বিবিসির প্রতিবেদনে আয়নাঘরের ভয়াবহ চিত্র উঠে এলো

1

পূর্বদেশ ডেস্ক

রাজনৈতিকভাবে ভিন্নমত সহ্যই করতে পারতেন না ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা ও তার সরকার – এ কথা সবারই জানা। সাবেক বন্দি, বিরোধী মতাবলম্বী এবং তদন্ত কর্মকর্তারা বলেছেন, হাসিনার সমালোচনা করলে কোনো ধরনের চিহ্ন ছাড়াই ‘উধাও’ হয়ে যাওয়ার শঙ্কা থাকতো। অনেকের ঠাঁই হতো ‘আয়নাঘর’ খ্যাত গোপন বন্দিশালায়। আওয়ামী শাসনের গত ১৫ বছরে এভাবেই বহু মানুষ গুম হয়েছেন।
গণঅভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পর দেশজুড়ে অনেক ‘আয়নাঘর’ বা গোপন টর্চারসেলের সন্ধান মেলে। শত শত বন্দির মুক্তি মেলে তখন।
গতকাল বুধবার ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির এক প্রতিবেদনে প্রকাশ, ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে পাথর ছোঁড়া দূরত্বেই সন্ধান মেলে আয়নাঘরের। সেখানের গোপন কক্ষগুলোর একটিতে দীর্ঘ আট বছর আটকে রেখে নির্যাতন করা হয়েছিল ব্যারিস্টার মীর আহমদ বিন কাসেমকে। কারাগারে বেশিরভাগ সময়েই চোখ বেঁধে রাখা হতো তার। তবে বিমান অবতরণের শব্দ শুনতে পেতেন তিনি। তার বর্ণনা থেকে তদন্তকারীরা বিমানবন্দরের খুব কাছে নির্মিত সেই আয়নাঘর আবিষ্কার করেন। খবর বাংলানিউজের।
তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, বোঝাই যাচ্ছিল ইটের তৈরি নতুন দেয়াল ছিল এই আয়নাঘরকে দৃষ্টির আড়ালে রাখার অপচেষ্টা। এমনভাবেই ঘরগুলো লুকিয়ে রাখা হয়েছিল যে, সেখানে দীর্ঘবছর অন্তরীণ থাকা মীর আহমদ বিন কাসেমের স্মৃতির সহযোগিতা না নিলে হয়তো তারা কখনও এই গোপন কারাগার খুঁজে পেতেন না।
তদন্তকারীরা বলছেন, ঢাকা বিমানবন্দর থেকে রাস্তার ওপারে খুঁজে পাওয়া গোপন কারাগারটি র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) – এর কিছু সদস্যদের দিয়ে পরিচালিত হতো, যারা সরাসরি হাসিনার নির্দেশে কাজ করছিলেন।
চল্লিশ বছর বয়সী এই আইনজীবী প্রথমবারের মতো গণমাধ্যমের সামনে আয়নাঘরে তার বন্দিদশার বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরলেন। তিনি তদন্তকারীদের জানান, এই কক্ষেই তাকে আট বছর ধরে আটকে রাখা হয়েছিল। ঘরটিতে ছিল না কোনো জানালা বা এমন কোনো ছিদ্র ছিল না যা দিয়ে দিনের আলো প্রবেশ করতে পারে। আলো দেখতে না পারায় কাসেম দিন-রাতের পার্থক্য বুঝতেন না তিনি।
তাকে কেন গুম করা হয়েছিল প্রশ্নে তার বিশ্বাস, পারিবারিক রাজনীতির কারণে তাকে গুম করা হয়েছিল। ২০১৬ সালে তিনি তার বাবা মীর কাসেমের প্রতিনিধিত্ব করছিলেন, যিনি বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর একজন সিনিয়র সদস্য ছিলেন, যাকে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল।
বিন কাসেম ছাড়াও আয়নাঘর থেকে বেঁচে ফেরা আরও পাঁচ ব্যক্তি বিবিসিকে জানিয়েছেন, তাদের তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল চোখ বেঁধে এবং হাতকড়া পরিয়ে অন্ধকার কংক্রিটের কক্ষে রাখা হয়েছিল। যেখানে বাইরের জগৎ সম্পর্কে কিছুই জানার উপায় ছিল না। অনেক ক্ষেত্রেই তাদের মারধর ও নির্যাতন করা হয়েছিল।
তাদের প্রায় সবাই বলেছেন, মুক্ত বাতাসে নিঃশ্বাস নিতে পারলেও তারা এখনও ভয় পাচ্ছেন যে, কখন যেন রাস্তায় বা বাসে তাদেরকে অপহরণ করা ব্যক্তির সঙ্গে ধাক্কা লেগে যায়!
এমনই একজন ভুক্তভোগী আতিকুর রহমান রাসেল। ৩৫ বছর বয়সী এ যুবক বলেন, ‘এখন বাসে উঠলে বা বাড়িতে একা থাকাকালে আমি কোথায় ছিলাম তা ভেবে ভয় পাই। কীভাবে আমি বেঁচে গেলাম, আমার কি আসলেই বেঁচে থাকার কথা ছিল! – বার বার এই ভাবনা আসে মাথায়।’
তাকে কেন আটক করা হয়েছিল প্রশ্নে রাসেল বলেন, আমাকে আটকের কারণ রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। কারণ আমি বিএনপির একজন ছাত্রনেতা ছিলাম, আমার বাবাও বিএনপির একজন সিনিয়র সদস্য ছিলেন। আমার ভাই দেশের বাইরে থেকে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের সমালোচনা করে সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট দিতেন।
রাসেলের মতো আয়নাঘরে আটক ও নির্যাতনে শিকার ইকবাল চৌধুরী। তার বিরুদ্ধে ভারত ও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানোর অভিযোগ আনা হয় এবং তিনি বলেন, এ কারণেই তার ওপর নির্যাতন চালানো হয়েছে।
৭১ বছর বয়সী এ বৃদ্ধ বলেন, আমাকে ইলেকট্রিক শক দিয়ে শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হয়েছে, মারধর করা হয়েছে। ইলেকট্রিক শকের কারণে এখন আমার একটি আঙুল ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। আমার পায়ের জোর কমে গেছে, শরীরের জোরও কমে গেছে।
২৩ বছরের রহমতুল্লাহও একই আতঙ্কে ভুগছেন। তিনি বলেন, তারা আমার জীবন থেকে দেড় বছর কেড়ে নিয়েছে। ওই সময়টা আর কখনোই ফিরে পাব না। ২০২৩ সালের ২৯ আগস্ট মধ্যরাতে নিজের বাড়ি থেকে রহমতুল্লাহকে উঠিয়ে নেয় র‌্যাব কর্মকর্তারা।
বিবিসির পক্ষ থেকে আরও সাবেক দুই বন্দির সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে। তারা হলেন-মাইকেল চাকমা ও মাসরুর আনোয়ার। তাদের দেওয়া তথ্যে গোপন বন্দিশালা এবং সেগুলোর ভেতরে তাদের সঙ্গে আসলে কী ঘটেছিল, সেসব নিয়ে ধারণা লাভের চেষ্টা করা হয়েছে।
আওয়ামী শাসনামলে আয়নাঘরে কতজন নির্যাতনের শিকার – তার সঠিক সংখ্যা বলা মুশকিল। ২০০৯ সাল থেকে গুমের ঘটনাগুলো চিহ্নিত করে আসছে একটি বাংলাদেশের একটি বেসরকারি সংস্থা। কমপক্ষে ৭০৯ জনকে গুম করার তথ্য নথিভুক্ত করেছে সংস্থাটি। তাদের মধ্যে ১৫৫ জন এখনও নিখোঁজ। গত সেপ্টেম্বরে গুম সংক্রান্ত তদন্ত কমিশন গঠনের পর থেকে তারা ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে ১ হাজার ৬৭৬ টিরও বেশি অভিযোগ পেয়েছেন। আরও মানুষ অভিযোগ নিয়ে আসছেন।
এ বিষয়ে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রধান প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বলেন, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেছেন যে, সমস্ত গুমের ঘটনাগুলো তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনুমোদন, অনুমতি বা আদেশক্রমে হয়েছে। বিমানবন্দরের গোপন কারাগারটি আয়নাঘর হিসেবে ব্যবহার করতো হাসিনা সরকার। সারা দেশে ৫০০, ৬০০ বা ৭০০-এরও বেশি এমন আয়নাঘরের সন্ধান মিলেছে।
এসব গুন-খুনের সঙ্গে সরাসরি আওয়ামী লীগ সরকারই জড়িত বলে বিশ্বাস প্রসিকিউটর তাজুল ইসলামের। তিনি বলেন, এখানে যাদের বন্দি রাখা হয়েছিল, তারা ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক দলের সমর্থক এবং তারা শুধু আগের সরকারের, ওই সময়ের সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলেছিলেন। সেই কারণেই তাদের এখানে নিয়ে আসা হয়েছিল।