ড. মুহম্মদ মাসুম চৌধুরী
গুরুজনরা বলে গেছেন, দাদার নামে গাধা, বাপের নামে আধা, নিজের নামে শাহজাদা। এক সময় আমাদের অনেক কিছু ছিল, এখন অনেক কিছু নেই। ঢাকার লালবাগের কেল্লায় যখন ইটের দালান, আমেরিকার রাষ্ট্রপতির ভবন ‘হোয়াইট হাউস’ ভবন কাঠের ঘর। ঢাকায় যখন মসলিন কাপড় উৎপাদন হতো তখন পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ উলঙ্গ অর্ধউলঙ্গ বসবাস করতো। আমরা অনেক কিছু হারিয়েছি কিন্তু এখন আমাদের আছে প্রচুর মানুষ আর মানুষ। এই মানুষগুলোকে যদি আমরা বিল গেটস, স্টিভ জবস, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, অমত্যসেন, মাদার তেরেসার মত রূপান্তর করতে পারি পুরো বাংলাদেশটা দাঁড়িয়ে যাবে। মানব সম্পদ সভ্যতার সম্পদ, এই সম্পদ সভ্যতার বোঝা হবে কেন !
দুনিয়ার কোন জাতির বিজয় দিবস নেই, স্বাধীনতা দিবস আছে, জাতীয় দিবস আছে। যে জাতির ‘বিজয় দিবস’ আছে সে জাতি কোনদিন পরাজিত হতে পারে না। একাত্তরের বিজয়ের পর কেউ কল্পনাই করেনি, কোন বাঙালির সন্তান বৃটিশের হাই কমিশনার হয়ে বাংলাদেশে আসবে। আনোয়ার চৌধুরী আমাদের সন্তান, যিনি বৃটিশ হাই কমিশনার হয়ে বাংলাদেশে আসে। বাঙালির সন্তান এখন বৃটিশের মন্ত্রী, মেয়র ম্যান অব দ্যা ইয়ার, এমপি নির্বাচিত হন। বৃটিশ এক কালে আমাদের শাসন শোষণ করতো। করতো এমন একদিন সময় আসবে যে দিন কোন এক বাঙালির সন্তান বৃটিশের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়ে উল্টো বৃটিশকে শাসন করবে। আমাদের সন্তানদের মেধা আছে, যোগ্যতা আছে, শুধু তাদের নিকট ভিশন সৃষ্টি করতে হবে।
দুনিয়ার বহু জাতি আমাদের চেয়ে অনেক পিছিয়ে ছিল। তারা আজ কোথায় ? জাপান, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, বহুদূর এগিয়ে গেছে, তাদের তো কোন সোনার খনি ছিল না। তাদের নতুন প্রজন্মের নিকট ভিশন সৃষ্টি করেছিলেন বলেই এগিয়ে গেছে। সে কাজটি যদি আমরা করতে না পারি তাহলে এগিয়ে যাবো কী করে ? গরিবকে ত্রাণ দিয়ে প্রাণ বাঁচানো যায়, সমস্যার স্থায়ী সমাধান করা যায় না। ত্রাণ দিয়ে দরিদ্রতা লালন করা যায়, কিন্তু মুক্তি আনা যায় না। এ ধরনের দান অধিকাংশ ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়। গরিবের জীবন বদলে দিতে চাইলে তাদের নিকট ভিশন তৈরী করে অন্তর্নিহিত শক্তির বিকাশ ঘটাতে হবে। শিক্ষা ও প্রযুক্তি ধরিয়ে দিতে হবে। মানুষ তো নিজেই নিজের ভাগ্যের রূপকার।
এককালে জ্ঞান ছিল অভিজাত এবং উচ্চ বর্ণের মানুষের এক নিয়ন্ত্রাধীন সম্পত্তি। প্রথম দুনিয়ার বুকে মহানবী হযরত মোহাম্মদ (দ.) এসে ঘোষণা করলেন জ্ঞান ‘পাবলিক প্রপার্টি’ বা জনগণের সম্পত্তি। আধুনিক যুগে দেশে দেশে প্রাথমিক শিক্ষাকে করছে বাধ্যতামূলক। প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (দ.) চৌদ্দশত বছর পূর্বেই জ্ঞান অর্জনকে করেছিলেন ‘ফরজ’। এই মহান ঘোষণার পরও সর্বসাধারণ মানুষের জ্ঞান অর্জনের পথে অভিজাত ও উচ্চ বর্ণের মানুষের ছিল বহু বাধা। আমরা এখন একুশ শতাব্দীতে বসবাস করি। এখন জ্ঞান মুচি সূচি উচ্চ বর্ণ নিম্নবর্ণের সব মানুষের হাতের মুঠোয়। পুরো দুনিয়ায় জ্ঞানের দরজা এখন খোলা। হরিজন, শুদ্র, উপজাতির নিরক্ষণ পরিবারের মেয়ে উচ্চ বর্ণের সন্তানকে প্রতিযোগিতায় পরাজিত করে জগৎজুড়ে খ্যাতি অর্জন করছে।
একজন কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকার মহামান্য রাষ্ট্রপতি হবেন তা এক সময় কেউ চিন্তাই করতো না। চল্লিশ দশকে আমরা যখন বৃটিশ দাসত্ব হতে মুক্ত হই তখন আমেরিকার বহু প্রদেশে কৃষ্ণাঙ্গদের নির্বাচনে ভোটাধিকার ছিল না। সাদা মানুষের সন্তানরা যে স্কুলে পড়াশোনা করতো সে স্কুলে কালো মানুষের সন্তানরা পড়াশোনা করার অধিকার ছিল না। বাসে ট্রেনে কালোরা সাদাদের সাথে এক সাথে বসতে পারতো না। পরিবর্তনের কারণে কালো ওবামা হয়েছিলেন আমেরিকার রাষ্ট্রপতি। যাকে বলা হয় পরিবর্তনের কান্ডারি। তাঁর ভিশন ছিল স্বপ্ন ছিল বলেই তিনি এগিয়ে গেছেন। স্বপ্নের মৃত্যু হলে একজন মানুষের মৃত্যু হয়। স্বপ্নহীন মানুষ জিন্দা মরা। স্বপ্নের মৃত্যুর চেয়ে মানুষের জীবনে বড় কোন ট্রাজেডী নেই। আপনজন ও ভালোবাসার মানুষের মৃত্যু ট্রাজেডী। কিন্তু বড় ট্রাজেডী নয়। কারণ সে মৃত্যুতে মানুষের কোন হাত নেই। স্বপ্নের মৃত্যুর জন্য শতভাগ মানুষ দায়ী। স্বপ্ন দেখা ভালো কিন্তু স্বপ্নের মধ্যে বাস করা ভালো নয়। স্বপ্ন বাস্তবায়নে দ্রুত এগিয়ে যেতে হবে। আজকের দুনিয়াটা দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। আপনি যদি এক স্থানে দাঁড়িয়ে থাকেন তাহলে আপনাকে ফেলে সবাই অনেকদূর চলে যাবে। বর্তমান সময়ে ঠিকে থাকতে হলে এগিয়ে যাওয়ার মিছিলে যুক্ত থাকতে হবে। সে মিছিলে তরুণ শক্তিকে যুক্ত করতে না পারলে আমাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। এদেশের জনসংখ্যার ৩০ ভাগ তরুণ। তরুণরাই দেশের প্রাণশক্তি। সে তরুণদের ধ্বংস করার গভীর চক্রান্ত চলছে। কবি কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন তারুণ্যের পূজারী। তিনি মনে করতেন তরুণরাই পারে পুরাতন সব জরাজীর্ণ মুছে দিয়ে নতুন দিনের সূচরা করতে। সকল অপশক্তি রুখে দিতে তরুণদের নিকট বার বার আহবান জানিয়েছেন। সে তরুণ যখন পথ হারিয়ে অন্ধকারের ফানা গলিতে হারিয়ে যায় তখন আমরা আশাহত হই।
মিশাইল ম্যান অব ইন্ডিয়া বলে পরিচিত, ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল কালাম বলেছেন, ‘জীবন নামক নদীতে জোয়ার আছে, ভাটা আছে। তারুণ্য হলো জীবনের জোয়ার। সে তারুণ্যটা কাজে লাগাতে পারলেই সাফল্য আসবে। তারুণ্য যেখানে পথ হারায়, বিপর্যয় সেখানে অনিবার্য হয়ে উঠে। মাঝে মাঝে আমাদের তরুণরা বিপ্লব বিপ্লব শ্লোগান দিয়ে পরিবর্তন চায়। কিন্তু পরিবর্তন আসে না, তারা পথ হারায়। বিপ্লব বিপ্লল শ্লোগানে বিপ্লব আসে না, বিপ্লব আসে নিঃশব্দে নিরবে আত্মশক্তি বিকাশের মাধ্যমে। আত্ম শক্তি বিকাশের মাধ্যমে বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে ঠিকে থাকাই বর্তমান সময়ে বড় বিপ্লব।
সর্বকালে সেরা পরিবর্তনের যুগে আমরা বসবাস করছি। আগে যে শ্রমিক দশ জোড়া জুতা বানাতে পারতো বর্তমান সে শ্রমিক ২০০ জোড়া জুতা বানাতে পারে। ভবিষ্যতে কত জোড়া বানাতে পারবে তা কল্পনা করা যাবে না। কারণ এক কালের প্রাচুর্য আরেক কালের দারিদ্র্য। আমাদের তরুণদের নতুন নতুন প্রযুক্তির সাথে যুক্ত করতে পারলে দেশের চেহারা পাল্টে যাবে। আগামী দিনে এদেশ কেমন হবে। পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশের অবস্থান কোথায় থাকবে তা সম্পূর্ণ নির্ভর করবে আজকের তরুণদের প্রস্তুতির উপর।
মানুষ হাজার হাজার বছর চাঁদের দিকে তাকিয়েছে। চাঁদের বুড়ি দেখছে। চাঁদ নিয়ে গল্প, উপন্যাস, কবিতা, প্রবন্ধ লেখেছে কিন্তু চন্দ্র বিজয় করতে পারেনি। আধুনিক কালের মানুষ চন্দ্র বিজয় করছে, মঙ্গলগ্রন্থ জয় করছে, আরো কত শত কিছু জয় করবে তার সীমা পরিসীমা নেই।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলতেন; সোনার বাংলা গড়তে হলে সোনার মানুষ চাই; সোনার বাংলার সোনার মানুষ নিউ মার্কেটের সোনার দোকানে পাওয়া যায় না, বসুন্ধরা সিটি, যমুনা ফিউচার পার্কেও পাওয়া যায় না, যোগ্যতা অর্জনের মাধ্যমেই সোনার মানুষ সৃষ্টি নয়। বর্তমান দুনিয়ার সব মানুষ এক বাক্যে স্বীকার করে নিয়েছে নতুন পৃথিবীতে পার্থিব সম্পদের চেয়ে অনেক বড় সম্পদ ‘জ্ঞান’। বর্তমান বাংলাদেশে ছাত্র ছাত্রীর সংখ্যা চার কোটির অধিক। দুনিয়ার অধিকাংশ দেশের জনসংখ্যা চার কোটি হতে কম। এই ছাত্রদের যদি সোনার মানুষ হিসাবে গড়ে তুলতে পারি াহলে আর সম্পদের প্রয়োজন নেই।
যুগান্তকারী আবিস্কারগুলোর জন্য আমাদের হাজার হাজার বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। হাজার হাজার বছর পর আমরা রেডিও, ফ্রিজ, টেলিফোন, টেলিভিশন, বিমান, রকেট, ইন্টারনেট, বিদ্যুৎ পেয়েছি। এখন আবিস্কারের মহোৎসব চলছে। ভবিষ্যতে আরো বহু কিছু আবিস্কারের জন্য বহুদিন অপেক্ষা করতে হবে না। এই মহা আবিস্কারের যুগে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য শুধু প্রয়োজন দক্ষ জনশক্তির।
তরুণ নতুন কিছু করতে চায়। অনেক তাদের আগ্রহ। ইচ্ছা শক্তিও কম নয়। সে আগ্রহকে কাজে লাগাতে না পারনলে তারা পথভ্রষ্ট হয়। তাদেরকে নানা অপশক্তি ব্যবহার করে অন্ধকার পথে নিয়ে যায়। তরুণরা নতুন কিছু করতে না পারনলে যন্ত্রণায় ভোগে। তাদের নিকট ভিশন সৃষ্টি করা এবং তাদের দৃষ্টিভঙ্গী পরিবর্তন করা আমাদের বড় কাজ। তারা দাঁড়ালে বাংলাদেশ দাঁড়াবে। তাদের পরিবর্তনই দেশের পরিবর্তন। তরুণদেরকে মেধার জগতে নিয়ে যেতে হবে। মনে রাখতে হবে, বর্তমান শারীরিক শক্তির দাম নেই। গাধার নয়, মেধার যুগ। সবচেয়ে বিশাল প্রাণী ডাইনোসর হারিয়ে গেছে, আর তেলা পোকাটিকে আছে তার বুদ্ধির কারণে। কিন্তু মুক্তি আনা যায় না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়। গরীবের জীবন বদলে দিতে।
লেখক : কলাম লেখক, রাজনীতিক