রশীদ এনাম
চট্টগ্রাম সরকারি চারুকলা কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ শিল্পী সবিহ্ উল আলম চাচাকে নিয়ে ধলঘাট যাওয়ার পথে তাঁর কণ্ঠে একটা গান শুনেছিলাম “ও ব্রিটিশ কোম্পানী, ও ব্রিটিশ কোম্পানী, ও ব্রিটিশ কোম্পানী গাট্টি-পুস্তা লইয়া ধাইবানী। বিলাতত যায় ব্রিটিশ বদ্দা গাছ কাটিও হদ্দা হদ্দা”- ওহ ব্রিটিশ কোম্পানী, ওহ ব্রিটিশ কোম্পানী গাট্টি বোঁচকা নিয়ে পালিয়ে যাবে নি। বিলেতে গিয়ে ভাই গাছ কাটিও টুকরা টুকরা। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সময় ইংরেজদের তাড়ানোর জন্য ব্যাঙ্গ করে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় গানও রচিত হয়েছিল গানের রচয়িতার নাম জানা যায়নি।
পটিয়া থানামোড় থেকে ১২কিলোমিটার দূরে শহিদ ছবুর রোড হয়ে সোজা উত্তর পাশে এঁকে বেঁকে যে সড়কটি উত্তর পাশে চলে গেছে ব্রিটিশবিরোধী অগ্নিকণ্যা প্রীতিলতা স্মৃতিবিজড়িত ধলঘাট ইউনিয়ন। ধলঘাটের নামকরণ হয়েছিল পুরানো ঘাটের নামঅনুসারে ধলঘাট। ১৯৯৮ সালে প্রথম গিয়েছিলাম ধলঘাট গ্রামে, প্রীতিলতা ইশকুল, প্রীতিলতা ট্রাস্ট সম্পর্কে জানতে। প্রীতিলতা স্মৃতিটা জিয়ে রেখেছে ধলঘাট গ্রামের পঙ্কজ দাদা। প্রীতিলতা ট্রাস্ট, প্রীতিলতা শিশু কানন ইশকুল, ইশকুলের সামনে স্থাপন করা হয়েছে প্রীতিলতার একটি আবক্ষ মূর্তি। আবক্ষ মূর্তিটির নকশা করেছিলেন চট্টগ্রাম চারুকলা কলেজের অধ্যাপক শিল্পী প্রণব মিত্র চৌধুরী। বর্তমান প্রজন্মদের মধ্যে অনেকে প্রীতিলতা সম্পর্কে জানে না। ভারতের চিত্রপরিচালক আশুতোষ গোয়ারিকর মাস্টারদা সূর্যসেন এবং প্রীতিলতাকে নিয়ে চমৎকার একটা সিনেমাও তৈরী করেছে, “খেলে হাম জি জানসে” ছবিটা দেখে মুগ্ধ হয়েছি, প্রীতিলতার চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন, বিশাখা সিংহ, বিপ্লবী কল্পনা দত্তের চরিত্রে দীপিকা পাডুকোন, মাস্টারদা সূর্যসেন চরিত্রে অভিষেক বচ্চন অভিনয় করেছিলেন। ছবিটা দেখে আমি নীরবে কেঁদেছি। মুভিটা দেখলে বুঝা যাবে ব্রিটিশ কুকুরদের তাড়ানোর জন্য মাস্টারদা সূর্যসেন, প্রীতিলতা, কল্পনা দত্তসহ বিপ্লবীরা কী সংগ্রাম না করেছিলেন।
১৯১১ সালের ৫মে ধলঘাটের সমুরা গ্রামে প্রীতিলতা জন্মগ্রহণ করেন। বাবা জগবন্ধু ওয়াদ্দেদার মাতা প্রতিভা দেবী ওয়াদ্দেদার। বাবা ছিলেন চট্টগ্রাম পৌরসভার প্রধান কেরানি। জগবন্ধুর মধ্যেবিত্ত পরিবারে ছয় সন্তানের মধ্যে প্রীতিলতা ছিলেন দ্বিতীয়। সবাইকে নিয়ে থাকতেন শহরের আসকার দিঘির দক্ষিন-পশ্চিম পাড়ে মাটির এক দোতলা বাড়িতে। প্রীতির শৈশব-কৈশোর কাটে আসকার দিঘি এলাকায়। ১৯১৮ সালে প্রীতিলতা ডা. খাস্তগীর উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। তাঁর সহপাঠী ছিলেন কল্পনা দত্ত। প্রীতিলতা ছাত্র জীবনে মেধাবী হওয়ায় শিক্ষকদের কাছে প্রিয় ছিলেন। ডা. খাস্তগীর ইশকুল থেকে ম্যাট্রিক এবং ইডেন মহিলা কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করার পর কলকাতা বেথুন কলেজ থেকে দর্শন শাস্ত্র নিয়ে বিএ পাস করেন। ১৯২৮ সালে মাস্টারদা সূর্যসেনের বিপ্লবী দলের সদস্য হন প্রীতিলতা।
১৯২৪ সালের দিকে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে ভারত উপমহাদেশে। বিপ্লবীরা সে সময় বাড়িতে বই রাখতে পারতেন না। আতংকে থাকতেন। মাস্টারদা সূর্য সেন বিপ্লবী দল ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মির সদস্য পূর্ণেন্দু দস্তিদার নিষিদ্ধ বই গুলো রাখতেন প্রীতিলতার কাছে। প্রীতিলতা ছিলেন বইপ্রেমী। সে সময় লুকিয়ে লুকিয়ে পড়ে ফেলেন দেশের কথা, বাঘা যতীন, ক্ষুদিরাম আর কানাইলাল নামের বইগুলো। সবচেয়ে অগ্নি ঝরানো বই ছিলো “দেশের কথা”। বইটিতে লেখক দেখিয়েছিলেন, ব্রিটিশ শাসকরা কীভাবে উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা করে ভারতকে লুণ্ঠন করেছে। ১৯৩০ সালে ১৯ এপ্রিল আই এ পরীক্ষা দিয়ে প্রীতিলতা চট্টগ্রামে ফিরেন। আগের রাতেই চট্টগ্রামে বিপ্লবীদের পরিকল্পিত আক্রমণে ধ্বংস হয়ে যায় অস্ত্রাগার, পুলিশ লাইন, টেলিফোন অফিস, ও রেলযোগাযোগ। পুরো ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনামলের অন্যতম তোলপাড় “ চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহ”
সে সময় বিপ্লবী দলের শর্ত ছিল প্রয়োজন হলে দেশের মুক্তিসংগ্রামে নিজের সর্বস্ব ও প্রয়োজন হলে জীবন পর্যন্ত ত্যাগ করতে প্রস্তুত থাকতে হবে। প্রীতিলতা মাস্টারদা সূর্যসেনের সঙ্গে বৈঠক করতে গিয়েছিলেন, পটিয়া ধলঘাটের সাবিত্রী দেবীর বাড়িতে। ধলঘাটে ব্রিটিশ পুলিশ ও বিপ্লবীদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। সেটি পরবর্তীতে “ধলঘাট যুদ্ধ” হিসেবে খ্যাত হয়। ১৯৩২ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর প্রীতিলতার নেতৃত্বে পাহাড়তলীর ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ করেন। সেদিন মাস্টাদা সূর্যসেন প্রীতিলতাকে সামরিক পোশাক পরিয়ে দিয়েছিলেন। প্রীতির পরিধানে ছিল খাকি শার্ট, ধুতি, মাথায় পাগড়ি ও চামড়ার তৈরি কটিবদ্ধ। বিপ্লবীরা তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে ক্লাবে আক্রমণ শুরু করেন রাত দশটায়। দেশবরেণ্য চিত্রশিল্পী সবিহ্ উল আলম চাচা বলেন, “অনেকে বলেন প্রীতিলতা ব্রিটিশদের অস্ত্রাগার লুণ্ঠন করেছেন। আসলে এটা হবে অস্ত্রাগার নিয়ন্ত্রণ” ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সময় ক্লাবটি নিয়ন্ত্রণের নেয়ার জন্য অভিযায শুরু হলে হঠাৎ একজন অফিসারের ছোড়া গুলিতে আহত হয়ে প্রীতিলতা মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। ধরা না দিতে পান করেন পটাশিয়াম সায়ানাইড। আহত অবস্থায় তিনি বলেছিলেন, “ফাঁসির দড়ি গলায় পরতে জন্ম নয় আমার। আমি বিপ্লবী কন্যা চট্টলকন্যা অগ্নিকন্যা। সে সময় বন্দিশিবিরে ছিলেন প্রীতিলতার জ্ঞাতি ভাই বিপ্লবী পূর্ণেন্দু দস্তিদার। এক চিঠিতে লিখেছিলেন,“ আঁধার পথে দিলাম পাড়ি/মরণ-স্বপন দেখে” প্রীতিলতার জীবনী ও লিখেছিলেন বিপ্লবী পূর্ণেন্দু দস্তিদার। ব্রিটিশদের ত্রাস মহানায়ক মাস্টারদা সূর্যসেনের সহযোদ্ধা অগ্নিকন্যা মহারানি বলেছিলেন “আমার জীবন্ত দেহ আমি কাকেও স্পর্শ করতে দেব না। ইংরেজদের শক্তি নেই আমাকে কারাগারে বন্দি করার। চিরমুক্তির পাথেয় আমার কাছে গচ্ছিত। গচ্ছিত পটাশিয়াম সায়ানাইড”।
২৩বছর বয়সী অগ্নিকন্যা প্রীতিলতা সায়ানাইড পান করে না ফেরার দেশে চলে যান। বিশ^বাসীকে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েগেছেন স্বদেশকে ব্রিটিশ মুক্ত করার জন্য মুক্তির পতাকাবাহী এক লড়াকু প্রতীক হিসেবে।
কালের সাক্ষী হিসেবে ইউরোপিয়ান ক্লাবটি চট্টগ্রামে পাহাড়তলীতে আজও দাঁড়িয়ে আছে। যে ক্লাবের বাহিরে লেখা থাকত “কুকুর ও ভারতীয়দের প্রবেশ নিষেধ”। মৃত্যুকালে প্রীতিলতা এক চিরকুটে লিখে যান, “দেশের মুক্তিসংগ্রামে পুরুষ এবং নারীর পার্থক্য আমাকে ব্যথিত করেছিল। যদি আমাদের ভাইয়েরা মাতৃভূমির জন্য যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে পারে, আমরা ভগিনীরা কেন উহা পারব না।” প্রীতিলতা আরেকটি চিরকুটে লিখেছিলেন, “মেয়েরা যে এখনো পিছিয়ে আছে তার কারণ তাদের পেছনে রাখা হয়েছে। নারীরা এখন প্রতিজ্ঞাবদ্ধ যে তারা আর পিছিয়ে থাকবে না এবং সংগ্রাম যতই কঠিন ও বিপৎসংকুল হোক না কেন, ভাইদের পাশাপাশি দাঁড়িয়ে তারাও সক্রিয় অংশগ্রহণ করবে। আমি আন্তরিকভাবে আশা করি আমার বোনেরা নিজেদের দুর্বল ভাববেন না। এই আশা নিয়ে আমি আজ আত্মদানে অগ্রসর হলাম’’
ধলঘাটের দক্ষিণ সমুরায় অগ্নিকন্যা প্রীতি নেই আছে শুধু স্মৃতি। এ বাড়িতে বর্তমানে বসবাস করছেন শোভারানী দাশের পরিবার। পঙ্কজ চক্রবর্তী ও প্রবোধ রায় চন্দন ও পুলক বাবু এদের উদ্যোগে দক্ষিণ সমুরাই বিপ্লবী পূর্ণেন্দু, অর্ধেন্দু সুখেন্দ, প্রীতিলতা স্মৃতি সংরক্ষণ সংসদ প্রতিষ্ঠা করেছে। তাদের উদ্যোগে ধলঘাটের দক্ষিণ সমুরাই প্রীতিলতার সমাধিস্থল নির্মাণ করা হয়েছে। এই বসতভিটার পশ্চিমদিকে প্রীতিলতা ও অর্ধেন্দু দস্তিদারের স্মরণে ১৯৭০ সালে একটি স্মৃতি ফলক স্থাপন করেন বিপ্লবী পূর্ণেন্দু দস্তিদার। প্রীতিলতা ট্রাস্টের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি পঙ্কজ চক্রবর্তী ইশকুলবেলা থেকে ছিলেন বিপ্লবী প্রীতিলতা প্রেমী। বিপ্লবী পূর্নেন্দ দস্তিদারের বই পড়ে তিনি নিজেই প্রীতিলতাকে নিয়ে গবেষণা শুরু করেন বইও লিখেছেন “বীরকন্যা প্রীতিলতা” নামে।
১৯৯১ সালে “ওয়ার্ল্ড ভিশনের” আর্থিক সহযোগিতায় পঙ্কজ চক্রবর্তী বাঁশের বেড়া ও টিনের শেড দিয়ে “প্রীতিলতা শিশু কানন” ইশকুল প্রতিষ্ঠা করেন। ২০০৭ সালে প্রীতিলতা ট্রাস্ট গঠন করা হয়। গত ২০১৭ সালে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় “প্রীতিলতা শিশু কানন” ইশকুলটি যে জায়গা অবস্থিত সেখানে ৪ কোটি ৩০ লক্ষ টাকা ব্যয়ে নির্মিাণ করেছেন “বীরকন্যা প্রীতিলতা ট্রাস্ট সাংস্কৃতিক ভবন”। প্রীতিলতা শিশুকানন ইশকুল, প্রীতিলতা মঞ্চ, মাস্টারদা সূর্য সেনের নামে বিপ্লবীদের সংগ্রহশালা, লাইব্রেরি, বেকার যুবকদের জন্য কম্পিউটার প্রশিক্ষন ও আউটসোর্সিং কোর্স, দুস্থ নারীদের জন্য সেলাই প্রশিক্ষণ দেয়া হয়, প্রীতিলতা কমপ্লেক্সে পর্যটক বা প্রশিক্ষানার্থীদের জন্য ডরমেটরির ব্যাবস্থা আছে। পঙ্কজ চক্রবর্তী জানান, “প্রীতিলতা শিশুকানন ইশকুলটি জাতীয়করণ করা জরুরি এবং ধলঘাটের বিপ্লবী সাবিত্রীর বাড়ি-ভিটাসহ চট্টগ্রামের সকল বিপ্লবীদের স্মৃতি সংরক্ষণ করার জন্য তত্ত¡াবধায়ক সরকারের মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা প্রতি সুদৃষ্টি কামনা করেছেন। প্রীতিলতা কেবল লড়াকু নারী বিপ্লবী নয়, তিনি দেশের প্রথম নারী বিপ্লবীযোদ্ধা হিসেবে অনন্তকাল বেঁচে থাকবেন সাহসী আদর্শের উজ্জ্বলতম মূর্ত প্রতীক হিসেবে। ৯২তম আত্মহুতি দিবসে রইলো বিন¤্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।
লেখক : সহ-সমন্বয়কারী- ইতিহাসের খসড়া