বীর মুক্তিযোদ্ধা রবিউল হোসেন কচি : চট্টগ্রাম, নোয়াখালী সবখানে তিনি নেতা

2

 

নাসিরুদ্দিন চৌধুরী

গতকালের বাকি অংশ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জাঁদরেল ছাত্রনেতা কামরুল খান খসরু (স্বাধীনতার পর নির্মিত চলচ্চিত্র ‘ওরা ১১ জন’-এর নায়ক), মোস্তফা মহসীন মন্টু (পরবর্তীকালে গণফোরাম নেতা), মুন্সিগঞ্জের মহিউদ্দিন (স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর চীফ সিকিউরিটি অফিসার) প্রমুখের সাথে কচি ও ডা. গোফরান প্রায়ই গল্প গুজব করতেন। মাসুদ হাসান রুমি, হাসানুল হক ইনু (সাবেক মন্ত্রী, সাংসদ), আ.ফ.ম মাহবুবুল হক ও শরীফ নুরুল আম্বিয়া আমাদের সাথে এসে গল্পে যোগ দিতেন। এছাড়াও ডাঃ মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন (সাবেক সাংসদ), রাজশাহীর শহীদ নুরুন্নবী, কুষ্টিয়ার মারফত আলী, কুমিল্লার শিব নারায়ণ দাশ, খুলনার শেখ কামরুজ্জামান টুকু, নোয়াখালীর মাহমুদুর রহমান বেলায়েত (সাবেক সাংসদ), সিরাজগঞ্জের আবদুল লতিফ মির্জা, মাইজদীর মোস্তফা কামাল ও আবদুর রাজ্জাক প্রমুখের সঙ্গেকচি ও গোফরান একই ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নেন।
১৯৭১ এর জুলাই মাসের দ্বিতীয়ার্ধে কচি এবং তাঁর সহ প্রশিক্ষণার্থীরা সাহারানপুর বিমান বন্দর থেকে সরাসরি আগরতলা এসে পৌঁছেন। আগরতলা থেকে তারা প্রায় ২৫/৩০ মাইল দক্ষিণে উদয়পুর শহরের উত্তর প্রান্তে ভারতীয় বিএসএফএর তত্ত¡াবধানে পরিচালিত ক্যাম্পে প্রায় মাস খানেক অবস্থান করেন। আগষ্ট এর ৩য় সপ্তাহে ডাঃ মাহফুজ, ডাঃ মাহবুব, ডাঃ জাফরুল্লাহ, কাজী ইনামুল হক দানু, ইঞ্জিনিয়ার হারুন ও প্রফেসর ডা. মুলকুতুর রহমান ওরবিউল হোসেন কচি চট্টগ্রাম শহরের মুক্তিযুদ্ধারা বি.এল.এফ দলের সাথে চট্টগ্রাম শহরে প্রবেশ করেন।
ডাঃ মাহবুব ও ডাঃ জাফর এর নেতৃত্বে K-C1, ইঞ্জিঃ হারুন ও রবিউল হোসেন কবির নেতৃত্বে K-C II. ডাঃ মাহফুজের নেতৃত্বে K-C III, দশজন করে ৩০ জনের প্রথম বি. এল. এফ গেরিলা গ্রুপ চট্টগ্রামে শহরে প্রবেশ করে ১৯ আগষ্ট। আগরতলার উদয়পুর জেলার তেপানিয়া ক্যাম্পে তাদের সাথে মিলিত হল হাফলং থেকে ট্রেনিং প্রাপ্ত অমল, মুকুল এদের একটা গ্রুপ। এই তিনটি গ্রুপ শহরে বহু ঝুঁকিপূর্ণ দুঃসাহসী অপারেশন করেন। তাছাড়া বিচ্ছিন্ন যে সব এফএফ, গ্রুপ- নেতৃত্বহীন হয়ে পড়েছিল, তাদের সদস্যদের অন্তর্ভুক্ত করে তাদের কমান্ডকে শক্তিশালী করা হল। এদের মধ্যে ছিলেন- মাহবুব, ফজলু, লোকমান, শাহাবুদ্দীন, গফুর, ইলিয়াছদের গ্রুপসহ আরো অনেকেই। সেকান্দর, সেলিমউল্লাহ, প্রয়াত সান্তনু, মরহুম রহমান, গোলাম মারুফ (পাহাড়তলী), জাহাঙ্গীরসহ অন্যান্য স্থানীয়রাও ছিলেন। তাঁর অপারেশনের বর্ণনা দিয়েছেন কাজী ইনামুল হক দানু রবিউল হোসেন কচি স্মারক পুস্তিকায়। তিনি লিখেছেন রবিউল হোসেন কচির সাথে তাঁর উল্লেখ্যযোগ্য অপারেশন ছিল সরাইপাড়া মোঃ আলীর পেট্রোল পাম্প অপারেশন। প্রথমবার মোঃ আলীকে হাতের কাছে পেয়েও হাতছাড়া হয়ে গেলে আবারো তিন গ্রুপের সমন্বয়ে ব্যাপক অভিযান চালানো হয়।এই অপারেশন পাম্প ধ্বংস। পাম্পের সম্মুখে সি. এস.ডি, গো- ডাউনের মধ্যে রাজাকার ক্যাম্প ধ্বংস করা হয়। সম্ভবতঃ ১লা রমজান ছিল, গভীর রাত থেকে শেষ রাত পর্যন্ত কয়েক হাজার গুলি বিনিময় হয়। ওদিকে পাহাড়াতলী ঝাউতলার দিক থেকে বিহারী অবাঙ্গালীদের এলাকা থেকে মুহুর্মুহু নারায়ে তকবীর ধ্বনি শোনা যেতে থাকে। সমস্ত শহর যেন প্রকম্পিত হয়ে উঠে। এই অপারেশনে আমাদের সাথে অন্যান্যদের মধ্যে কচিও ছিল। অপারেশনের পর তারা আগ্রাবাদের সাবেক কমিশনার জালাল উদ্দিনদের বাড়িতে বাকী রাত কাটান। শেষ রাতে তারা সেহরিখেতে পারেননি। ভোর বেলা উঠে কাজী ইনামুল হক দানুও রবিউল হোসেন কচি হাজিপাড়ার ভিতর দিয়ে আগ্রাবাদ বাদামতলী মোড়ে একটি পর্দাঢাকা খাবারের দোকানে নাস্তা খেতে ঢোকেন।সেখানে লোকজনের কথোপকথনে শুনলেন, ওরা বলছে যে মুক্তিবাহিনী যুদ্ধ করতে করতে চট্টগ্রাম শহরের অর্ধেক দখল করে ফেলেছে। মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে পাকিস্তানী বাহিনী বিশেষ করে নৌ-বাহিনীর তুমুল লড়াই হয়েছে। বেশ কয়েকজন নৌ বাহিনীর সদস্য রেল বিটের উপর মৃত পরে থাকতে দেখা গেছে। কিছু রাজাকার ও অবাঙ্গালীর মৃতদেহ সরিয়ে নিতে অনেকে দেখেছে।
স্বাধীন বাংলা ছাত্র-সংগ্রাম পরিষদের চট্টগ্রাম শহরের অন্যতম নেতা রবিউল হোসেন কচি। ‘৭১ অক্টোবর মাসের শেষের দিকে চট্টগ্রাম শহর মুক্তিযোদ্ধা হাই কমান্ড কেন্দ্রীয় প্রচার সেল গঠন করে এবং দায়িত্ব দেওয়া হয় রবিউল হোসেন কচি, অরুণ দাশ, কামরুল ইসরাম, ফখরুল আহসান মণি, মঈনউদ্দীন খান বাদল ও দেওয়ান মাকসুদকে।
হাই কমান্ডের নির্দেশে রবিউল হোসেন কচি, আবু সাইদ সর্দার, অরুণ দাশ, কামরুল ইসলাম, ফখরুল ইসলাম মণিকে লিফলেট প্রকাশের দায়িত্ব দেওয়া হয়। আবু সাইদ সর্দারের পিতার পুরানো সাইক্লোস্টাইল মেশিন থেকে মোট তিনটা লিফলেট সে সময়ে প্রকাশিত হয়। এই কর্মপ্রক্রিয়ার সার্বিক দায়িত্ব পালনে এগিয়ে আসেন মঈনউদ্দীন খান বাদল। এই কার্যক্রমের একে একে যারা জড়িত হন তারা যথাক্রমে ফয়জুল মতিন, নূর মোহাম্মদ, একরামুল করিম, দেওয়ান মাকসুদ আহমেদ, শাহ আলম নিপু, শেখ জাহাঙ্গীর, সলিমউল্লাহ চৌধুরী, প্রয়াত শান্তনু চক্রবর্তীসহ অনেকেই।
মুক্তিযুদ্ধকালে কচি আলকরণ সহ বিভিন্ন সেল্টারে একা একা থাকলেও এনায়েত বাজারে মামার বাসায় থাকতেন বেশির ভাগ। ১২ ডিসেম্বর এনায়েত বাজার থেকে কচি চকবাজারে কামরুল-মণির সাথে দেখা করতে যাওয়ার পথে হেমসেন লেইনের গলির কাছাকাছি ধরা পড়ে যায়। এর পর পর তুষারও গ্রেপ্তার হয়ে যায় তার সেল্টার থেকে। পতেঙ্গার এক পরিত্যক্ত বাড়িতে, পরে বদর বাহিনীর টর্চার সেল ‘হোটেল ডালিম’এ ওদের বন্দী করে রাখা হয়। অমানুষিক অত্যাচার চলে কচির শরীরের ওপর। ছাড়া পাওয়ার পর দেখা যায় কচির শরীরের সর্বত্র অত্যাচারের চিহ্ন। মিলিটারীদের বুটের আঘাতে ওপরের পাটির কয়েকটা দাঁত ভেঙ্গে গেছে। বুকে-পিঠে বেয়নটের আঘাত। সারা শরীর ক্ষত-বিক্ষত।
একটু সুস্থ হওয়ার পর হসপিটাল থেকে নোয়াখালী গিয়ে আত্মীয় স্বজন পরিচিতজনদের সাথে দেখা করে আবার ফিরে আসেন চট্টগ্রামে। কচি নিজ প্রচেষ্টায় একটি প্যাকেজিং প্রতিষ্ঠান ও স্বরাজ প্রকাশনী সংস্থা গড়ে তুলেছিল। তাছাড়া ঢাকা প্রবাসী মুক্তিযোদ্ধা চট্টগ্রাম অঞ্চল, সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম, এবং বিভিন্ন মুক্তিযোদ্ধা সংগঠনের কার্যক্রমে রবি সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিল। ২০০৮ খ্রিস্টাব্দে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের আহব্বায়ক কমিটির সদস্য হিসেবে রবিউল হোসেন কচিকে দায়িত্ব প্রদান করা হয়। ‘দায়িত্ব গ্রহণের পর সংসদ বিষয়ক জটিলতা নিরসনকল্পে রবিউল হোসেন কচি অমানুষিক পরিশ্রম করেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ওর এ সংগ্রাম অব্যাহত ছিলো তার প্রমাণ ২০০৯ এর চট্টগ্রামের মুক্তিযোদ্ধাদের মেলা, ঢাকার বইমেলা-এই মেলায় ওর প্রকাশনী সংস্থা স্বরাজ থেকে প্রায় ৬৫টি বই প্রকাশ করে। সব বই-ই ছিলো মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক। দু’ভাই দু’বোনের পরিবারে কচি ছিলেন সবার ছোট। বড় ভাইয়ের নাম আকবর হোসেন ডিউক। দু’বোনের নাম শামসুন নাহার ডলি ও কামরুন নাহার বেবী।তাঁর দু’ছেলে, তাদের নাম – ইমন ও ফাহাদ ইউসুফ হোসেন প্রমিত।

লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক