ড. মুহাম্মদ মাসুম চৌধুরী
মানুষ মহাকালের যাত্রী। সৃষ্টির সেরাজীব। মানুষ জানে না সামুষের কত শক্তি। মহান আল্লাহ পাক মানুষকে সৃষ্টি করেছেন বিজয়ী হওয়ার জন্য। একদিন ক্লাসে আমাদের ছাত্রছাত্রীদের নিকট প্রশ্ন করলাম, কে কে বড় হতে চাও ? তারা বললো, সবাই বড় হতে চায়। কিন্তু বড় হতে কী প্রয়োজন তারা তা জানে না। বড় হতে বড় কিছুর দরকার নেই। বড় হতে দরকার, শুধু বড় হওয়ার প্রচন্ড ইচ্ছে। দুনিয়ার বড় বড় বিখ্যাত মানুষের নাম বলতে পারি যাদের কিছুই ছিল না, শুধু বড় হওয়ার প্রচন্ড ইচ্ছা তাদের বড় করেছে। কত মেধাবী শিক্ষার্থী পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করে বড় হতে পারেনি, কারণ বড় হওয়ার স্বপ্নের মৃত্যুর কারণ। স্বপ্ন থাকলে সাধারণ মেধাবীটিও বড় হয়। আলবার্ট আইনস্টাইনের ছোটবেলায় কোন কিছু মনে থাকতো না। ভর্তি পরীক্ষায় ফেল আর ফেল করে। নয় বছর এই ভাবে চলতে থাকে। তাঁর বাবার স্বপ্ন ছিল ছেলেকে ইঞ্জিনিয়ার করবে, কিন্তু ছেলের অনুরাগ বিজ্ঞানের প্রতি। প্রচন্ড ইচ্ছায়, শত প্রচেষ্টায় একদিন তাঁর ব্রেইন খুলে যায়। আস্তে আস্তে একদিন তিনিই হয়ে উঠেন আধুনিক বিজ্ঞানীদের সেরা বিজ্ঞানী। মানুষের বৈজ্ঞানিক নাম ‘ঐড়সড় ঝধঢ়রবহং’ অর্থাৎ মানুষ জ্ঞান ক্ষম প্রাণী। মানুষের উন্নয়ন মানুষের মস্তিষ্কেই রয়েছে। চিন্তা কল্পনা জ্ঞান বিজ্ঞানের পাওয়ার পয়েন্ট হলো মানব মস্তিষ্ক। দেহ আর প্রাণ থাকলে প্রাণী হয়, কিন্তু মানুষের থাকে সাথে আত্মা। মানুষই দুই পায়ে ঋজু হয়ে দাঁড়াতে পারে। আর আছে কথা বলার শক্তি ও ভালবাসার মন – মনন। মানুষকে পূর্ণ প্রতিনিধির ক্ষমতা দিয়ে মহান আল্লাহ পাক দুনিয়াতে প্রেরণ করেছেন। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ পাক ইরশাদ করেছেন, ‘হুআল্লাজী জা আলাকুম খলিফা ফিল আরদ’ (সূরা : ফাত্বির, আয়াত : ৩৯)
অর্থাৎ তিনিই তোমাদেরকে পৃথিবীর প্রতিনিধি করেছেন। মহান আল্লাহর প্রতিনিধি হওয়া মানুষের জন্য খুবই সৌভাগ্যের বিষয়। এই প্রতিনিধিত্ব মানব মস্তিষ্কের কারণে। মানুষের মস্তিষ্কের ক্ষমতা মানুষ জানে না। কবি কাজী নজরুল ইসলাম জানতেন বলে তিনি বলতে পেরেছেন। ‘আমি অজানা অসীম পূর্ণতা নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছি। এ আমার অহংকার নয়; আত্মবিশ্বাসের আত্মোপলব্ধির চেতনা লব্ধ সহজ সত্যের সরল স্বীকারোক্তি।’ কবি মানুষকে মাথা তুলে দাঁড়াতে বলেছেন। মাথা তুলে দাঁড়ানো মানে মাথার মধ্যে আছে মস্তিষ্কের প্রচন্ড ক্ষমতা। সে ক্ষমতার বিকাশ ঘটাতে বলেছেন। তাই তিনি উচ্চস্বরে বলেছেন, ‘বল বীর/ বল উন্নত মম শীর / শির নিহারি আমারি / নত শির ওই শিখর হিমাদ্রির। মানুষকে তিনি জেগে উঠার, প্রচন্ড শক্তি বিকাশের আহবান জানিয়েছেন। মানুষ দুর্বল নয়। সবল হয়ে জন্মগ্রহণ করেছে। মানুষের শক্তি আছে মাথা তুলে সোজা হয়ে দাঁড়াবার। কোন বাধাই মানুষের শক্তিকে রোধ করতে পারে না। মানুষ শক্তি নিয়ে মাথা তুলে দাঁড়ালে হিমালা পর্বত মানুষের নিক হত হবে। অন্যায় অবিচার জুলুমের সময় মানুষের বীরত্বের প্রকাশ ঘটানো প্রয়োজন। কবি কাজী নজরুল আরো বলেছেন, ‘মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই। নহে কিছু মহীয়ান।’ একটি শিশুর অন্তরনিহিত শক্তির উন্মোচন ঘটাতে পারলে দুনিয়ার বহু কিছু অজান আর রহস্যময় তার নিকট মনে হয় না। তখন সকল রহস্য ও অজানার বেড়াজাল ছিন্ন করে প্রকৃত রূপ অনুধাবন করতে সক্ষম হয়।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘আজ আমাদের কিসের উৎসব ? শক্তির উৎসব। মানুষের মধ্যে কী আশ্চর্য শক্তি আশ্চার্যরূপে প্রকাশ পাইতেছে, মানুষের উৎসব কবে ? মানুষ যেদিন আপনার মনুষ্যত্বের শক্তি বিশেষভাবে উপলব্ধি করে।’
বাপ দাদার সম্পদ আপনি রক্ষা করতে চাইলে রক্ষা করতে পারবেন না। সে সম্পদ রক্ষার জন্য মস্তিষ্কের ব্যবহার প্রয়োজন হয়। তা ব্যবহার করতে না পারলে হারিয়ে যাবে। সম্পদ রক্ষার বড় সম্পদ মস্তিষ্ক। মানবকে সম্পদে পরিণত করা গরীবের পোলাও খাওয়ার স্বপ্ন নয়। দেশের অজপাড়া গায়ের অভিভাবকহীন সন্তানের মত স্টিভ জবস, বিল গেটস ও অভিভাবকহীন, পুঁজিহীন সন্তান দিলেন। মেধাকে একমাত্র পুঁজি করে অতি অল্প সময়ে হয়ে যান দুনিয়ার সেরা ধনী। তারা মানবতার জন্য উৎসর্গ করেন তাদের অধিক সম্পদ। প্রতীভার আগুন তা প্রদীপের আগুন নয়, যা ধার করা যায়। প্রতীভার আগুন সেটা ভেতর হতে জাগ্রত করতে হয়। নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট নোবেল পুরস্কার গ্রহণ কালে বলেন, আমরা কোন ভাবেই ভাগ্যের হাতে বন্দি নই। এটা ব্যক্তি জীবনে যেমন সত্য তেমনি একটি জাতির জীবনেও সত্য। ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি এপিজে আবদুল কালাম বলেছেন, ‘একবার ফাস্ট হয়ে বসে থাকো না, কারণ মানুষ বলবে তা তোমার ভাগ্যে ছিল। মানুষকে নিজের ভাগ্য নিজে পরিবর্তন করতে হয়। আমরা মহান আল্লাহ পাককে বিশ্বাস করি কিন্তু তিনি আমাদের ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারেন তা বিশ্বাস করতে চাই না। ভাগ্য নয় মানুষের ক্ষমতা ইচ্ছা শক্তির প্রকাশের মাধ্যমে পুরো পৃথিবীটা পরিবর্তন করতে পারে। বিপ্লব বিপ্লব শ্লোগান দিলে বিপ্লব হয় না। বিপ্লব পুরো জাতির পরিবর্তন আনতে পারে। আমরা মহান দায়িত্ব নিয়ে দুনিয়াতে এসেছি। সে দায়িত্ব পালন করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। আমরা মহাবিশ্বের সেরা অংশ। মায়ের ভ্রুণ হতে প্রতিযোগিতা করে এসেছি। প্রতিযোগিতা করে বিশ্ব আমাদের জয় করতে হবে। এক সময় প্রতিযোগিতা হতো একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা একটি অঞ্চলে। আজকের প্রজন্ম প্রতিযোগিতায় ঠিকে থাকতে হলে সমগ্র পৃথিবীর সাথে প্রতিযোগিতা করে ঠিকে থাকতে হবে। কারণ জ্ঞান বিজ্ঞান প্রযুক্তির বাজার বর্তমান একটি, দুটি নেই। দুনিয়াতে যারা বড় হয়েছে তারা সবাই প্রতিযোগিতা করে বড় হয়েছে। প্রতিহিংসা করে নয়।
চিলির সাবেক প্রেসিডেন্ট, জাতি সংঘের নারী বিষয়ক সংগঠন ‘ইউএন উইমেন’-র নির্বাহী পরিচালক মিশেল ব্যাশেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সমাবর্তন অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘এ পৃথিবীতে আমরা সেরা পরিবর্তন সময়ে বসবাস করছি। সময় এখন আগের চেয়ে দ্রুত চলছে। … আমি মানুষের সৃজনশীলতা, ক্ষমতা ও ভবিষ্যৎকে বিশ্বাস করি। পৃথিবীতে অনেক বড় বড় উদ্যোগ বিকাশ লাভ করেনি, যা আবিষ্কার হয়েছে তা মাত্র অতি ক্ষুদ্র অংশ। ক্ষুদ্র জীবন কিন্তু তাকে সর্বোচ্চ কাজে লাগাতে হবে।’ যে বিজ্ঞান প্রযুক্তি বহু কিছু বদলায়, সে বিজ্ঞান প্রযুক্তি নিজেই বদলে যাচ্ছে। কোন কিছুই আর স্থির থাকছে না। এই অবিরাম পথ চলার গতি থামবে কোথায় তা কেউ জানে না। হয়তো মানুষের অবিচারের কারণে পৃথিবী নামক গ্রহটি ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। মানব সভ্যতার শুরুতে প্রস্তর যুগ, তারপর লৌহ, তাম্র, ধাতুর যুগ অতিক্রম করে বর্তমান আধুনিক ডিজিটাল যুগে হাজির হয়েছি। আরো কত যুুগের আবির্ভাব হবে তার নেই ইয়ত্তা। আগে হাতিয়ার তৈরি হতো মানুষকে জন্তু জানোয়ার হতে রক্ষা করতে, এখন অস্ত্র তৈরি করে মানুষকে চোখে রাঙাতে, পোষ মানাতে, শোষণ আর হত্যা করতে। মারণাস্ত্র দিয়ে মানুষ মানুষকে যত হত্যা করছে এত মানুষ প্রকৃতির হত্যা করেনি। অথচ বিজ্ঞানের আয়োজন সুন্দরের পক্ষে হওয়ার কথা। বিজ্ঞানী মাদাম কুরি বলেছেন, ‘আমার চোখে বিজ্ঞান হলো অনিন্দ্য সুন্দর’। বিজ্ঞানের সৌন্দর্য সব বিজ্ঞানি ধারণ করতে পারেনি। তাই পৃথিবীর রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে যে পরিমাণ পারমাণবিক অস্ত্র, রয়েছে তা দিয়ে বিশ মিনিটে দশটি পৃথিবীর মত গ্রহ ধ্বংস করতে পারবে। আমেরিকার হাতে রয়েছে বার হাজারের অধিক পারমাণবিক অস্ত্র, রাশিয়ার নিকট প্রায়ই অনুরূপ, ইসরাইলের হাতে আছে দেড় শত পারমাণবিক অস্ত্র। ধ্বংসের আয়োজন হতে পৃথিবী বাঁচতে চায় কিন্তু পৃথিবীর ডাক শুনার কেউ নেই।
বিজ্ঞানের পারমানবিক বোমায় ধ্বংস হয় জাপানের হিরোসিমা ও নাগাসাকির কয়েক লক্ষ লোক। ভবিষ্যতে আরো কত ধ্বংস হবে জানি না। বিজ্ঞানের সৌন্দর্য আত্মস্থ করতে পারলে বিজ্ঞান কল্যাণের হাতিয়ার। বিজ্ঞান তো এক যাদুর কাঠি। যার স্পর্শে বদলে যেতে পারে মানুষের জীবন প্রণালি। সিফিলিস রোগ মহামারি আকারে আক্রমণ করার পর ইংরেজরা হাজার হাজার রোগীকে দীপান্তরে পাঠিয়ে দিত। বসন্ত রোগ দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে রোগীকে আগুনে পুড়িয়ে ফেলঅ হতো। এই রোগ হতে মুক্তির বিজয় ঘোষণা দিন আলেকজান্ডার ফ্লেমিং। তিনি বিশ শতকের শুরুতে পেনিসিলিন আবিষ্কার করে চিকিৎসা ক্ষেত্রে নব দিগন্তের সৃষ্টি করেন। তার বিনিময়ে আলেকজান্ডার ফ্লেমিংকে দেওয়া হয় নোবেল পুরস্কার। এরপর আবিস্কৃত হয় অ্যাসপিরিন। জার্মান বিজ্ঞানী রন্টজেন আবিস্কার করেন এক্স-রে। তারা যা আবিস্কার করেছেন তা নিজের জন্য করেনি। ব্যবসা করে লাভ করার জন্য নয়। মানব কল্যাণের জন্য করে গেছেন। বন্টজেন বলেন নি এক্স-রে তার নিজস্ব সম্পদ। বরং উল্টো কথাই বলে গেছেন। মার্কনি বলেন নি তিনি বেতার যন্ত্র নিয়ে অর্থ উপার্জন করবেন। তাদের সকলের আবিস্কার উন্মুক্ত ছিল সবার জন্য। কিন্তু পারমাণবিক অস্ত্র, মারণাস্ত্র সবার জন্য উন্মুক্ত নয়। একান্ত স্বার্থান্বেষী রাষ্ট্রশক্তি নিজেদের ক্ষমতা বিস্তারে ব্যবহার করে মানব সভ্যতা ধ্বংস করতে ব্যস্ত।
লেখক : কলাম লেখক ও রাজনীতিক