর ১ম ব্যাচের সদস্য হিসাবে প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য রবিউল হোসেন কচি চলে যান শিলিগুড়ি, জলপাইগুড়ি হয়ে শাহারানপুর বিমান বন্দর দিয়ে দেরাদুনের জঙ্গলে। আগরতলা শ্রীধর ভিলায় শেখ ফজলুল হক মণি সকাল বেলা তাদের প্রাথমিক ব্রিফিং দেন। রবিউল হোসেন কচি ও ডা. গোফরানুল হক পাশাপাশি বসেছিলেন।আসম আবদুর রব, আবদুল কুদ্দুস মাখন, এম. এ. মান্নান(মাননীয় প্রাক্তন মন্ত্রী), এস, এম ইউসুফ ও সাবের আহমদ আজগরী প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। তারা সবাই মিলে সকাল ১০ টায় তাদেরকে আগরতলা বিমান বন্দরে ভারতীয় বিমান বাহিনীর পরিবহন বিমানে উঠিয়ে দেন। আগরতলা থেকে বিমানে বাগডোগরা (শিলিগুড়ি) বিমান বন্দরে নামেন এবং কয়েকদিন জলপাইগুড়ি অবস্থান করেন। সেখান থেকে দেরাদুনের জঙ্গলে পৌঁছেনরাত প্রায় ৮টায়। অবাঙালি ভারতীয় সেনা কর্মকর্তা কর্নেল পুরকায়স্থতাঁদের উদ্দেশ্যে সুন্দর বাংলায় বক্তৃতা দেন।নুরে আলম জিকু ছিলেন তাদের ক্যাম্প কমাÐার। রবিউল হোসেন কচি দেরাদুনে চট্টগ্রামের যেসব ছাত্রনেতার সঙ্গে ট্রেনিং নেন, তাঁরা হলেন –ডাঃ মাহফুজুর রহমান, ইঞ্জিনিয়ার ইরফানুল হক, আই. ই. ম. জাকারিয়া চৌধুরী, ইঞ্জিনিয়ার ইউসুফ সালাউদ্দিন, নুরুল আলম (প্রাক্তন এডিশনাল আইজি), কাজী ইনামুল হক দানু, ইঞ্জিনিয়ার আবদুল্লাহ আল হারুন, আনোয়ারুল ইকবাল (প্রাক্তন উপদেষ্টা), মোয়াজ উদ্দিন আহমদ, শওকত হাফিজ খান (রুশ্নি), শহীদ নাজিম উদ্দিন খান (রাউজান), মঞ্জুর মোর্শেদ, ডাঃ এবিএম জাফর উল্লাহ, ডাঃ মাহবুবুল আলম, প্রফেসর আহম্মেদ আমীন, ডা. গোফরানুল হক, শাহাব উদ্দীন আহমদ (মিরসরাই), মোহাম্মদ কামরুল ইসলাম (আনোয়ারুল ইকবালের ছোট ভাই), ফয়েজুর রহমান (ডা. মাহফুজুর রহমানের ছোট ভাই), জাফর উল্লাহ খান (কৃষিবিদ), বোরহান উদ্দিন, ডাঃ জাহাঙ্গীর কবির প্রমুখ। তাঁরা ৭ দিন দেরাদুনের পাহাড়ের ঢালুর তাঁবুতে ছিলেন। কচি আর ডা. গোফরান একই তাঁবুতে থাকতেন, একসঙ্গে খেতেন এবং প্রশিক্ষণের মাঠেও ছিলেন একে অপরের সাথী। সাতদিন দেরাদুনের পাহাড়ে কাটানোর পরে জুনের ১ম সপ্তাহে আগত বর্ষা ও সাপের উৎপাতের কারণে তাদেরকে ভারতের আরেক সেনা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র চাকরাতার তান্ডুয়া প্রশিক্ষণ শিবিরে নিয়ে যাওয়া হয়। তান্ডুয়ার ব্যারাকগুলো অনেক ভাল মানের ছিল।
(বাকী অংশ আগামীকাল)
লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক