বিশ্বজুড়ে রমজান মাসকে ঘিরে বৈচিত্র্যময় সব আয়োজন

2

গাজী মোহাম্মদ নুরউদ্দিন

বছর ঘুরে আবার এসেছে পবিত্র রমজান মাস। মুসলিম বিশ্বের জন্য এক মহিমান্বিত মাস রমজান। পবিত্র রমজান ইসলাম ধর্ম সারা বিশ্বের মুসলমানদের এক সুতায় গেঁথেছে। তবে সংস্কৃতির ভিন্নতার কারণে দেশে দেশে মুসলমানদের নানা সামাজিক আচার পালনে রকমফের রয়েছে। মানুষে মানুষে সৌহার্দ্য ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধন দৃঢ় করাই রমজানের বার্তা। রমজান মাসের ধর্মীয় বিধিবিধান সব মুসলমানের জন্যই অভিন্ন। তবে সংস্কৃতির বৈচিত্র্যের কারণে এ মাস ঘিরে দেশে দেশে রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন ঐতিহ্য বা রেওয়াজ, যা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে চর্চিত হয়ে আসছে।
সংযুক্ত আরব আমিরাতে রমজানের উৎসব শুরু হয়ে যায় দুই সপ্তাহ আগে থেকেই। বাহারি পোশাক পরে দলে দলে শিশুরা নেমে আসে সড়কে। সংগ্রহ করে মিষ্টান্ন। এ সময় তাদের কণ্ঠে থাকে সমবেত গান, ‘আমাদের দিন। মহান আল্লাহ আপনাকে উত্তম প্রতিদান দেবেন। পবিত্র মক্কা শরিফ সফর করার তৌফিক দেবেন।’ রমজানকে স্বাগত জানাতে শিশুদের অংশগ্রহণে এ রেওয়াজের নাম হক আল লায়লা। এর প্রধান উদ্দেশ্য পবিত্র রমজান সম্পর্কে সাধারণ মানুষ ও শিশুদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করা।
প্রায় কাছাকাছি ধরনের আরেকটি রেওয়াজের নাম কারকারিয়ান, যা উদ্‌যাপিত হয় কুয়েতে। তবে রমজানের আগে নয়, পবিত্র মাসটি শুরুর পর মোট তিন দিন উদ্‌যাপন করা হয় এ উৎসব। শিশুরা ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরে গান গাইতে গাইতে মিষ্টি সংগ্রহ করে। এখানে ছেলে ও মেয়েদের জন্য রয়েছে পৃথক গান। এর মধ্য দিয়ে শিশুরা রমজান মাসের গুরুত্ব সম্পর্কে শিখতে পারে। আর যে শিশু প্রথমবারের মতো রোজা রেখেছে, তাকে মিষ্টিমুখ করিয়ে উৎসাহিত করা হয়। ইন্দোনেশিয়ার একটা সংস্কৃতি হলো রমজান শুরুর আগে নিজের শরীর-মনকে পরিশুদ্ধ করে নেওয়া। স্থানীয় মানুষ প্রাকৃতিক পরিবেশে থাকা পুকুরে অনেকক্ষণ ধরে গোসল করে নেন। শরীরে জমে থাকা ময়লা পরিষ্কার করে নিজেকে সাফসুতরো করেন। এতে মনও তাজা হয়ে ওঠে। মূলত এটি রমজান শুরুর আগে ব্যক্তির নিজের একধরনের প্রস্তুতি। বহু বছর ধরে চলা এ প্রথার নাম পাদুসান। ইন্দোনেশিয়ার জাভা প্রদেশে নেকার নামে আরেকটি প্রথা রয়েছে। রমজান শুরুর আগেই জাভার মুসলমানরা মৃত স্বজনদের জন্য দোয়া করেন। জাভাবাসীর প্রাচীন বিশ্বাসমতে, রমজান হলো পুরোনো জীর্ণতাকে পেছনে ফেলে নতুন জীবনচক্রের শুরু।ইন্দোনেশিয়ার মানুষ ইফতারে ছোট সামুদ্রিক মাছ ভেজে নেয়। এরপর তা বাদাম দিয়ে পরিবেশন করেন। সঙ্গে বিন ও চিকেন দিয়ে করে বারবিকিউ। ফ্রাইড রাইস থাকে। শরবত আলাদা করে তেমন বানান না। বাজারে বিভিন্ন ড্রিংকস কিংবা ডাবের পানি থাকে।
বিশ্বজুড়ে রমজানে যদি কোনো রঙিন, চমৎকার প্রথা থাকে, তার একটি হলো ফানাস। এটি উদ্‌যাপিত হয় প্রাচীন সভ্যতার দেশ মিসরে। রমজানে ঘরবাড়ি, সড়ক আলোকিত করা হয় রঙিন লন্ঠন জ্বালিয়ে। বিচিত্র ধরনের নকশা, ধাতু ও কাচের লন্ঠন জ্বালানো হয় এ মাসে। দেশটিতে রমজানের প্রতীক হয়ে উঠেছে এই রঙিন লন্ঠন।পবিত্র রমজানে কিছু নিঃস্বার্থ মানুষ সাহ্‌রির সময় রোজাদারদের ডেকে তোলেন। কোথাও হালকা ড্রাম বাজিয়ে, কোথাও ভক্তিমূলক গানের মধ্য দিয়ে, কোথাও দুভাবেই। একসময় পুরান ঢাকায় কাসিদা সংগীতের মধ্য দিয়ে রোজাদারদের ঘুম ভাঙানো হতো। মিসরে যাঁরা এমন কাজের সঙ্গে যুক্ত, তাঁদের বলা হয় মেশাহারাতি। তাঁরা হালকা শব্দে ড্রাম বাজিয়ে পাড়াময় ঘুরে বেড়ান। মিসরীয়রা পরিবারের সবাই মিলে ইফতার করতে পছন্দ করেন। রোকাক নামে একটা মচমচে ভাজা টোস্ট, যা তৈরি হয় মাংস দিয়ে, ইফতারিতে খুব জনপ্রিয়। এ ছাড়া ‘ফুল মেদেমাস’ ও বাদামি রুটি খেয়ে থাকেন তাঁরা। ফুল মেদেমাস আসলে মটরশুঁটি, টমেটো ও বাদাম দিয়ে তৈরি একধরনের খাবার। এটি রান্না করা হয় অলিভ অয়েল দিয়ে। মিসরীয়দের ইফতারে হাঁসসহ নানা ধরনের মাংসের পদ থাকে।
আফ্রিকার শেষ সীমান্তে সাগর পাড়ের দেশ মরক্কো। সেখানকার অধিবাসীরা সাহ্‌রি খাওয়ার জন্য স্থানীয় অনেক পরিবারের কাছ থেকে নিমন্ত্রিত হন। বকশিশও জোটে। এ প্রথা মরক্কোতে বেশ জনপ্রিয়। সেখানে এই স্বেচ্ছাসেবকরা পরিচিত নাফার নামে। ঐতিহ্যবাহী গান্দোরা (একধরনের হ্যাট) পরে, পায়ে চপ্পল গলিয়ে নাফাররা বেরিয়ে পড়েন রোজাদারদের নিদ্রা ভাঙাতে। তাঁদের সুমধুর ধর্মীয় গানের সুর ছড়িয়ে পড়ে এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ে। নাফার হিসেবে নির্বাচিত করা হয় সবচেয়ে সহানুভূতিশীল ও সৎ মানুষদের। রমজানের শেষ রাতে নগরবাসী কৃতজ্ঞতাস্বরূপ নাফারদের পুরস্কৃত করেন। পবিত্র রমজানে বিভিন্ন দেশে ঐতিহ্যবাহী নানা ধরনের খেলাধুলাও চলে। ইরাকে মেইবেস নামের একটি খেলার প্রচলন আছে, যা শুরু হয় ইফতারের পরে। দুই দলে ভাগ হয়ে খেলাটি চলে। প্রতিটি দলে ৪০ থেকে ২৫০ জন পর্যন্ত অংশ নেন। এটি হলো আংটি লুকানো খেলা। খেলাটি শুরু হয় এভাবে: প্রথমে দলনেতা তাঁর দলের যেকোনো একজনের হাতে গোপনে আংটিটি দেন। আংটিটি কার হাতের মুঠিতে আছে, প্রতিপক্ষ দলকে তা খুঁজে বের করতে হয়। যুগ যুগ ধরে খেলাটি প্রচলিত। একেবারেই আনন্দের জন্য খেলাটি খেলেন সাধারণ ইরাকিরা।ইরাকে শুকনো অ্যাপ্রিকট ও তেঁতুল দিয়ে একধরনের শরবত বানানো হয়। ইফতারে সবার পছন্দ এই শরবত, যা দূর করে সারা দিনের তৃষ্ণা।
কামান দেগে ইফতারের সময় ঘোষণার প্রথা আরবের বহু দেশে প্রচলিত রয়েছে। মিদফা নামে লেবাননে এ ঐতিহ্য চলছে ২০০ বছর ধরে। তবে এর উৎপত্তি মিসর থেকে। জনশ্রুতি আছে, খোশ কদম নামের এক অটোমান শাসক তাঁর অস্ত্রভান্ডারে আসা নতুন একটি কামান পরীক্ষা করতে গিয়ে ঘটনাক্রমে দেগে দেন। তখন ছিল রমজান মাস এবং সূর্যাস্তের সময়।
পশ্চিমাকাশে কামানের গোলা নিক্ষেপের শব্দ শুনে নগরবাসী মনে করলেন, ইফতারের সময় হলো বুঝি। তাঁরা দলে দলে রাজপ্রাসাদে এসে শাসকের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন অভিনব উপায়ে তাঁদের রোজা খোলার বার্তা দেওয়ার জন্য। এরপর ওই শাসকের কন্যা হাজা ফাতমার অনুরোধে প্রতিবছরই কামান দেগে ইফতারের সময় ঘোষণার প্রথা চালু হয়। বর্তমানে আরও একাধিক আরব দেশ এ প্রথা অনুসরণ করে।
ইফতারে সৌদিরা ‘অ্যারাবিক কফি’ পান করেন। আর খেজুর তো থাকেই। সুপ, ভাজা অথবা বেক করা নানা রকম পুর ভরা পেস্ট্রি খেয়ে থাকেন তাঁরা। আর সৌদির পূর্বাঞ্চলের লোকেরা ইফতারে সালুনা নামের একটি খাবার খান, যা মাংস ও সবজির স্টু দিয়ে তৈরি। নানা ধরনের হালুয়া আরবের ইফতারে অন্যতম প্রধান বিষয়। এছাড়াও থাকে ২ ধরনের রুটি। বড় রুটিটিকে বলা হয় ‘তমিজ’, অপেক্ষাকৃত ছোট ও ভারি রুটির নাম ‘খবুজ’। থাকে ‘সাম্বুচা’ নামের একটি খাবারও। যার সঙ্গে নাম ও ধরনের মিল রয়েছে আমাদের অতি পরিচিত সমুচার। এই সমুচায় মরিচ ছাড়াই মাংসের কিমা ভর্তি থাকে। ঝাল-মিষ্টির সঙ্গে স্বাস্থ্যের ভারসাম্য ঠিক রাখতে সালাতা নামের সালাদটিও আরব দেশের ইফতারে অন্য মাত্রা যোগ করে। তাছাড়া পানীয় হিসেবে সরবা বা শরবত আর দুগ্ধজাত লাবান তো থাকেই। লেবাননে ইফতারের সময় ঘোষণা করতে প্রতিদিনই কামান দাগা হয়। ইফতারে ফাত্তুশ সালাদ নামে জনপ্রিয় একটি খাবার তাঁদের পছন্দ। গাজর, টমেটোসহ সব রকমের মৌসুমি ফল দিয়ে খাবারটি তৈরি হয়। এর ওপরে আবার ছড়িয়ে দেওয়া হয় রুটির টুকরা। মধ্যপ্রাচ্যের আরেক দেশ জর্ডানের মুসলমানদের ইফতার শুরু হয় দধি, স্যুপ ও জুস দিয়ে। তাঁদের প্রিয় একটি খাবারের নাম মানসাফ। ভেড়ার মাংস দিয়ে তৈরি খাবারটি পরিবেশন করা হয় অ্যারাবিক রুটি বা ভাত সহযোগে।
ইফতারে ইরানের ঘরে ঘরে তৈরি হয় জাফরানের ঘ্রাণযুক্ত একধরনের হালুয়া। আর নামাজ শেষে তারা খায় স্যান্ডউইচ, মিষ্টি চা, তাবরেজি চিজ। আশ রাসতেহ নামে একটি ঘন সবজির স্যুপও সেখানে ইফতারের সময় আগ্রহ নিয়ে খাওয়া হয়। তুরস্কে ‘রমজান কিবাবি’ নামক খাদ্যটির ইফতার হিসেবে আলাদা কদর রয়েছে সেখানে। এটা বিশেষ ধরনের কাবাব। এ ছাড়া রোজা ভাঙতে এখানে নানা রকম শরবতের ব্যবহার বেশ পুরনো।
ইফতারকে মালয়েশিয়ানরা বলেন ‘বারবুকা পুয়াসা’। খেজুর ও পানি দিয়ে ইফতার শুরু করেন তাঁরা। বান্দুং ড্রিংক, আখের রস, সয়াবিন মিল্ক নামের রকমারি পানীয় থাকে। ভারী খাবারের মধ্যে থাকে চিকেন রাইস, নাসি লেমাক, লাকসা। মালদ্বীপের মুসলমানরা ইফতারে গারুধিয়া নামে একটি খাবার খেয়ে থাকেন। এটা একটা মাছের পদ, যা পরিবেশন করা হয় ভাত, লেবু, মরিচ ও পেঁয়াজ দিয়ে। আরেকটি জনপ্রিয় খাবারের নাম কুলহি বোয়াকিবা। এটা একটা ঝাল ঝাল ফিশ কেক। আরেকটি খাবারের নাম থারিদ, যা বানানো হয় চাল ও গরু বা খাসির মাংস দিয়ে।
শ্রীলঙ্কার মুসলমানদের ইফতারে বিভিন্ন খাবারে নারকেলের দুধের ব্যবহার বেশি। এ ছাড়া আদিক নামে একটি রুটি তাঁরা খেয়ে থাকেন। ভারতে ঐতিহ্যবাহী হায়দরাবাদ শহরে ইফতার শুরু হয় সুস্বাদু হালিম দিয়ে। অপর দিকে কেরালা ও তামিলনাড়ুর মুসলমানরা ইফতার করেন নমবু কাঞ্জি নামে একধরনের খাবার দিয়ে। মাংস, সবজি ও পরিজ দিয়ে প্রস্তুত করতে হয় খাবারটি। সঠিক স্বাদ পেতে চুলায় দীর্ঘক্ষণ বসিয়ে রাখতে হয়। উত্তর ভারতে পথের খাবার খুবই জনপ্রিয়। ইফতারের সময় এসব দোকানে ভিড় লেগে যায়। নানা রকম খাবারের পাশাপাশি ফ্রুট সালাদ তো থাকেই। এ ছাড়া দিল্লি, উত্তর প্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গে ইফতারের শুরুতে থাকে খেজুর, তাজা ফল, ফলের রস। এরপর পাকোড়া, সামোসার মতো ভাজা আইটেম। প্রসঙ্গত, ভারতে মুসলমানদের একটি অংশ মসজিদেই ইফতার করেন। দক্ষিণ আফ্রিকায় নানা জাতির বাস। সেখানে মুসলমানদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভারতীয়। এরপর পাকিস্তানি, বাংলাদেশি, মিসরীয় ও আলজেরীয়দের স্থান। সবাই ইফতারে যাঁর যাঁর দেশের-সংস্কৃতির খাবারে খেয়ে থাকেন। নিউইয়র্কের বাঙালি এলাকায় একেবারে ঢাকার বাজারের মতোই ইফতারির হাট বসে। সেখানে ছোলা, পেঁয়াজি, বেগুনি, পাকোড়া, হালিম, জিলাপি, বুরিন্দা- সবই পাওয়া যায়। ইফতারে এসবই খাওয়া হয়। এছাড়া নতুন প্রজন্মের তরুণেরা ইফতারে কিছুটা আমেরিকান ধরনের খাবার, যেমন বার্গার, পাস্তা, সিরিয়াল, ফ্রুট কাস্টার্ড, সালাদ খেয়ে থাকে। উল্লেখ্য, সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের আমল থেকে রমজান মাসে হোয়াইট হাউসেও ইফতারের আয়োজন করা হয়। এটা বর্তমানে সেখানকার একটি প্রথা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেখানে বিভিন্ন দেশের মুসলিম প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করেন। ইফতারিতে ব্রিটিশ রোজাদাররা খেজুর, ফল, স্যুপ, জুস, রুটি, ডিম, মাংস, চা-কফি ইত্যাদি গ্রহণ করে থাকে।
স্পেন এটি একসময় মুসলমানদের দেশ থাকলেও বর্তমানে এখানে মুসলমানের সংখ্যা মাত্র ৪.১ শতাংশ। এখানকার মুসলিমরা ইফতারিতে হালাল শরমা, ডোনার কাবাব, হামাস (যা তৈরি করা হয় ছোলা, তিল, জলপাই তেল, লেবু, রসুন ইত্যাদি দিয়ে। এটি মূলত মধ্যপ্রাচ্যের খাবার।), লাম্ব কোফতা, আলা তুরকা, পাইন অ্যাপেল, টমেটো সালাদ ইত্যাদি খেয়ে থাকেন। এ ছাড়া রয়েছে খিচুড়ি, বিরিয়ানি, যা সেখানে অবস্থানরত ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের প্রবাসীরা খেয়ে থাকেন।
লেখক : গবেষক ও ডেপুটি রেজিস্ট্রার,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার