মোহাম্মদ মন্জুরুল আলম চৌধুরী
পানি বিষয়ে সচেতনতা ও গুরুত্বকে তুলে ধরার লক্ষ্যে “হিমবাহ সংরক্ষণ” প্রতিপাদ্য নিয়ে গেল ২২ মার্চ’২৫ বাংলাদেশেও “বিশ্ব পানি” দিবস যথাযথ মর্যাদায় পালিত হয়েছে যা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলা ও নিরাপদ পানির ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার ওপর গুরুত্বারোপ করে। হিমবাহ মানবজীবনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বের হিমবাহ গুলি থেকে যে গলিত জল পাওয়া যায় তা সারা বছর ধরে পানীয় জল, কৃষি, শিল্প, শক্তি উৎপাদন এবং সুস্থ বাস্তুতন্ত্রের জন্য কাজে লাগে। “কর্ণফুলী নদীর কালুরঘাট থেকে রাঙ্গুনিয়ার চন্দ্রঘোনা ফেরিঘাট পর্যন্ত ৩০কিলোমিটার এলাকা মিঠা পানির রিজার্ভার হিসেবে সংরক্ষিত। কর্ণফুলী ও হালদা নদীর পানি পরিশোধন করে চট্টগ্রামে সরবরাহকৃত পানির ৯২% যোগান দেয়া হয়। কিন্তু দিনে দিনে লবণাক্ততা বাড়তে থাকায় হুমকির মুখে পড়েছে কর্ণফুলীর মিঠা পানির রিজার্ভার।[সূত্রঃ দৈ/পূর্বদেশ, ২২মার্চ’২৫}। জানা যায় কর্ণফুলী নদী ভরাট ও কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের পানি নির্গমন কম হওয়ার কারণেই লবণাক্ততা বাড়ছে। এক তথ্য থেকে জানা যায়, “চট্টগ্রামে পানি আছে। নদ-নদী, খাল-বিল, পুকুর-জলাশয়ও আছে। পাইপলাইনে চট্টগ্রাম ওয়াসার সরবরাহকৃত পানিও আছে নগর জুড়ে। আছে গভীর–অগভীর নলক‚পও। এর মাঝেও বড় সংকট সুপেয় পানির। পানীয়জল বলে সহজে চেনা খাওয়ার পানির দুশ্চিন্তায় থাকতে হয় চট্টগ্রাম নগরীর বসবাসরত ৭০ লাখ মানুষকে। ঘরে-বাইরে পানির জন্য রীতিমতো লড়াই করতে হয় প্রতিনিয়ত”। দুঃখের বিষয় হচ্ছে, প্রতি বছরের মতো চলতি বছরও শুষ্ক মৌসুমে যখন পানীয় জলের চাহিদা বেড়েছে, ঠিক তখনই ওয়াসার সবগুলো প্রকল্পের পানির উৎসস্থল কর্ণফুলী ও হালদা নদীর পানিতে লবণাক্ততার পরিমাণ বেড়ে গেছে সীমাহীন। যা মানব দেহের সহনীয় মাত্রার চেয়ে ৭-৮ গুণের বেশি। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, “অতিরিক্ত লবণাক্ত পানি খেলে কিডনি বিকল ও রক্তচাপ বেড়ে যেতে পারে। পাশাপাশি শরীরে ইলেক্ট্রোলাইটসের ভারসাম্য রক্ষা না হওয়ার কারণে বিশেষ করে রক্তে সোডিয়ামের মাত্রা বেড়ে গিয়ে নানা ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকে”। পাশাপাশি শিল্প কারখানার দূষিত তরলবর্জ্য, পয়োঃবর্জ্য ও গৃহস্থালি বর্জ্যে কর্ণফুলী-হালদাসহ চট্টগ্রামের খাল-নদী-নালাসহ প্রাকৃতিক জলাশয়ের পানি ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। তাছাড়া দিন দিন ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচের দিকে নেমে যাওয়ায় বিশুদ্ধ পানির সংকট প্রকট হচ্ছে। অপর এক সূত্র থেকে জানা যায়, “পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রাণ প্রকৃতি পরিবেশ ও প্রতিবেশের অন্যতম গুরত্বপূর্ণ উপাদান পাহাড়ি ছড়া ও ঝিরি। দুর্গম পাহাড়ের বাসিন্দারা মূলত ছড়ার পানির উপর নির্ভরশীল। শুষ্ক মৌসুম আসলেই পানির প্রবাহ নষ্ট হয়ে মারা যায় অধিকাংশ ঝিরি ও ছড়া। ছড়ার আশপাশের নির্বিচারে গাছ কেটে পাহাড় ন্যাড়া করার কারণে বিনষ্ট হয়েছে পানির উৎস। ঝিরি ও ছড়ায় পানির প্রবাহ না থাকায় বিপাকে পরে স্থানীয়রা” । এক তথ্য থেকে জানা যায়, খাগড়াছড়ির দীঘিনালার নয় মাইল এলাকায় পাড়ার নীচে বেতছড়ি ঝিরি রয়েছে। আট মাইল এলাকা থেকে ঝিরিটির উৎপত্তি হয়েছে। এখন ঝিরিতে পানি একেবারে কমে এসেছে। সামনে বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে পানির প্রবাহ আরো কমে তা মৃতপ্রায় ঝিরিতে পরিণত হবে। ঝিরি শুকিয়ে যাওয়ার অন্যতম কাজ হলো প্রাকৃতিক বন কমে আসা। পাহাড়ে পাদদেশে ঘন বন থাকলে সেখানে পানির প্রবাহ শুষ্ক মৌসুমেও থাকে। কিন্ত এখানে প্রাকৃতিক বন তো নেই। প্রচুর সেগুন বাগান আছে। সেগুন পানি শোষণকারী বৃক্ষ। ফলে সেগুনের পাশে লাগোয়া ঝিরিগুলোতে পানির প্রবাহ কমে যায় বা একেবারে থাকে না”। পরিবেশবাদীরা বলছে, “নির্বিচারে বন উজাড় এবং সেগুনসহ বিভিন্ন বিদেশী প্রজাতির গাছের মনোকালচারের কারণে ছড়া শুকিয়ে যাচ্ছে। যেখানে ঘন বন আছে সেখানে পানির প্রবাহ ভালো রয়েছে। এভারগ্রিন ফরেস্ট যদি ফিরিয়ে আনা যায় তাহলে ঝিরি ছড়াগুলোকে বাঁচিয়ে রাখা যাবে”। খাগড়াছড়ির বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. ফরিদ মিঞা এক পত্রিকাকে জানান, সা¤প্রতিকালে গাছপালা কেটে পাহাড় ন্যাড়া করে কৃষি কাজ করার পাশাপাশি বাণিজ্যিক প্রজাতির বৃক্ষ রোপণ করার প্রবণতা বেড়েছে। এতে মাটির পানির ধারণ ক্ষমতা কমে যায়। পুরো পাহাড় ন্যাড়া করে কৃষির আবাদ করায় এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। দেশীয় প্রজাতির চিরসবুজ বৃক্ষ দিয়ে বনায়ন করার জন্য বন বিভাগ সচেতনতা সৃষ্টি করছে বলে জানিয়েছেন এই কর্মকর্তা। তিনি বলেন, বন হচ্ছে পানির আঁধার। বনায়ন করতে দেশীয় মিশ্র প্রজাতির বৃক্ষ রোপণ করতে হবে। তবে পুনরায় বন ফিরিয়ে আনতে সময় লাগবে। পার্বত্য চট্টগ্রামের ঝিরি ও ছড়ায় প্রাণ ফেরাতে প্রাকৃতিক বন পুনরুজ্জীবতকরণের দাবি পরিবেশবাদী ও স্থানীয়দের।
এদিকে “চট্টগ্রাম ওয়াসার প্রকৌশলীরা জানান, শুষ্ক মৌসুমে হালদা নদীতে কাপ্তাই লেকের পানি প্রবাহ কমে যাওয়ার কারণে জোয়ারের সময় কর্ণফুলীর লবণাক্ত পানি হালদা নদীতে প্রবেশ করছে। যার কারণে চট্টগ্রাম ওয়াসার পানি উৎপাদন এখন দৈনিক ৭ থেকে ৮ কোটি লিটার কমে গেছে। বৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত হালদায় লবণাক্ততার পরিমাণ কমার সম্ভাবনা নেই। পাশাপাশি চট্টগ্রাম নগরীর দক্ষিণ কাট্টলী হালিশহর পাঠানটুলী মোগলটুলী ধলিয়ালা পাড়া, রঙ্গিপাড়াসহ বিশাল একটি অংশে পানির সঙ্কট তীব্র থেকে তীব্র হচ্ছে। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে চলে যাওয়ায় সুপেয় পানির জন্য সারা বছরই অস্থির থাকতে হয় চট্টগ্রাম ও তিন পার্বত্য জেলার মানুষকে। অন্যদিকে ভরা বর্ষায় বিপদ হয়ে আসে বন্যা-জলোচ্ছ¡াসের দূষিত পানি। দুই মৌসুমেই নিরাপদ পানির জন্য থাকতে হয় উদ্বেগ ও অনিশ্চয়তায়। সুপেয় পানির যতটুকু জোগান মেলে, তার বিনিময় মূল্য সংস্থানেও দেশের বড় জনগোষ্ঠীকে উৎকণ্ঠায় থাকতে হয়। শহরে কেনা ফিল্টারড বা বোতলের পানিও কতটা নিরাপদ, তা সকলের জানা। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাইপলাইনের মাধ্যমে সরবরাহকৃত পানি সরাসরি পান করা গেলেও বাংলাদেশে সরবরাহকৃত পানি না ফুটিয়ে বা ফিল্টারে না দিয়ে কেউ পান করতে সাহস পান না। খাবার ও অন্যান্য পণ্যের মতোই সুপেয় পানির খরচ মেটানো কঠিন হয়ে পড়ে অনেকের জন্য। এমন পরিস্থিতিতে বিশ্ব পানি দিবসে দেশের মানুষের ভোগান্তি অস্বস্তি শঙ্কার শেষ নেই। আশার বিষয়, “কর্ণফুলী নদীর কালুরঘট থেকে রাঙ্গুনিয়ার চন্দ্রঘোনা ফেরিঘাট পর্যন্ত ৩০ কিলোমিটার এলাকা মিঠা পানির রিজার্ভার হিসেবে সংরক্ষিত এলাকাটা সুরক্ষিত রাখার কাজ শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে ১০ কিলোমিটার ড্রেজিং শেষ হয়েছে। বাকী অংশ ড্রেজিং করা গেলেই পানির স্রোত বেড়ে কালুরঘটের উপরে লবণাক্ত পানি যেতে পারবে না” {সূত্রঃ পূর্বদেশ, ২২মার্চ’২৫}। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, “উজানে আন্তদেশীয় নদীর ওপর একতরফা বাঁধ নির্মাণ, নতুন বনায়ন বৃদ্ধি না করে ব্যাপক হারে বৃক্ষ কর্তন, নদ-নদী নিয়মিত খনন না করা, অপরিকল্পিত ড্রেনেজ সিস্টেম, নতুন করে জলাধার তৈরি না করা ও সর্বোপরি নির্বিচার ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের ফলে নানাবিধ পরিবেশগত বিপর্যয় সৃষ্টি হচ্ছে।৩০ বছর আগে যেখানে ৪০-৫০ ফুট গভীরতায় পানি পাওয়া যেত, তা এখন প্রায় ১৫০-১৬০ ফুট গভীরতায় মিলছে।এ হারে পানির স্তর নিচে নামতে থাকলে ২০৩৫ সালের পর হয়তো ২৫০ ফুট গভীরতায় পানি পাওয়া যাবে না বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। ফলে পানিদূষণ, পানি উত্তোলন খরচ, চাষাবাদ খরচ বাড়বে এবং কৃষিপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি পেয়ে নি¤œ ও মধ্যবিত্তের ক্রয়সীমার বাইরে চলে যেতে পারে”{সূত্রঃ প্র/আলো,২২ মার্চ’২৫}। উদ্বেগের বিষয়, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর রক্ষায় আশু স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ এবং বাস্তবায়ন অতীব জরুরি। প্রধানতম সমস্যার মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তন ও নির্বিচার ভূগর্ভের পানির উত্তোলনের প্রভাবে দেশের উত্তর ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে মরুকরণের ভয়াবহ আশঙ্কা বিদ্যমান। কেননা দেশজুড়ে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নামছে। দুই বছর আগে পানি উন্নয়ন বোর্ড এক গবেষণায় উল্লেখ করেছিল, দেশের দুই-তৃতীয়াংশ এলাকায় পানির স্তর নেমে যাচ্ছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি নামছে ঢাকা নগর, গাজীপুর ও বরেন্দ্র অঞ্চলে। পানি কমলেও যে হারে পানি উঠছে, তার পুনর্ভরণ বা রিচার্জ হচ্ছে না। রাজধানী বা দেশের অন্যত্র পুনর্ভরণে পাইলট বা সাময়িকভাবে প্রকল্প নেওয়া হলেও সেগুলো তেমন কার্যকর নয়। সবচেয়ে বেশি ভূগর্ভস্থ পানি সংগ্রহ করা ঢাকা ওয়াসার পুনর্ভরণ প্রকল্পের কোনো গতি নেই। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, পুনর্ভরণ কমতে থাকলে উত্তরের জনপদের দশা দেশের অন্যত্রও হতে পারে।
নদীর পানির লবণাক্ততা বৃদ্ধি, নদীর পানি দূষণ দখল, বন উজাড়, পানির স্তর কমে যাওয়াসহ বহুমাত্রিক কারণে সমতল এবং পাহাড়ি এলাকার ঝরনা রক্ষা সুপেয়, মিঠা এবং ব্যবহার্য পানির উৎস ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে যা মানব জীবনের অপরিহার্য পানি দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠছে।ফলে পানির সুষ্টু ব্যবস্থাপনা নদী সুরক্ষা বন রক্ষা নদী দূষণ ভরাট রোধ করা অতীব জরুরি হয়ে উঠেছে। পানিসম্পদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা জলবায়ু পরিবর্তন সহিষ্ণু উন্নত প্রযুক্তি উদ্ভাবন এবং তা যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় এবং এর অধীনস্থ সংস্থাসমূহ কাজ করে গেলেও তা খুব একটা কার্যকর সুফল দিচ্ছে বলে দৃশ্যমান হচ্ছে না।পাশাপাশি বেপরোয়া বন উজাড়, পাহাড় কাটা কোনোমতেই বন্ধ করা যাচ্ছে না। নদীমাতৃক এই বাংলাদেশে পানি এবং টেকসই উন্নয়ন একে অপরের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। একথা অনস্বীকার্য, পানি ছাড়া মানুষের জীবন অচল। পাশাপাশি জলবায়ু ও প্রকৃতি যা মানবজীবন ও জীবিকার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ফলে স্বাভাবিক প্রবাহের জন্যও পানি অত্যাবশ্যকীয়।বলা হয়ে থাকে – পানির অপর নাম জীবন।ব্যবহার্য এবং সুপেয় পানির প্রাপ্যতা এবং সংগ্রহের ক্রমবর্ধমান সঙ্কট যেকোনো সময় মানবিক বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।
লেখক : প্রাবন্ধিক