বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন ও ভর্তি ফি কমানো হোক

2

শেখ রিফাদ মাহমুদ

বাংলাদেশের শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে আলোচিত বিষয়গুলোর একটি হলো বিসিএসসহ সব সরকারি চাকরি এবং ব্যাংক, বিমা, আধা-সরকারি (এক্সটেনশন অব দ্য গভর্নমেন্ট) প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ পরীক্ষার আবেদন ফি সর্বোচ্চ ২০০ টাকায় নির্ধারণ। এটি শুধু চাকরি প্রার্থীদের অর্থনৈতিক চাপ কমায়নি, বরং দীর্ঘদিনের একটি দাবির বাস্তবায়ন করে সর্বমহলের প্রশংসা অর্জন করেছে। বিশেষ করে নিম্নবিত্ত এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য এই সিদ্ধান্ত একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এই উদাহরণ প্রমাণ করে যে সঠিক সময়ে প্রয়োজনীয় নীতিগত পরিবর্তন কতটা ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। তবে প্রশ্ন উঠছে শিক্ষাক্ষেত্রে এমন যুগোপযোগী সংস্কার কবে আসবে? বিশেষ করে, বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা ও ভর্তির ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের ওপর আরোপিত উচ্চ ফি নিয়ে আলোচনা এখন সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে।
আমাদের দেশে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করার পর দেশের লক্ষ-লক্ষ শিক্ষার্থীর স্বপ্ন থাকে ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার। তবে সেই স্বপ্ন পূরণের পথে অন্যতম বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায় আর্থিক সীমাবদ্ধতা। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আবেদন ফি বর্তমানে এক হাজার থেকে দেড় হাজার টাকার মতো। এটি অনেক শিক্ষার্থীর জন্যই বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে ওঠে, কারণ একজন শিক্ষার্থী একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করে। এর পাশাপাশি যাতায়াত, থাকা-খাওয়ার খরচসহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক খরচ যোগ করলে ভর্তিযুদ্ধে অংশ নিতে প্রতিটি শিক্ষার্থীকে বিপুল পরিমাণ অর্থের জোগান দিতে হয়। অনেক ক্ষেত্রে ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েও অতিরিক্ত ভর্তি ফি’র কারণে অনেক অস্বচ্ছল মেধাবী শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারেন না। বিশেষ করে দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী কিংবা নিম্নবিত্ত পরিবারের শিক্ষার্থীদের পক্ষে এই অর্থের বন্দবস্ত করা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়।
প্রতিবছর পত্রিকার পাতায় আমরা এ সংক্রান্ত নানা হৃদয়বিদারক ঘটনা দেখতে পাই। ভর্তির অর্থ জোগাড় করতে কেউ চড়া সুদে ঋণ নিচ্ছে, কেউ স্বর্ণ বন্ধক রাখছে, আবার কেউ পরিবারের শেষ সম্পদ গরু-ছাগল বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে। এসব ঘটনা শুধু আর্থিক সংকট নয়, শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপরও গভীর প্রভাব ফেলে। অনিশ্চয়তা ও দুশ্চিন্তার মধ্য দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের সূচনা শিক্ষার্থীদের আত্মবিশ্বাসে চিড় ধরায় এবং পরবর্তীতে তাদের শিক্ষাজীবন ও ক্যারিয়ারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। ক্রমবর্ধমান ভর্তি ফি শিক্ষার্থীদের স্বপ্ন পূরণের পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। বিশেষ করে বিগত পাঁচ বছরের পরিসংখ্যান পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি ফি বৃদ্ধি পেয়েছে ব্যাপকভাবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে উদাহরণ হিসেবে ধরলে দেখা যায়, ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষে যেখানে ভর্তি পরীক্ষার আবেদন ফি ছিল ৩৫০ টাকা, সেখানে ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে সেটি দাঁড়িয়েছে ১০৫০ টাকায়। অর্থাৎ পাঁচ বছরের ব্যবধানে এটি বেড়েছে তিনগুণ।
এক জাতীয় দৈনিকের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের ভর্তি পরীক্ষায় আবেদন ফি থেকে ১৭ কোটি টাকা আয় করেছে। এটি কোনো একক ঘটনা নয়। বছরের পর বছর আবেদন ফি বাড়িয়ে শিক্ষার্থীদের অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টি করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিজেদের রাজস্ব বৃদ্ধি করছে। অথচ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত শিক্ষার্থীদের জন্য উচ্চশিক্ষার সুযোগ সহজলভ্য করা, ব্যবসায়িক লাভ নয়।
এই ধরনের সিদ্ধান্ত শুধু শিক্ষার্থীদের আর্থিক সমস্যাই বাড়াচ্ছে না, বরং শিক্ষাকে বাণিজ্যিক পণ্যে পরিণত করছে। ক্রমাগত বাড়তি ফি’র কারণে মেধাবী কিন্তু অস্বচ্ছল শিক্ষার্থীরা ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ হারাচ্ছে। তারা নিজেদের স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করার আগে অর্থনৈতিক বাস্তবতার কাছে হেরে যাচ্ছে। শিক্ষার্থীদের অধিকার রক্ষার পরিবর্তে, ফি বাড়ানোর অজুহাত দেওয়া হয় প্রশাসনিক খরচ ও পরীক্ষার ব্যবস্থাপনার উন্নতির নামে। কিন্তু এসব ব্যাখ্যা শিক্ষার্থীদের দুর্ভোগ কমানোর বদলে তাদের প্রতি আর্থিক জুলুমের প্রতিচ্ছবি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
শিক্ষাকে সবার জন্য সমানভাবে সহজলভ্য করতে হলে দ্রæত এ বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, শিক্ষক এবং নীতিনির্ধারকদের এ বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা উচিত। তারা যদি শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য মেধার বিকাশ এবং মানবসম্পদ উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দেন, তাহলে ভর্তি ফি সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসা সম্ভব।
শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি ফি পুনঃনির্ধারণ করে সবার সাধ্যের মধ্যে নিয়ে আসা এখন সময়ের দাবি। মাননীয় শিক্ষা উপদেষ্টা, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন এবং সংশ্লিষ্ট প্রশাসন-কে এ বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার আহবান জানাই। একটি শিক্ষাবান্ধব জাতি গঠনে শিক্ষাকে ব্যবসায়িক পণ্য হিসেবে নয়, বরং একটি মৌলিক অধিকার হিসেবে দেখা জরুরি। পরিস্থিতি বিবেচনায়, ভর্তি ফি কমিয়ে সকল শিক্ষার্থীর জন্য উচ্চশিক্ষার দরজা উন্মুক্ত করা হোক।

লেখক: এডুকেশন রিলেশন অফিসার, কমনওয়েলথ স্টুডেন্টস এসোসিয়েশন। চেয়ারম্যান, এসআরআই ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন।