বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক, বিপ্লবীরা অমর হোক

1

মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম

১৯৭৫ সালের নভেম্বর মাসের শুরুতে যে অনিশ্চয়তা ও শঙ্কা ঘিরে ধরেছিল, তার অবসান ঘটেছিল ৭ নভেম্বর। মূলতঃ বিপ্লব ও সমান্তরাল বিপ্লবের সফল পরিণতি ‘জাতীয় সংহতি ও বিপ্লব দিবস’। সেদিন সিপাহী-জনতার দুঃসাহসী বিপ্লবের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা রক্ষা পেয়েছে। দেশের ইতিহাসের গতিপথ বদলে দেয়া এই দিনের ইতিহাস জানতে হলে আমাদেরকে সেই বছরের জানুয়ারি মাসের শুরু থেকে নভেম্বরের ৭ তারিখ পর্যন্ত বাংলাদেশের ঐতিহাসিক দিনপঞ্জি জানতে হবে। ৭ নভেম্বর অভ্যুত্থানের কোনো পূর্বপরিকল্পনা ছিল না তা স্পষ্ট, অভ্যুত্থানের পূর্বনির্ধারিত কোনো নেতাও ছিলেননা। পরবর্তীকালে জিয়ার ওপর যদিও নেতৃত্ব অর্পিত হয়, তা ছিল চলমান ঘটনার পরিণতি এবং সেনাবাহিনীতে তখন জেনারেল জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বের কোনো বিকল্পও ছিলনা। ৩, ৪ ও ৫ নভেম্বর- এই তিন দিন বাংলাদেশে কার্যত কোনো সরকার ছিলনা। ১৯৭৫ সালের ২ নভেম্বর দিবাগত রাতে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ পাল্টা অভ্যুত্থান ঘটান এবং নিজেই আবার চেইন অব কমান্ড লঙ্ঘন করে নিজেকে সেনাপ্রধান হিসেবে ঘোষণা ও তৎকালীন সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে গৃহবন্দি করেন। ৩রা নভেম্বর জেলে ৪ নেতাকে হত্যার পর পরিস্থিতি আরো ঘোলাটে হয়ে পড়ে। পুনরায় সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে ৬ নভেম্বর, ১৯৭৫ প্রধান বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমকে প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক করে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ নিজে উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। খন্দকার মোশতাক তখন নামমাত্র প্রেসিডেন্ট। খালেদ মোশাররফের পছন্দে বিচারপতি সায়েম ৬ নভেম্বর সকাল বেলা প্রেসিডেন্ট পদে অভিষিক্ত হন। এই কয় দিন রেডিও-টেলিভিশন বন্ধ ছিল। ফলে দেশে কী ঘটছে, না ঘটছে কিছুই মানুষ জানতে পারছিলনা। ঐতিহাসিক ৭ নভেম্বরকে আজকের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিপ্রেক্ষিতে বিবেচনা করলে চলবেনা। বিশিষ্ট সাংবাদিক ও বিশ্লেষক কাজী সিরাজ যথার্থই লিখেছেন- ‘১৫ আগস্টের ঔরসে এবং ৩ নভেম্বরের গর্ভেই ৭ নভেম্বরের জন্ম। তাকে দেখতে হবে পঁচাত্তরের চোখ দিয়ে, বিশ্লেষণ করতে হবে তৎকালীন সমাজ ও রাজনৈতিক বাস্তবতা এবং জটিল ভ‚-রাজনৈতিক সমীকরণ দিয়ে।’ ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি বহুদলীয় গণতন্ত্রের স্থলে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা ‘বাকশাল’ প্রতিষ্ঠার পর শেখ মুজিব দলের লোকদের কাছে যেমন বিতর্কিত হয়ে পড়েছিলেন তেমনি ক্ষমতায় থাকার নৈতিক ভিত্তিও হারিয়ে ফেলেছিলেন। সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও তৎকালীন আওয়ামীলীগনেতা মিজানুর রহমান চৌধুরী ‘রাজনীতির তিনকাল’ গ্রন্থে লিখেন-‘আজ বঙ্গবন্ধু নিজেকে নিজে হত্যা করে ফেললেন।’ গণতন্ত্রের জন্য যে নেতা দীর্ঘদিন জেল জুলুম খেটেছেন তিনিই কি-না নিজ হাতে গড়া দেশের গণতন্ত্রকে হত্যা করলেন। জনাব চৌধুরী সেই বইয়ের অন্যত্র লিখেছেন-‘বাকশাল প্রশ্নে জেনারেল ওসমানী ও মঈনুল হোসেন সংসদ সদস্যপদ থেকে পদত্যাগ করলেন। এ দু’জন সৎসাহস দেখিয়ে যে বিদ্রোহী ভূমিকা রেখেছে, এতখানি সাহস আমি দেখাতে পারিনি সেটা ঠিক। সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী অর্থাৎ বাকশালের পক্ষে ভোট দেয়ার পরও নিরাপদ বোধ করছিলাম না। তবে আওয়ামী লীগ বাকশাল হলেও বঙ্গবন্ধু নিজে এবং বঙ্গবন্ধুর মমতাময়ী স্ত্রী আর আওয়ামী লীগের সংখ্যাগরিষ্ঠ কর্মীর আমার প্রতি যে ভালোবাসা ছিল, সে কারণে দেশ ছাড়িনি। তবু সম্পূর্ণ নিঃশঙ্ক ছিলাম না। সত্যিকার মৃত্যুর চেয়ে মৃত্যুর ভীতি বেশি পীড়াদায়ক। এ অবস্থার মধ্যে মনসুর ভাই (ক্যাপ্টেন মনসুর আলী) একদিন আমাকে বঙ্গবন্ধুর কাছে নিয়ে গেলেন। আমারও ইচ্ছা ছিল, যে কথা সেদিন বক্তৃতায় বলতে পারিনি, বঙ্গবন্ধুকে সেই মনের কথা জানিয়ে হৃদয়ের ভার লাঘব করবো। মনসুর ভাইসহ ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে গেলাম। বঙ্গবন্ধু যেন কী কাজ করছিলেন। মনসুর ভাই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার সম্পর্কটা সহজ করার জন্য বললেন, ‘মিজান, তুমি একটা চুটকি বলো। নেতা তো এত কাজ করছেন, তার একটা ডাইভারশন দরকার।’ শুনে বঙ্গবন্ধু একটু রাগের স্বরেই বললেন, ‘দরকার নেই। আমি ওর কথা শুনতেই চাই না।’ আমি বললাম, ‘কেন কী হয়েছে?’ বঙ্গবন্ধু বললেন, তুমি আমার কথা শুনোনি। বেয়াদবি করেছো। আমি ইশারা করার পরও তুমি সেদিন সংসদীয় দলের সভায় বাকশালের পক্ষে ভোট দাওনি।’
বাকশাল গঠনের পটভূমি নিয়ে আলোচনায় বিশ্লেষকদের অনেকের কথায় সেই সময়কার নৈরাজ্যকর একটা পরিস্থিতির কথা উঠে আসে। সেই পরিস্থিতির দায় কার, তা নিয়েও নানা আলোচনা রয়েছে। আওয়ামী লীগের একটা অংশ বেরিয়ে গিয়ে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা বলে ১৯৭২ সালের অক্টোবরে জাসদ নামের দল গঠন করেছিল। লেখক ও গবেষক বদরুদ্দিন উমর বলেছেন- ‘শেখ মুজিবের জন্য তাঁর দল আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের দুর্নীতি একটা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। অন্যদিকে দলের একটি অংশ (জাসদ) বেরিয়ে যাওয়ার পর সরকার নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছিল।’ এছাড়া দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সর্বহারা বা চরমপন্থী কিছু বামদলের সশস্ত্র তৎপরতাও চলছিল।
বাকশালের ধারাবাহিকতা ও ইতিহাসের অনিবার্য পরিণতি ঐতিহাসিক ১৫ আগস্ট, ১৯৭৫। কারো কাছে এটা চরম নির্মমতা হলেও আগস্ট বিপ্লবের মহানায়কদের কাছে ছিল মহান বিপ্লব। ভারতীয় লেখক অমিত রায় ১৯৭৫ সালের ১৭ আগস্ট লন্ডনের সানডে টেলিগ্রাফে প্রকাশিত তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় লেখেন, ‘বাংলাদেশের রাজনীতির প্রধান নিয়ন্ত্রক হলো শহরের বাসিন্দা মধ্যবিত্ত শ্রেণী। এদের সমর্থনই মুজিবকে নেতা বানিয়েছিল, ক্ষমতায় বসিয়েছিল। কিন্তু শাসনতন্ত্র সংশোধনের ফলে মুজিব তাদের সমর্থন হারিয়ে ফেলেন এবং সেদিন থেকেই নিজেকে অতীতের পাতায় তুলে দিয়েছিলেন। চারদিকে চাটুকার বেষ্টিত মুজিব সর্বব্যাপী গণ-অসন্তোষ উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। বরং উল্টা ‘আমার জনগণ আমাকে ভালোবাসে, আমি তাদের ভালোবাসি’- এ কথা আওড়িয়ে মিথ্যা আত্মপ্রসাদ লাভ করতে চেয়েছিলেন। তাঁর মেরুদÐহীন সমর্থকরা তাঁকে বুঝিয়েছিল যে অর্থনৈতিক দুঃখ-দুর্দশা, শিল্প-কারখানার অচলাবস্থা, অপরিমেয় মজুদদারি ও চোরাকারবার এবং ক্রমাবনতিশীল আইনশৃঙ্খলাজনিত সমস্যাদি মুজিবি খ্যাতির মুখে কিছুই না। সমস্যার মোকাবিলা না করে মুজিব ২৫ হাজার লোকের রক্ষীবাহিনী খাড়া করেছিলেন, যাতে সেনাবাহিনী তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার সাহস না পায়।’
তাকে সপরিবারে হত্যার পর শেখ মুজিবেরই দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সহযোগী, আওয়ামী লীগের অন্যতম শীর্ষ নেতা খন্দকার মোশতাক আহমেদ অভ্যুত্থান সংঘটনকারীদের সঙ্গে নিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে থাকেন। এমতাবস্থায় ১৯৭৫ সালের ২ নভেম্বর দিবাগত রাতে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ পাল্টা অভ্যুত্থান করলে পরিস্থিতি বিপজ্জনক পরিস্থিতির দিকে ধাবিত হয়েছিল। সেই ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের একমাত্র অবলম্বন জেনারেল জিয়া। তাঁর প্রতি সেনা সদস্যদের মধ্যে বিরাজমান ভালোবাসা থেকে উদ্ভূত তীব্র ক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে এবং তার জনপ্রিয়তাকে পুঁজি করে লে. কর্নেল (অব.) তাহের আরেকটি পাল্টা সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের পরিকল্পণা করেন। জাসদের বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সদস্যরা সামরিক বাহিনীর মধ্যে লিফলেট ছড়িয়ে সাধারণ সিপাহিদের উত্তেজিত করে তোলে। সবচেয়ে অপরিণামদর্শী ও ক্ষতিকর দিক ছিল সামরিক বাহিনীর ভারসাম্য ধ্বংস ও কর্মকর্তাশূন্য করার মত দিকভ্রষ্ট প্রচারণা। উল্লেখযোগ্য শ্লোগান ছিল- ‘সিপাই সিপাই ভাই ভাই, অফিসারদের রক্ত চাই’, ‘সিপাই সিপাই ভাই ভাই, সুবেদারের ওপরে অফিসার নাই’। উল্লেখ্য, বিডিআর হত্যাকাÐেও এধরনের শ্লোগান পরিলক্ষিত হয়েছে।
লে. কর্নেল (অব.) আবু তাহেরের রক্তক্ষয়ী অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা আগে থেকে আঁচ করতে পেরে ৬ নভেম্বর দিবাগত রাত অর্থাৎ ৭ নভেম্বর রাত ১২টা ১ মিনিটে অর্থাৎ জাসদের অভ্যুত্থান শুরু হবার ১ ঘন্টা আগেই মেজর মহিউদ্দিন এবং সুবেদার মেজর আনিসুল হকের নেতৃত্বে ২য় ফিল্ড আর্টিলারীর জওয়ানরা মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের বাসায় গিয়ে তাকে মুক্ত করেন এবং নিরাপত্তার প্রয়োজনে তাকে ২য় ফিল্ড আর্টিলারীর হেড কোয়াটারে নিয়ে আসেন। কর্ণেল তাহের যেকোন উপায়ে জেনারেল জিয়াউর রহমানকে তাদের নিয়ন্ত্রণে নিতে সচেষ্ট থাকলেও সামরিক কর্মকর্তা দক্ষতা, সাহসিকতা ও সহায়তায় ২য় ফিল্ড আর্টিলারীতেই রেডিও কর্মকর্তাদের ডেকে এনে জেনারেল জিয়ার ভাষণ রেকর্ডিং করানো হয়। বিপ্লব ও সমান্তরাল এই বিপ্লবের মাধ্যমেই বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতিতে পাদপ্রদীপের আলোয় উজ্জ্বল হয়ে ওঠেন বাংলাদেশের ‘রাখাল রাজা’খ্যাত জেনারেল জিয়াউর রহমান। স্বাধীনতার মহান ঘোষক জিয়াকে বলা হয় বাংলাদেশের অদৃষ্টের সন্তান। ইতিহাসের সঙ্গে সাক্ষাৎকার যেন তাঁর ললাটের লিখন।
শুধুমাত্র ক্ষমতার পালাবদল বা খালেদ মোশররফকে হটিয়ে ক্ষমতার অধিগ্রহণে এই বিপ্লব সাধিত হয়নি। সিপাহী-জনতার বৈপ্লবিক ১২ দফার কথা আমরা ক’জনে জানি! ১ম দফার দু’টি লাইনে বলা হয়েছিল- আমাদের বিপ্লব শুধু নেতৃত্বের পরিবর্তনের জন্য নয়, এই বিপ্লব হলো দরিদ্র শ্রেণীর দারিদ্র্য মুক্তির লক্ষ্যে…। দীর্ঘ দিন আমরা ধনিক শ্রেণীর সৈনিক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছি। ধনিক শ্রেণী তাদেরই স্বার্থে আমাদের ব্যবহার করেছে। তৃতীয় দফায় বলা হয়েছিল-সব দুর্নীতিপরায়ন কর্মকর্তা ও ব্যক্তির সম্পদ অবিলম্বে বাজেয়াপ্ত করা হোক এবং বিদেশী ব্যাংকে তাদের গচ্ছিত সম্পদ দেশে ফিরিয়ে এনে সমাজের বৃহত্তর স্বার্থে বিনিয়োগ করা হোক। চতুর্থ দফায় সুপারিশ করা হয়েছিল কর্মকর্তা এবং সাধারণ সৈনিকের মধ্যে সব পার্থক্য মুছে ফেলে প্রত্যেকের কাজ ও যোগ্যতার ভিত্তিতে বেতন নির্ধারণ করা হোক। ৯ ও ১০ দফায় দেশময় বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা গঠনের কথা বলা হয়েছিল। এই সংস্থাই সামরিক বাহিনীর মূলনীতিসহ দেশের প্রতিরক্ষা নীতি নির্ধারণ করবে। সুতরাং অনুধাবনে কোনো অসুবিধা হচ্ছে না যে, এই ১২ দফা দাবির ভিত্তিতে গড়ে ওঠা ৭ নভেম্বরের বিপ্লবের লক্ষ্য ছিল সত্যি সত্যিই বৈপ্লবিক। পুরনো সমাজকে ভেঙ্গেচুরে, এত দিন ধরে যারা সামাজিক সুযোগ-সুবিধা উপভোগ করে এসেছেন, তাদের গুঁড়িয়ে দিয়ে, বঞ্চিত ও শোষিতদের হাতে শাসনযন্ত্রের দায়িত্ব তুলে দিয়ে, নতুনভাবে, সম্পূর্ণ নতুন আঙ্গিকে সমাজ গঠনের অঙ্গীকার ছিল ৭ নভেম্বর বিপ্লবের লক্ষ্য। বিপ্লবের অব্যাহতি পরে কলকাতা থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক ঞযব ঋৎড়হঃরবৎ (১৩ ডিসেম্বর ১৯৭৫)-এর সম্পাদকীয়তে লেখা হয়েছিল- ‘নির্দেশদানকারী সামরিক কর্মকর্তাদের নির্দেশ অমান্য করে বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর জওয়ানেরা শুধু এজেন্ট খালেদ মোশাররফকে উৎখাত করার জন্য এই বিপ্লব ঘটায়নি। তাদের বিপ্লব ছিল তাদেরই রচিত ১২ দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে। দুপুরে বাড়তি এক কাপ চা এবং বাড়তি কিছু খাবারের জন্য তাদের এসব দাবি রচিত হয়নি। তাদের দাবি ছিল অত্যন্ত বৈপ্লবিক, যা দক্ষিণ এশিয়ার কোনো নিয়মিত সামরিক বাহিনীতে অতীতে কখনো শোনা যায়নি। একটি নিয়মিত বা কনভেনশনাল সামরিক বাহিনী ১৯৭১ সালে গেরিলা বাহিনীতে রূপান্তরিত হয়েই এ নতুন ফসলের জন্ম দিয়েছে। চার বছর সময়ে অতি সঙ্গোপনে তা পরিপূর্ণতা লাভ করে বিস্ফোরিত হয় (৭ নভেম্বরে)।
সিপাহী-জনতার সেই বিপ্লব আমাদেরকে বহুদলীয় গণতন্ত্র অনুশীলনের সুযোগ করে দিয়েছিল, সেই বৈপ্লবিক চেতনাকে ধারণ করতে পারলে ১৯৯০ এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন এবং ছাত্র-জনতার নেতৃত্বে সংঘটিত জুলাই বিপ্লব-২০২৪ এর প্রয়োজন হতো কি না এটা আমার কাছে আজ বড় প্রশ্ন! বিপ্লব হামেশা ঘটেনা, যুগ সন্ধিক্ষণে নতুন মত ও পথের দিশারীরা বিপ্লব ঘটিয়ে থাকেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার সাম্প্রতিক বিপ্লব পরবর্তী অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে প্রজ্ঞা, সুকৌশল ও কঠোরতার পথে এগিয়ে যেতে হবে। বিপ্লবী চে গুয়েভারা সেকথাটিই বলেছেন- ‘বিপ্লব তো আর গাছে ধরা আপেল নয় যে পাকবে আর পড়বে, বিপ্লব অর্জন করতে হয়। নিষ্ঠুর নেতাদের পতন এবং প্রতিস্থাপন চাইলে নতুন নেতৃত্বকেই নিষ্ঠুর হতে হবে।’ পরিশেষে বলবো-আমাদের ভুলে গেলে চলবেনা যে, গণঅধিকার বিবেচনায় ৭ই নভেম্বরের সিপাহী-জনতার বিপ্লব-১৯৭৫ ও সাম্প্রতিক বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার বিপ্লব-২০২৪ একই সূত্রে গাঁথা। বিপ্লবে অংশগ্রহণকারী ও সুফল ভোগকারী সকল মত ও পথের ব্যক্তি ও সংগঠণের মধ্যে রাজনৈতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠার ব্যর্থতা এই মহান বিপ্লবকে ব্যাহত করতে পারে। সেদিকে ছাত্র-জনতাকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। সাম্প্রতিক ফ্যাসিস্ট বিরোধী বিপ্লবে শত-সহগ্র শহীদ ও অগণিত আহত বিপ্লবীদের প্রতি কৃতজ্ঞতার অংশ হিসাবে সুখী, সমৃদ্ধ ও বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।
লেখক : বিশ্লেষক ও সমাজকর্মী