আবু তালেব বেলাল
বার আউলিয়ার পুণ্যভূমি, বীর প্রসবিনী চট্টগ্রামের প্রায় শতবর্ষী প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অপর্ণাচরণ সিটি কর্পোরেশন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ। বিংশ শতকের তৃতীয় দশকে ১৯২৭ খ্রি. চট্টগ্রাম নগরীর প্রাণকেন্দ্রে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি গড়ে উঠে। সে সময় চট্টগ্রাম পৌরসভার খ্যাতিমান চেয়ারম্যান আলহাজ্ব নুর আহমদ চট্টগ্রামে অবৈতনিক শিক্ষার আন্দোলন শুরু করেছিলেন। বিশেষ করে নারী শিক্ষা বিস্তারে তাঁর প্রচেষ্টা তৎকালীন পিছিয়ে থাকা নারী সমাজকে ব্যাপকভাবে আন্দোলিত করেছিল। নুর আহমদ চেয়ারম্যানের এই শিক্ষা আন্দোলনে উজ্জীবিত হয়ে নন্দনকানন এলাকার বিদ্যোৎসাহী ব্যক্তিত্ব শ্রী রজনীকান্ত বিশ্বাস, শ্রীযুক্ত কিরন চন্দ্র দাস এবং শ্রীযুক্ত গোলাপ চন্দ্র সিংহসহ শ্রীমতি কালীতারা দেবী গড়ে তোলেন একটি প্রাইমারি স্কুল। বলা যায়, এটি অনেকটা অনাষ্ঠানিক প্রাইমারি স্কুল ছিল। বিধবা কালীতারা দেবীর নন্দনকানস্থ ছোট্ট কুড়েঘরে ১৯২৬ সালে এই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠদান কার্যক্রমের সূচনা হয়। এলাকায় তখন এটি নন্দনকানন স্কুল নামে পরিচিতি লাভ করে। পরবর্তীতে স্কুলের শিক্ষার্থী বাড়তে থাকলে কালীতারার বাড়িতে জায়গার সংকুলান না হওয়ায় নন্দনকাননের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ নুর আহমদ চেয়ারম্যানের মাধ্যমে তৎকালীন সীতাকুন্ডের জাফরনগরের জমিদার এবং চট্টগ্রাম অনারারি ম্যাজিস্ট্রেট রায় বাহাদুর অপর্ণাচরণ চৌধুরীকে অনুরোধ জানান একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করার । এ সময় বাবু অপর্ণাচরণ নন্দনকানন এলাকায় থাকতেন। নুর আহমদ চেয়ারম্যান ও এলাকার বিদ্যোৎসাহী ব্যক্তিদের কথা তিনি ফেলতে পারেন নি। অনুরোধ রক্ষা করে বাবু অপর্ণাচরণ তার নামেই স্কুল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করেন এবং দশ হাজার টাকা মূল্যের বর্তমান অপর্ণাচরণ স্কুলের প্রায় নব্বই শতক জায়গা ক্রয় করে তাতে অবকাঠামো নির্মাণ করেন। সেই থেকে অর্থাৎ ১৯২৭ সালে প্রতিষ্ঠানটি প্রাইমারি থেকে জুনিয়র স্কুলে উন্নীত হয়। স্কুলের প্রথম প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক ছিলেন শ্রীমতি কালীতারা দেবী। তার মৃত্যুর পর ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের প্রথম বিপ্লবী ও শহীদ বীরকন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার ১৯৩২ সালে অপর্ণাচরন বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা হিসাবে যোগদান করেন। তাঁর স্কুলে যোগদান অপর্ণাচরণ নতুন ইতিহাসের অংশ হয়ে পড়ে। প্রীতিলতা ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী ও তীক্ষè বুদ্ধিমতি। প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার ১৯১১ সালের ৫ মে চট্টগ্রামের পটিয়াস্থ ধলঘাট এলাকায় এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা জগবন্ধু ছিলেন চট্টগ্রাম পৌরসভার হেডক্লার্ক। তিনি বিপ্লবী মাস্টারদা সূর্যসেনের ঘনিষ্ট সহযোদ্ধা ছিলেন। ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে পরিচালিত সশস্ত্র সংগ্রামে প্রীতিলতাকে প্রথম আত্মউৎসর্গকারী নারী হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। প্রীতিলতা ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রামের ডা. খাস্তগীর সরকারি বালিকা বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিকুলেশন, ১৯২৯ সালে রাজধানী ঢাকার ইডেন মহিলা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে ১৯৩১ সালে কোলকাতার বেথুন কলেজ থেকে দর্শন শাস্ত্রে গ্র্যাজুয়েশন লাভ করেন। ইডেন কলেজে অধ্যয়নরত অবস্থা থেকে তিনি মাস্টারদা সূর্যসেনের বিপ্লবী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়েছেন। এসময় তিনি বিশ্বের বিভিন্ন বিপ্লবীদের জীবন কাহিনী ও বই পড়েছেন। ১৯৩০ সালে প্রীতিলতা কলকাতা আলীপুর কেন্দ্রিয় কারাগারে কয়েকজন বিপ্লবীর সাথে সাক্ষাৎ করেন। ১৯৩২ সালে পটিয়া ধলঘাট সংঘর্ষে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়েছিলেন সুর্যসেন ও প্রীতিলতা। সেখানে বেশ কয়েকজন বিপ্লবী নিহত হলেও মাস্টারদা ও প্রীতিলতা প্রাণে বেঁচে যান। ধলঘাট থেকে এসে জালালাবাদে এসে আত্মগোপন করেন সূর্যসেন, প্রীতিলতা। শিক্ষাকতা পেশায় যুক্তহন। একই বছর ২৩শে সেপ্টেম্বর প্রীতিলতা পাহাড়তলীতে ইউরোপীয়ান ক্লাব আক্রমনে অংশগ্রহণ করেন। কথিত আছে , ইংরেজ অভিজাত শ্রেণির এ ক্লাবের প্রধান গেইটে লেখা ছিল – ‘কুকুর ও ভারতীয়দের প্রবেশ নিষেধ’। এই জাতীয় অবমাননাকর উক্তির জবাব দিতেই প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার ১৯৩২ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর সকাল বেলা কর্মস্থল অপর্ণাচরণ স্কুলে শ্রেণি পাঠদান কার্যক্রম শুরু করে কাট্টলী এলাকায় জনৈক বিপ্লবীর ঘরে আশ্রয় নেন। ওখান থেকে রাতে সামরিক কায়দায় পুরুষের পোশাক পরে কয়েকজন বিপ্লবীকে নিয়ে ঐ ক্লাবে আক্রমণ করেন। এই সময় তিনি গুলিবিদ্ধ হলে উপনিবেশিক ইউরোপীয়ানদের হাতে গ্রেপ্তারপূর্বক অপমানের চেয়ে মৃত্যুই শ্রেয় -এই চিন্তা থেকে তার সাথে থাকা পটাশিয়াম সায়ানাইড খেয়ে স্বাধীন ভারতের জন্য আত্মাহুতি দেন।
সেই থেকে অপর্ণাচরণ বিদ্যালয় এই বিপ্লবীর স্মৃতিকে শ্রদ্ধাভরে বুকে ধারন করে আছে। অপর্ণাচরণ ১৯৫৪ সালে মাধ্যমিক উচ্চ বিদ্যালয়ে উন্নীত হয়। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের প্রয়াত মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর একান্ত ইচ্ছায় ১৯৯৭ সালে বিদ্যালয়টি চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের অন্তর্ভুক্ত করা হয় এবং এর নামকরণ করা হয় অপর্ণাচরণ সিটি কর্পোরেশন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়। ২০১৩ সালে বিদ্যালয়টি কলেজে উন্নীত হয়। অপর্নাচরণ সিটি কর্পোরেশন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ চট্টগ্রামের নারী শিক্ষায় এক অনন্য অবদান রেখে যাচ্ছে। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন পরিচালিত ৪৮টি মাধ্যমিক স্কুল ও ২৩টি কলেজের মধ্যে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক ফলাফল বিবেচনায় সর্বোচ্চ আসন দখল করে আছে। ৪র্থ থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত এই প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা রয়েছে ৪,২১৭ জন। প্রাতঃ ও দিবা বিভাগে রয়েছে ২১টি করে ৪২টি শাখা। কলেজে রয়েছে বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা শাখা। অধ্যক্ষ ও সহকারী প্রধান শিক্ষক সহ মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকে শিক্ষক রয়েছে ৬১ জন। অফিস সহকারী সহ, নৈশপ্রহরি ও কর্মচারী রয়েছে ১১ জন। ২০২৪ সালে এস.এস.সি. পরীক্ষায় চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডে এই স্কুল দশম স্থান অধিকার করেছে। প্রতিষ্ঠানের ২০২৩ সালে শিক্ষকদের এমপিও, শিক্ষার্থীদের ভর্তি ও বেতন, পরীক্ষার ফি ইত্যাদি মিলে সর্বোচ্চ আয় ছিল তিন কোটি একত্রিশ লক্ষা চৌত্রিশ হাজার একশত তেয়াল্লিশ টাকা এবং ব্যয় হয়েছে দুই কোটি চৌষট্টি লক্ষ ছাব্বিশ হাজার চারশত ছেষট্টি টাকা। উদ্বৃত্ত রয়েছে সাতষট্টি লক্ষ সাত হাজার ছয়শত সাতাত্তর টাকা। আজকের এই দিনে আমরা গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি বীরকন্য প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারকে। সাথে স্মরণ করছি প্রতিষ্ঠাতা বাবু অপর্ণারায় চৌধুরী, শ্রীমতি কালিতারা দেবীকে। প্রধান শিক্ষিকা ও অধ্যক্ষ হিসেবে যারা কর্মরত ছিলেন যেমন – শ্রীমত বাসন্তী সেন, শ্রীমতি প্রণতি সেন (যিনি প্রায় অর্ধশতক এই প্রতিষ্ঠান প্রধানের দায়িত্ব পালন করেছেন। ) মিসেস রোকেয়া বেগম, মিসেস মমতা বেগম, মিসেস রওশন আখতার, মিসেস জারেকা বেগমকে। একই সাথে সিটি কর্পোরেশনের সাবেক অভিভাবকদের প্রতি যারা এ প্রতিষ্ঠানের অগ্রযাত্রায় ভূমিকা রেখেছেন।
অপর্নাচরণ শুধু একাডেমিক কার্যক্রমে এগিয়ে আছে তাই নয়, এ প্রতিষ্ঠানে প্রতিটি কো কারিকুলাম শিক্ষার্থীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের মাধ্যমে পালন করা হয়। সিটি কর্পোরেশনের প্রতিটি জাতীয় ও অভ্যন্তরীন অনুষ্ঠানে এ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা সাংস্কৃতিক কার্যক্রম প্রদর্শন করে থাকে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অনেক শিক্ষার্থী বেডমিন্টন, কারাতে, নিত্য ও রবীন্দ্র-নজরুল সংগীতে শ্রেষ্ঠত্বের আসন অলঙ্কৃত করেছে। দৃষ্টির টেলিভিশন বিতর্ক প্রতিযোগিতায় এ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা চ্যাম্পিয়ানশীপ অর্জন করে। গণিত অলিম্পিয়াড কৃতিত্বে অর্জন করেছে এ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। এছাড়া বিজ্ঞান মেলায় এ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের অন্যন্য অর্জন করেছে। এখানে রেডক্রিসেন্ট, গার্লস গাইড, রেইঞ্জার ইউনিটসহ বিশ্ব সাহিত্যের সক্রিয় শাখা রয়েছে। এছাড়া বার্ষিক শিক্ষা সফর, নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধ নিয়ে কর্মশালা, পরিবেশ ও স্বাস্থ্য বিষয়ক সচেতনত কর্মসূচি, শিক্ষক রিক্রয়েশন কর্মসূচিসহ ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রম পরিচালিত হয়।
লেখক : অধ্যক্ষ,
অপর্ণাচরণ সিটি কর্পোরেশন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ