বিস্মৃতপ্রায় নেতা সাবেক প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক নূরুল ইসলাম চৌধুরী

2

মুহাম্মদ শামসুল হক

চট্টগ্রামের যে কজন রাজনৈতিক নেতা আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা ও মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনে আন্তরিকতা ও নিঃস্বার্থভাবে দায়িত্ব পালন করে গেছেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম অধ্যাপক নূরুল ইসলাম চৌধুরী। লেখাপড়ায় মেধাবী, উচ্চশিক্ষিত ও ব্যক্তিগত জীবনে অর্থের প্রতি নির্মোহ এই নেতা পাক-ভারত বিভক্তির আগে ছাত্র রাজনীতির সাথে যুক্ত হন। পরবর্তীতে রাজনীতির পাশাপাশি অধ্যাপনা ও আইন পেশার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। দীর্ঘ বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনে তিনি বঙ্গবন্ধুর বিশ্বস্ত সহকর্মীদের একজন হিসেবে জাতীয় সংসদ সদস্য, বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন কমিটির অন্যতম সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথমে শিল্প প্রতিমন্ত্রী এবং পরে প্রতিরক্ষা প্রতিমন্ত্রী।
অধ্যাপক নুরুল ইসলাম চৌধুরী ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অত্যন্ত আস্থাভাজন। অন্য অনেক নেতা-কর্মীকে বঙ্গবন্ধু তাঁদের নাম ধরে, তুমি করে, এমনকি স্নেহের সুরে তুই-তোকারি সম্বোধন করলেও অধ্যাপক নুরুল ইসলাম চৌধুরীকে সম্বোধন করতেন ‘অধ্যাপক সাহেব’। সরকারপ্রধান ছাড়া প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের মধ্যে এ পর্যন্ত তিনিই ছিলেন দেশের একমাত্র প্রতিরক্ষা প্রতিমন্ত্রী। ১৯৭৫ সালের ২৬ মে তাঁকে শিল্প মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। সেই হিসেবে ১৯৭৫ সালের আগস্ট মাস পর্যন্ত তিনিই ছিলেন সশস্ত্র বাহিনীর প্রশাসনিক প্রধান। তবে তিনি ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার হাত থেকে বাঁচানোর জন্য দৃশ্যত কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেননি। বরং তিনি অনেকের মতো খন্দকার মোশতাক আহমদের মন্ত্রীসভার সদস্য হিসেবে শপথ নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। এ নিয়ে অবশ্য বিভিন্ন রকম সমালোচনার সম্মুখিন হন তিনি। পরবর্তী সময়ে তিনি ১৫ আগস্ট কীভাবে তৎকালীন সেনা সদস্যরা তাঁকে অস্ত্রের মুখে খোন্দকার মোস্তাক আহমদের কাছে নিয়ে গিয়ে মন্ত্রীসভায় যোগ দিতে বাধ্য করেন তার বিবরণ দেন। (বিস্তারিত সাক্ষাৎকার, ভোরের কাগজ, ১৫.১৬.১৭ আগস্ট ১৯৯৪)। বিশ্বাসঘাতক মোশতাকের মন্ত্রীসভায় যোগ দেওয়ার কারণে নেতা-কর্মীদের নানা প্রশ্নের মুখে তিনি অনুশোচনা প্রকাশ করেন এবং অনেক দিন হতহবিল অবস্থায় দিন কাটে তাঁর। অবশ্য আশির দশকে তিনি আবার দলের পুনর্গঠনে ভ‚মিকা রাখেন।
অধ্যাপক নুরুল ইসলাম চৌধুরীকে কাছে থেকে দেখা বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী ও প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. অনুপম সেন বলেন, ‘আমি অধ্যাপক নুরুল ইসলাম চৌধুরীকে জানি ১৯৬৪ সাল থেকে-তিনি চট্টগ্রাম সিটি কলেজের অধ্যাপক থাকাকাল থেকে। ওই সময় আমি সিটি কলেজের খন্ডকালীন শিক্ষক ছিলাম, তিনি ছিলেন রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের একজন নামকরা অধ্যাপক। সিটি কলেজে তখনই অন্তত ১০ হাজার ছাত্র ছিল। তার বড় একটি অংশ ছিল রাষ্ট্রবিজ্ঞানের। তারা সবাই অধ্যাপক নুরুল ইসলাম চৌধুরীকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা ও সম্মান করতো। তিনি বক্তা হিসেবেও খুব ভালো ছিলেন। ক্লাসে তাঁর কথা ছাত্ররা মুগ্ধ হয়ে শুনতো। আমার অনেক ছাত্র-শিক্ষকের কাছে তাঁর ভালো গুণের কথা শুনেছি। রাজনীতিবিদ ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবেও তাঁর ভূমিকার কথা জেনেছি। একাত্তরের এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে ভারতে যাওয়ার সময় আমরা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৬-১৭ জন শিক্ষক রামগড়ে মহকুমা প্রশাসকের বাংলোয় ২-৩ দিন অবস্থান করছিলাম। সেখানে তাঁকে দেখেছিলাম ভারতে গমণেচ্ছুদের নিয়ে কাজ করতে। উস্কুখুস্কু চুল, একটা লুঙ্গি আর পাঞ্জাবি পরা অবস্থায় তাঁকে অনেকটা উদ্ভান্তের মতো লাগছিল। টাকা-পয়সা ছাড়া তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে চলে আসতে হয়েছিল তাঁকে। এরপর তাঁর সঙ্গে ১৯৮০ সালে যখন চট্টগ্রামে দেখা হয় তখন তিনি বলেছিলেন খুনি মোশতাক কীভাবে তাঁকে জোর করে ধরে নিয়ে গিয়েছিলেন। আমি আগেও বুঝতে পেরেছিলাম, উনি যে ধরনের নীতিবান মানুষ ছিলেন তাতে জোর করে ধরে নেওয়া না হলে তিনি মোশতাকের মন্ত্রীসভায় যাওয়ার মতো লোক নন। ওই সময় সময় আজাদীতে একটি লেখায়ও তিনি ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছিলেন।’
শিক্ষাবিদ অধ্যক্ষ শায়েস্তা খান বলেছেন, ‘অধ্যাপক নুরুল ইসলাম ছিলেন অত্যন্ত ভদ্র, যুক্তিবাদী, নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনে বিশ্বাসী এবং নিঃস্বার্থ আওয়ামী লীগার।শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি রাজনীতি ও আইন পেশাকে দেশসেবার ব্রত হিসেবে নিয়েছিলেন।’ মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক কাজী শামসুল ইসলাম বলেছেন, ‘তাঁকে (নুরুল ইসলাম চৌধুরী) আমি কাছে থেকে দেখেছি সিটি কলেজে আমার শিক্ষক হিসেবে, রাজনীতির মাঠে এবং মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনে নেতা হিসেবে। শঠতা, মিথ্যা, অহংকার ইত্যাদি তাঁর চরিত্রে দেখিনি।’
প্রাক্তন ছাত্রনেতা ও মুক্তিযোদ্ধা এমএন ইসলাম, কাজী আবু তৈয়ব, চৌধুরী মাহবুবুর রহমান স্মৃতিচারণ করে বলেছেন, নুরুল ইসলাম চৌধুরী কখনো মিথ্যা আশ্বাসে কর্মীদের প্রলুব্ধ করতেন না। প্রশাসনে অন্যায় প্রভাব খাটানো, স্বজনপ্রীতি এবং যেনতেন প্রকারে অর্থ উপার্জনের চেষ্টা তিনি করেননি। এমনকি স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে লাইসেন্স-পারমিট কিংবা চাকরির সুবিধা দিতে না পারায় কেউ কেউ তাঁকে ভুলও বুঝেছেন। তিনি কর্মীদের নীতি-নৈতিকতা মেনে চলার পরামর্শ দিতেন। একজন সংসদ সদস্য ও প্রতিমন্ত্রী হয়েও তিনি অর্থ সংকটে দিন কাটিয়েছেন, সাদাসিধে জীবন করেছেন। এমনকি সৎভাবে রাজনীতি করতে গিয়ে তাঁকে নিজের পৈত্রিক সম্পত্তি বিক্রি করতে হয়েছে (সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে লেখকের সাক্ষাৎকার)।
প্রাক্তন ছাত্রনেতা ও মুক্তিযোদ্ধা কাজী আবু তৈয়ব বলেন, অধ্যাপক নুরুল ইসলাম চৌধুরী একজন সৎ, সরল, আদর্শবাদী, নিরহঙ্কারী রাজনীতিক ছিলেন। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধীনতা সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে অবিচল এবং আওয়ামী লীগের সঙ্গে থেকে নানা আন্দোলন-সংগ্রামে অংশ নিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু তাঁর ওপর আস্থা এবং বিশ্বাস রাখতেন বলেই তাঁকে প্রথমবার শিল্প প্রতিমন্ত্রী ও দ্বিতীয়বার প্রতিরক্ষামন্ত্রী পদে নিয়োগ দিয়েছিলেন। অন্য অনেক নেতা-কর্মীকে তিনি নাম ধরে ডাকলেও নুরুল ইসলাম চৌধুরীকে ডাকতেন প্রফেসর সাহেব। দক্ষিণ জেলার রাজনীতিতে জাকেরুল হক চৌধুরী, একে এম আবদুল মান্নান, আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু, আবদুল খালেক (চাচা খালেক), আতাউর রহমান কায়সার, ডা. এবিএম ফয়েজ প্রমুখ নুরুল ইসলাম চৌধুরীকে শ্রদ্ধা ও সম্মানের চোখে দেখতেন। জেলার মধ্যে জহুর আহমদ চৌধুরী, এমএ হান্নান, ডা. এমএ মান্নান প্রমুখ নেতার আস্থাভাজন ছিলেন তিনি।
মুক্তিযোদ্ধা চৌধুরী মাহবুবুর রহমান বলেন, নুরুল ইসলাম চৌধুরী ব্যক্তিজীবনে আর্থিকভাবে অসচ্ছল ছিলেন। কিন্তু লোভ-লালসা ও দুর্নীতির ঊর্ধ্বে ছিলেন। একজন মন্ত্রী হয়েও সাধারণ জীবন-যাপন করতেন। দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির সুযোগ না নিতে না পারার কারণে অনেকে তাঁকে ভুল বুঝেছেন, অভিমান করে তাঁর কাছ থেকে এক সময় দূরে সরে গিয়েছিলেন। পরে তাঁরা আত্মোপলব্ধি করতে পেরে অনুতপ্তও হয়েছেন।
অধ্যাপক নুরুল ইসলাম চৌধুরীর জন্ম ১৯২৭ সালের ১৩ জানুয়ারি চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার গোবিন্দরখীল গ্রামের হাদু চৌধুরী বংশে। তাঁর বাবা প্রয়াত আবদুস ছমদ চৌধুরী ছিলেন ব্রিটিশ আমলের পুলিশের দারোগা (ছমদ দারোগা নামে এলাকায় পরিচিত)। বাবার সরকারি চাকরির সুবাদে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ভ্রমণ ও লেখাপড়া করতে হয়েছে নুরুল ইসলাম চৌধুরীকে। তিনি ১৯৪২ সালে বরিশাল জিলা স্কুল থেকে এন্ট্রান্স, ১৯৪৪ সালে কলকাতা স্কটিস চার্চ কলেজ থেকে আই, এ এবং ১৯৪৭ সালে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে কৃতিত্বের সাথে বি, এ পাস করেন। পরে ১৯৫২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্র বিজ্ঞানে এম, এ এবং ১৯৫৪ সালে এল, এল, বি ডিগ্রি লাভ করেন। স্কুল জীবনেই তিনি ছাত্র রাজনীতির সাথে যুক্ত হন এবং ১৯৪৬-৪৭ সালে তদানীন্তন বঙ্গীয় মুসলিম ছাত্রলীগের চট্টগ্রাম শাখার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ১৯৪৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের ধর্মঘটের সময় সলিমুল্লাহ মুসলিম ছাত্রবাস থেকে বহি®কৃত হন। ১৯৫১ সালে আওয়ামী লীগে যোগ দেন। সক্রিয় ভূমিকা রাখেন মহান ভাষা আন্দোলনে।
নুরুল ইসলাম চৌধুরী ১৯৫২ থেকে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম জেলা যুবলীগের সভাপতি, ১৯৫৩ থেকে ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক, ১৯৫৫ থেকে ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম সদর মহকুমা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ১৯৫২ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রামের বিভিন্ন কলেজে অধ্যাপনা করেন এবং মৃত্যুর আগে পর্যন্ত আইন পেশায় সম্পৃক্ত ছিলেন।
অধ্যাপক চৌধুরী ১৯৭০ সালে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ ও ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন।
এ ছাড়া, তিনি বিভিন্ন পেশাজীবী ও সমাজসেবামূলক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বঙ্গবন্ধু পরিষদ সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী শাখার সহ-সভাপতি, ঢাকাস্থ পটিয়া সমিতির সভাপতি এবং চট্টগ্রাম সিটি কলেজ, পটিয়া কলেজ, আইন কলেজ ও আর্য সঙ্গীত বিদ্যালয় পরিচালনায় সম্পৃক্ত ছিলেন তিনি।
অধ্যাপক নুরুল ইসলাম চৌধুরী ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। পাকিস্তানি বাহিনী ২৫ মার্চ বাঙালিদের ওপর গণহত্যা শুরুর প্রাক্কালে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করলে ২৬ মার্চ পটিয়ায় গঠিত স্বাধীন বাংলা সংগ্রাম পরিষদের উপদেষ্টা হন তিনি এবং স্থানীয় তরুণ-যুবকদের সংগঠিত ও প্রশিক্ষণের জন্য ভারতে পাঠানোর উদ্যোগ নেন। পরবর্তী সময়ে মুক্তিযুদ্ধকালীন পূর্বাঞ্চলীয় এক নম্বর জোনাল কাউন্সিলের চেয়ারম্যান এবং পূর্বাঞ্চল যুব শিবিরের এক নম্বর সেক্টরের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৯৫ সালে ৩ অক্টোবর সকাল সাড়ে সাতটায় চট্টগ্রাম নগরের একটি ক্লিনিকে অসুস্থ অবস্থায় ৭০ বছর বয়সে তিনি মারা যান। একজন নির্লোভ, নিরহংকার, সাধারণ সাধাসিধে জীবন-যাপনকারী নেতা এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

লেখক : গবেষক, সম্পাদক ইতিহাসের খসড়া, ফেলো-বাংলা একাডেমি