বিশ্ববাসীকে থ্রি জিরো ভিশনে জোর দিতে আহবান ড. ইউনূসের

1

পূর্বদেশ ডেস্ক

প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং জলবায়ু-সহনশীল নগর উন্নয়নের প্রতি বাংলাদেশের অঙ্গীকার তুলে ধরে বিশ্ববাসীর প্রতি ‘থ্রি জিরো’ ভিশন-শূন্য সম্পদ কেন্দ্রীকরণ, শূন্য বেকারত্ব এবং শূন্য নেট কার্বন নির্গমনের ওপর জোর দেওয়ার আহবান জানিয়েছেন।
গতকাল সোমবার স্থানীয় সময় সকালে ব্যাংককের জাতিসংঘ সম্মেলন কেন্দ্রে টেকসই নগর উন্নয়নের লক্ষ্যে ৮১তম এসক্যাপ অধিবেশনে দেওয়া ভিডিও বার্তায় এ আহবান জানান তিনি।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, জলবায়ু ও নগর চ্যালেঞ্জ থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ও জলবায়ু সহিষ্ণু অর্থনীতি গড়ে তুলতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ তীব্র নগর চ্যালেঞ্জ, জলবায়ু ঝুঁকি, অবকাঠামোগত বৈষম্য এবং সামাজিক বৈষম্যের মুখোমুখি। তবুও, আমরা একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ও জলবায়ু সহিষ্ণু অর্থনীতি গড়ে তুলতে প্রতিশ্রæতিবদ্ধ।
গত ৮ মাসে অন্তর্বর্তী সরকার যে চ্যালেঞ্জগুলো মুখোমুখি হয়েছে, তা তুলে ধরে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ছাত্রদের নেতৃত্বে গণঅভ্যুত্থানের পর ২০২৪ সালের ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করে। খবর বাসসের।
আমরা পূর্ববর্তী স্বৈরাচারী শাসনের রেখে যাওয়া একটি ধ্বংসাত্মক অর্থনীতি উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছি। তখন থেকে অন্তর্বর্তী সরকার আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে সংস্কার প্রক্রিয়া ও নানা উদ্যোগ বাস্তবায়ন শুরু করেছে। অনেক ক্ষেত্রেই এই সরকার সফল হয়েছে। ফেব্রুয়ারিতে মুদ্রাস্ফীতি ৯ দশমিক ৩ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে, যা দুই বছরের ইতিহাসে সর্বনি¤œ।
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, আমরা রেকর্ড পরিমাণ রেমিট্যান্স আসতে দেখেছি। বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরে আসছে এবং আমরা স্থিতিশীলতা ও প্রবৃদ্ধির দিকে স্থিরভাবে এগিয়ে যাচ্ছি। সরকার সম্প্রতি চার দিনের একটি আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ শীর্ষ সম্মেলন করেছে। যেখানে ৫০টি দেশের ৪০০ জনেরও বেশি বিনিয়োগকারী অংশগ্রহণ করেছেন।
টেকসই উন্নয়ন সম্পর্কে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, টেকসই নগর উন্নয়ন এখন বাংলাদেশের অগ্রগতির কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টা তার বক্তব্যে অন্তর্ভুক্তিমূলক ও জলবায়ু সহিষ্ণু অর্থনীতি গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, যেহেতু আগামী বছর আমরা স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি, আমাদের এটা নিশ্চিত করতে হবে যে, আমাদের নগর রূপান্তর শুধু অর্থনৈতিকভাবেই সবল নয়, বরং সামাজিকভাবে অন্তর্ভুক্তিমূলক ও পরিবেশগতভাবেও টেকসই।
জলবায়ু পরিবর্তন বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি হিসেবে রয়ে গেছে উল্লেখ করে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী এই অর্থনীতিবিদ বলেন, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, বন্যা ও ঘূর্ণিঝড় শহরগুলোকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করে।
তিনি বাংলাদেশের অভিযোজন প্রচেষ্টার সমর্থনে বৈশ্বিক সহযোগিতা বৃদ্ধি ও কার্যকর জলবায়ু অর্থায়নের আহবান জানান।
জলবায়ু ঝুঁকির প্রতিক্রিয়ায় অধ্যাপক ইউনূস বলেন, বাংলাদেশ সবুজ ও জলবায়ু সহনশীল অবকাঠামো, টেকসই আবাসন ও প্রকৃতি-ভিত্তিক সমাধানে বিনিয়োগ করছে। আমাদের কম খরচের আবাসন উদ্যোগ জলবায়ু পরিবর্তনে ঝুঁকিপূর্ণ জনগণকে সহায়তা করবে। অন্যদিকে নগর জলাভূমি পুনরুদ্ধার ও সবুজ নির্মাণ সামগ্রী পরিবেশগত চাপ কমিয়ে আনছে।
বাংলাদেশ অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নকে অগ্রাধিকারের শীর্ষে রেখেছে উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ক্ষুদ্রঋণ ও সামাজিক ব্যবসায় আমাদের অভিজ্ঞতা দেখিয়েছে, আর্থিক অন্তর্ভুক্তি দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী হাতিয়ার।
তিনি বলেন, আমরা এখন নগর উন্নয়নের জন্য একই পদ্ধতি প্রয়োগ করছি, যাতে প্রতিটি নাগরিকের আবাসন, প্রয়োজনীয় পরিষেবা ও অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা যায়। বাংলাদেশ এই লক্ষ্যে তার বৈশ্বিক অংশীদারদের সঙ্গে কাজ করতে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে।
বিশ্বব্যাপী সামাজিক ব্যবসা প্রচার করে আসছেন অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সামাজিক ব্যবসা সম্পর্কে তিনি বলেন, গতানুগতিক উদ্যোগের বিপরীতে সামাজিক ব্যবসা টেকসই ব্যবসায়িক উপায়ে মানব ও পরিবেশগত সমস্যা সমাধানের জন্য পরিকল্পনা করা হয়েছে। এতে ব্যক্তিগত মুনাফা অর্জনের কোনো উদ্দেশ্য নেই। স্বাস্থ্যসেবা থেকে শুরু করে পরিচ্ছন্ন শক্তি, সুপেয় পানি, আবাসনসহ যোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি খাতে এই মডেল জীবন-যাত্রার মান পরিবর্তনের সম্ভাবনা রয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টা বিশ্বনেতাদের, বিশেষ করে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের নেতাদের সকলের জন্য একটি টেকসই বিশ্ব গড়ে তুলতে একসঙ্গে কাজ করার আহবান জানান।
তিনি স্মরণ করিয়ে দেন, জলবায়ু পরিবর্তন, বৈষম্য ও নগরায়ণের চাপের মতো চ্যালেঞ্জগুলো জাতীয় সীমানা ছাড়িয়ে আঞ্চলিক সহযোগিতাকে প্রয়োজনীয় ও অপরিহার্য করে তুলেছে।
অধ্যাপক ইউনূস আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক সহযোগিতার মাধ্যমে একসঙ্গে সমস্যা সমাধান করার আহবান জানান।
তিনি এই প্রসঙ্গে ‘থ্রি জিরো ভিশন’ তথা শূন্য সম্পদ কেন্দ্রীকরণ, শূন্য বেকারত্ব এবং শূন্য নেট কার্বন নির্গমনের কথা তুলে ধরেন।
তিনি এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলোকে একটি টেকসই ভবিষ্যৎ গঠনের জন্য যুব সম্ভাবনা ও উদ্ভাবনকে কাজে লাগানোর আহবান জানান।
গতকাল ব্যাংককে জাতিসংঘ সম্মেলন কেন্দ্রে ইএসসিএপি‘র ৮১তম অধিবেশন শুরু হয়েছে। ‘এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে স্থিতিশীল ও টেকসই নগর উন্নয়নে আঞ্চলিক সহযোগিতা’ শীর্ষক এই অধিবেশনে ৫৩টি সদস্য রাষ্ট্র এবং নয়টি সহযোগী সদস্য অংশ নিয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদা) ড. আনিসুজ্জামান চৌধুরী ইএসসিএপি‘র অধিবেশনে বাংলাদেশের প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন।