মিঞা জামশেদ উদ্দীন
আহ্; ‘একপশলা বৃষ্টি ভিজিয়ে দেয় আমারে।’ এটি আমার একটি প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের নাম। মঙ্গলবার, অর্থাৎ ২০/৫/২০২৫ইং রাত ১০টার দিকে, বন্দর নগরী চট্টগ্রামে ঝুমঝুম-একপশলা বৃষ্টি হয়ে গেল। তবে একপশলা বৃষ্টি বলা যাবে না, টানা আধঘণ্টা ধরে বৃষ্টি হয়। কখনো মুষলধারে-তীব্রতা, আবার থেমে থেমে। এ অবস্থায় অনেকটা আটকাপড়া অবস্থা হয়। ঘড়ির কাঁটার দিকে চেয়ে দেখি, রাত সাড়ে দশটা বেজে গেছে। আর এ অবস্থায়ও উঠতে হয়; নগরে তো আর থাকা হবে না, একেবারে অজপাড়া-গাঁয়ে যেতে হবে, এজন্য পরপর তিনটি গাড়ি পাল্টাতে হবে। অবস্থান ছিল কাজী দেউড়ীর এপোলো শপিং সেন্টারের ‘ভিভো’ মোবাইল কোম্পানির শোরুমে। একেবারে পরিপাটি প্লাস ঘেরা শোরুম, বাহির থেকেও বৃষ্টি-পড়ার দৃশ্য উপভোগ করা যায়। সঙ্গে ছিলেন অগ্রজ লেখক ও কবি হোসাইন কবির। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের প্রফেসর। ওনার পরামর্শে সেটটি কেনা হয়। এ ব্যাপারে আমি একবারে অজ্ঞ; হয়তো বিশ্বাস হওয়ার নয়। কেনাকাটা-লেনদেন খানিকটা আত্মভোলা হয়ে ওঠেছি! কোনো কিছু দীর্ঘক্ষণ স্মৃতিতে আর রাখা যাচ্ছে না, এ শুনি এ ভুলে যায়। যাকে স্মৃতিকাতর বা স্মৃতিভ্রম বলা যেতে পারে। সেদিনের দুটি ঘটনা বিস্মিত হই। মেয়ের স্কুলে যাওয়া হয়। তারও প্রথম সাময়িক পরীক্ষা চলছিল। পরীক্ষার শেষে দেখা হলো। কিন্তু মেয়ের জন্য কোনকিছু নেয়া হয়নি। বিশেষ করে হালকা-মুখরোচক খাওয়া নেয়া হয় দেখতে গেলে। তাই গেইটের বাহিরে এক হকার থেকে ২০ টাকার বাদাম কিনে নেওয়া। কিন্তু একটু পরে বাদাম ওয়ালা আবারও টাকা চেয়ে বসেন। উত্তরে বলি, না, আপনাকে সঙ্গে সঙ্গে টাকা দিয়ে দিছি; ওনি বলেন, না, আপনি টাকা দেন নি। আমি বললাম, দিয়েছি, দেখেন আপনার পকেটে খোঁজে। আপনাকে একটি বিশ টাকার নোট দিয়েছি। বাদাম ওয়ালাও তার গচ্ছিত টাকা খোঁজে দেখেন। আমিও যুক্তি দেখালাম। দেখেন, আমার কাছে একটি ১০০ টাকার নোট ছিল। আসতে গাড়ি ভাড়া ১৫ টাকা দিয়েছি, আর থাকে আমার কাছে ৮৫ টাকা। আপনাকে দিলাম দিলাম ২০ টাকা। আর অবশিষ্ট থাকে ৬৫ টাকা। টাকা বের করে দেখালাম। ঠিক আছে? এ বলে ফিরে গেলাম। লোকটিও হা হয়ে মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন; কিন্তু এনিয়ে দিনবর ভাবনার ধূম্রজালে ছিলাম। আসলে টাকা দিয়েছি; না, দিয়েছি। এরকম দ্বিতীয় আরেকটি ঘটনা ঘটে সাম্প্রতিক সময়ে। সেটি হলো জিইসি মোড় থেকে রাত ১০টার দিকে ফেরা সময় কাঁচা সবজি কিনছিলাম কয়েক আইটেমের। আসার সময়ে সর্বশেষ আরেকটি সবজি- আইটেম পছন্দ হলো। সেটিও দিতে বললাম। তিনিও ওজন দিয়ে হাতে ওঠিয়ে দিলেন। আমিও ফেরা পথে একটি ৫শ টাকার নোট দিই। বিক্রেতা বললেন, না, আপনি তো টাকা দিয়েছেন, এ-যে ৫শ টাকা; ওই টাকাও ফেরত নেননি। তিনি হাত থেকে টাকা বের করে দেখালেন! আমিও হ্যা বলে উত্তর দিলাম।
অবশ্য প্রফেসর সাহেব এদিক-সেদিক খুঁটিনাটি জিজ্ঞেস করে সম্মতি দিলেন এ সেট নিতে। আমিও পকেটের অবস্থা দেখে তাতে রাজি হলাম। ১২,৯৯৯ টাকায় ভিভো ওয়াই- ০৪ মডেলের এ হ্যান্ড সেট নেয়ার। এরমধ্যে এলেন বন্ধুবর বিশিষ্ট সাংবাদিক, ৭১-টিভির চট্টগ্রাম ব্যুরো প্রধান সাইফুল ইসলাম শিল্পী। সাংবাদিক সাইফুল ইসলাম শিল্পী দীর্ঘবছর ধরে দৈনিক দিনকাল পত্রিকা কাজ করে আসছেন। তখন সাংবাদিক নঈম মুস্তফাকেও ওই পত্রিকায় কাজ করতে দেখেছি চটগ্রামে। তিনি এখন দৈনিক কালের কণ্ঠের চট্টগ্রাম ব্যুরো প্রধান। অবশ্য তাঁরা যাঁর যাঁর মতো করে চলে গেলেন। আমাকে আরো কিছুক্ষণ থাকতে হয় এবং আপগ্রেড- প্রোগ্রাম ডাউন করে নিতে হয়। আর এরমধ্যে এ-বৃষ্টি পেয়ে বসে; তবুও হাতে ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে পড়ি। না, যথাভাবে ২-১ মিনিটে ভিজে লন্ডভন্ড। জুতো-প্যান্টে ও সার্টের অবস্থা কায়েল। হাতে জুতো নিয়ে একটি গণপরিবহনে টপকে ওঠি। যাচ্ছিলাম মেহেদীবাগ হয়ে গুলপাড়। রাস্তায় পানি জমে জলঝড়ে পরিণত হয়। অনেকটা নৌকা চলাচলের অবস্থা হয়ে ওঠে। জিইসি মোড়, কাজী দেউড়ী, লালখান বাজার, পবর্তকমোড়সহ নগর জুড়ে এ বেহাল চিত্র। মেহেদীবাগ ও জিইসি মোড়ে কোথায় রাস্তা, কোথায় ড্রেন কিছুই খোঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। গুলপাহাড় থেকে ভিজে-ভিজে হেঁটে যেতে হয়। মনের মধ্যে কেমন ভয় জেঁকে ধরে। ভাঙ্গাচুরা নালা- নর্দমায় ছিঁটকে পড়লে কি যে দশা হবে; এ শঙ্কায় নিয়ে জিইসি মোড় পার হতে হবে আল্লাহ জানে। বর্ষা-মৌসুমে শুরুতে এ হালচাল দেখা দিয়েছে নগর জুড়ে। আর লাগাতার বা টানা বর্ষণ হলে কেমন হতে পারে এ-বাণিজ্য নগরীর, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। অবশ্য এ সমস্যা একদিনে নয়। বিশেষ করে অপরিকল্পিত নগরায়নের ফলে এ খেসারত দিতে হচ্ছে নগর বাসীকে। তার মধ্যে নেই ড্রেনেজ ব্যবস্থা, বৈর্জ্য পুতনের ব্যবস্থা, রাস্তা সম্প্রসারণ এবং আবাসন ও বিপনিবিতান নির্মাণের হিড়িক।
এমনিতে নগরির রাস্তা সম্প্রসারণের নামে দিনে দিনে উল্টো সরু হতে চলেছে। শোভাবর্ধক নামেও রাস্তা সংকোচিত করা হচ্ছে। এমনিতে নগরির জনচলাচল-ফুটপাত ও ড্রেন-নালা দখলের প্রতিযোগিতা চলছে, যেন এক্ষুণি হুমড়ি খেয়ে পড়বে রাস্তার ওপর।
আপাতত যেভাবে বিন্যাস করা যেতে পারে। রাস্তা, ড্রেন ও ফুটপাত। এ তিনের মধ্যে ফুটপাতের পর ৫ ফুট মাটি অবশ্য থাকতে হবে। ওই ৫ ফুট মাটিতে তৃণলতা-ঘাস বা বাগান- বৃক্ষ থাকতে পারে। এখানেও একের ভেতর তিন কার্যকারিতা প্রতিফলিত হবে। প্রথমত এ মাটি বৃষ্টির পানি চুষে নেবে। তারপর ওভার হলে ক্রমান্বয়ে পানি ড্রেনে, নর্দমা বা খালে গিয়ে পড়বে। সর্বশেষ তা নদি-সাগরে নিষ্পেষিত হবে। বৃক্ষ দিবে সুশীল ছায়া ও অক্সিজেন। এরপর হবে ১৫ ফুট দুরত্ব বজায় রেখে আবাসন বা বাণিজ্যলয়। ওই স্থাপনার দুই পাশে থাকতে হবে ১০ ফুট করে খালি। সেটিও পুরোটা মাটি থাকতে হবে। থাকবে মুক্ত আবহাওয়া চলাচল ব্যবস্থা। এখানেও ছোট ও মাঝারি আকারে ফলজ উদ্ভিদ বা বাগান বিলাস গাছ থাকতে হবে। আর পেছনের দিকে থাকবে খালি ১৫ ফুট। এটিও পুরোটা মাটি থাকতে হবে। তাতে গর্ত করে বর্জ্য পুতনের ব্যবস্থা করা যায় নিজ নিজ আঙ্গিনায়। অবশ্য তা হবে সল্পপরিসরে এবং মাটি দিয়ে প্রতিদিন বর্জ্য ঢেকে দিতে হবে, যেন দুর্গন্ধ ছড়ায়। সঙ্গে পৃথক পৃথক স্থানে পচনশীল বস্তু পুড়িয়ে মাটিতে পুতে দিতে হবে। অথচ এখন তো নগরে কোথাও এক মুঠো মাটি খুঁজে পাওয়া যাবে না; উন্মুক্ত মাটি যে কিপরিমাণ উপকারিতা আছে, তা বলে শেষ করা যাবে না। অতিরিক্ত তাপদাহও চুষে নেয় মাটি। যা পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে। তার সঙ্গে নির্দিষ্ট পরিমাণ পানিও চুষে নেয়ার সক্ষমতা রাখে।
নগরি জুড়ে বড়-বড় যেকয়েকটি খাল রয়েছে, ওইগুলোর দু-পাশে চলাচলের রাস্তা হলে আরো ভালো হয়। যা কিনা খাল ব্যবস্থাপনাসহ যেকোনো তড়িৎ ব্যবস্থা নেয়ার সহায়ক হতে পারে। মনে রাখতে হবে, চট্টগ্রাম শহরের চতুর্দিকে নদ-নদী-সাগরে পরিবেষ্টিত। এর ফলে প্রত্যহ জোয়ার-বাটা প্রবাহিত হয়। এতে কিন্তু নদ-নদী ও সাগরের জল প্রবাহ নিয়ন্ত্রণও হয়। তাই খালের মুখে স্লুইসগেট থাকাটা বাঞ্ছনীয়। যেন জলোচ্ছ¡াস ও ঘূর্ণিঝড়ের কবল থেকে শহরবাসীকে রক্ষা করা যায়। তবে স্বাভাবিক সময়ে খালের মুখ খোলা থাকলেও সমস্যা হওয়ার কথা নয়। সময়ে সময়ে জোয়ারের পানি প্রবেশ করলে শীতল পরিবেশ বজায় থাকবে। এতে করে রাতে বিদ্যুৎ সাশ্রয় হবে। আর এর সুফল যেভাবে আসতে পাবে। শীতল পরিবেশ বহিতে থাকলে তো এমনি এসি ও বৈদ্যুতিক পাখা চালু রাখা প্রয়োজন পড়বেনা। তাতে ব্যবহার করতে হবে না অন্তত রাতে। সঙ্গে নগরবাসী মাছ শিকারও করতে পারবে অবসর সময়ে। অবশ্য একথা না বললেই নয়, বহু কাঙ্ক্ষিত বৃষ্টি হওয়ায় কিছুটা স্বস্তি ফিরে এসেছে। শরীরজুড়ে ঝালাপোড়া কমেছে। বিশেষ করে হাতে-পায়ে চুলকানি বেড়ে যাওয়ায় এবং ছোটো-ছোটো চাকচাক অসংখ্য গামাচি শরির জুড়ে এবং তিব্র তাপদাহেও বেড়েছে ঝালাপোড়া। আর এমন ঝালায় পুড়েছে শরির যাদের, তাদের কাছে এনে দেয় এসি এক অভূতপূর্ব প্রশান্তি।
তারপরও এসির নিচে বা পানিতে ডুবে থাকা মোটেই সম্ভব নয়; অবশ্যই এসব ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা প্রয়োজন পড়ে। মোদ্দা কথা, একবার অভ্যস্থ হয়ে পড়লে অন্য কোনো পরিবেশ সহনীয় হয় না। সারাক্ষণ অস্তির অস্তির ভাব এবং রাতে ঘুম আসে না। মাথা হয়ে ওঠে খিটখিটে। কথায় কথায় ঝগড়াবিবাদ। এমন একটি ঘটনা ঘটে খোদ আমাদের গ্রামে। ব্যবসায়ী ইউসুফকে নিয়ে। তাঁকে এ চরম আসক্তি পেয়ে বসে। ঘরে তাঁর এসি নেই, কিন্তু মসজিদে নামাজ পড়েন এসি ব্যবস্থায়। প্রতিদিন তিন ওয়াক্ত নামাজ আদায় করেন এসিতে। কাজটি হলো আল্লাহ্ ও মুমিনদের চোয়াবের আশায়। তাই একটু আগেভাগে মসজিদে গিয়ে অবস্থান নেন এবং নিয়মিত নামাজও পড়ছিলেন। এতে কারো কোনোপ্রকার আপত্তি নেই। কিন্তু সমস্যা হলো ইউসুফের ঘরে তো আর এসি নেই। এতে তাঁর অজান্তে সমস্যাটি প্রকট আকার ধারণ করে। ইউসুফ ঘরে গেলে আনসান-আনসান করে মন। কিছুতেই তার ভালো লাগে না। রীতিমতো রাগে ভাত-পানি পর্যন্ত খাওয়াও ছেড়ে দিয়েছেন নিজ ঘরে। সমস্যাটা কোথায়, পরিবারের সদস্যরাও তা জানেন না। শেষমেশ ঘটনাটি সমাজপতির কানে এলো। তখনি বিষয়টি পরিষ্কার হয়।
কথা হলো এসি যেমন উত্তম তেমন অধমও। সাধারণ মেহনতি-জনতার জন্য এটি বুমেরাং বলা যায়। একদিকে শ্রমশক্তি হ্রাস পায়, অন্যদিকে চরম দারিদ্রতা মুখোমুখি করে দেয়। এমন একটি ঘটনা উদাহরণ হিসেবে হাতে আছে। বলছিলাম জননেতা এলকে সিদ্দিকীর কথা। তিনিও জীবদ্দশায় এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হন। তাঁর বাড়ি চট্টগ্রামে সীতাকুন্ডের মুরাদপুর ইউনিয়নে। তিনি সর্বশেষ ২০০১ সালে চট্টগ্রাম-২ আসন থেকে এমপি নির্বাচিত হন এবং সরকারের মন্ত্রী পরিষদের পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত হন। অবশ্য আসন থেকে ৪ বার এমপি নির্বাচিত হন এবং একাধিক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী ছিলেন তিনি। এ প্রথিতযশা রাজনীতিবিদ গ্রামে এলে গ্রামের সমজিদে নামাজ পড়তেন। মসজিদটি তাঁদের পারিবারিক এবং নিজেদের পরিবার কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত ছিল। তাছাড়া তিনি মসজিদ কমিটিরও সভাপতি ছিলেন। তাঁদের মসজিদটির নামে বেশ সম্পত্তি আছে। অবশ্য তিনি বেশিরভাগ সময় ধরে রাজধানী ঢাকায় থাকতেন, রাজনীতি ও পেশাগত দায়িত্বের কারণে। এরমধ্যে একদিন জানতে পারলেন মসজিদে এসি লাগানো হয়েছে, মসজিদের সম্পত্তি বিক্র করে। এতে তিনি ক্ষুব্ধ হলেন এবং এরপর এ মসজিদে আর নামাজ পড়েন নি জীবদ্দশায়।
দেশের পরিবেশ-পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠেছে ক্রমান্বয়ে। মানবিক করিডর ও বিদেশিদের হাতে চট্টগ্রাম বন্দর দেয়ার বিষয়ে- যেকোনো সিদ্ধান্তে প্রতিরোধ গড়ে তুলবে দেশের মজলুম-জনতা। সাধারণ জনগণের পাশাপাশি সুন্নি মুসলি-মজনতা এ বিষয়ে সোচ্চার হয়ে ওঠেছেন। তাঁরা মানবিক করিডর ও চট্টগ্রাম বন্দর নিয়ে এসব সিদ্ধান্ত মেনে নেবে না বলে হুশিয়ারী দিয়েছেন। গত মঙ্গলবার ২০ মে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের সম্মুখে সুন্নি জনতার মানববন্ধন ও প্রতিবাদ-সভা আয়োজন করেন।
লেখক : কবি গবেষক ও কলামিস্ট