বিনিয়োগই হবে দেশের প্রধান চালিকাশক্তি

1

নিজস্ব প্রতিবেদক

দেশের জন্য প্রথম যেটি দরকার সেটি হচ্ছে বিনিয়োগ, দ্বিতীয় যেটি দরকার সেটি হচ্ছে বিনিয়োগ এবং তৃতীয় যেটি দরকার সেটিও হচ্ছে বিনিয়োগ। বিনিয়োগ হলে আত্মকর্মসংস্থান হবে, চাকরি হবে। বিনিয়োগ ছাড়া কোনো কিছু সফল হতে পারবে না-এভাবেই বিনিয়োগকেই দেশের অগ্রগতির মূল চাবিকাঠি হিসেবে উল্লেখ করেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী।
তিনি বলেন, জিয়াউর রহমান দেশে মুক্তবাজার অর্থনীতি ও গণতন্ত্রের কথা বলেছিলেন। দেশে গণতন্ত্র প্রয়োজন। গণতন্ত্র না হলে বিনিয়োগ আসবে না। বিনিয়োগ আসার জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রয়োজন। জনগণের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত সরকার না হলে দেশের স্থিতিশীলতা থাকে না। জনগণের সরকার না আসলে বিনিয়োগ আসবে না।
গতকাল শুক্রবার চট্টগ্রাম নগরীর কাজির দেউড়ি আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ‘কর্মসংস্থান ও বহুমাত্রিক শিল্পায়ন নিয়ে তারুণ্যের ভাবনা’ শীর্ষক সেমিনারে তিনি এসব কথা বলেন। জাতীয়তাবাদী যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও ছাত্রদলের যৌথ আয়োজনে এ সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। এতে সাত শতাধিক লোক সমাগম হয়।
বিনিয়োগ পরিস্থিতি সম্পর্কে তিনি বলেন, আমরা তো এখন বিনিয়োগের সার্কাস দেখছি। যারা বিনিয়োগ বুঝে, তারা জানে বিনিয়োগ হবে না। যখন জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকার হবে তখনই বিনিয়োগকারীরা আশ্বস্ত হবে। আর সেই সরকারের পলিসি দেখে, মনোভাব দেখবে বিনিয়োগ করার জন্য। আমাদের দেশে কিন্তু এখনো নির্বাচিত সরকার হয়নি। দেশের জনগণের কাছে জবাবদিহির সরকার হয়নি। যতক্ষণ সেটা না হবে, ততক্ষণ রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আসবে না, আর ততক্ষণে বিনিয়োগ হবে না।
আমীর খসরু মাহমুদ বলেন, ‘তারুণ্যের ভবিষ্যৎ ভাবনা, ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ’ এ সেমিনারে এসে আপনারা কি শিখলেন? এখান থেকে কি শিক্ষা নিয়ে যাচ্ছেন? আজকের এই সেমিনার থেকে আপনারা তিনটি শিক্ষা নিয়ে যাচ্ছেন। আর এ তিনটি শিক্ষা রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে অনেক বড় পরিবর্তনের প্রমাণ করেছে।’
তিনি বলেন, ‘তিনটি শিক্ষার মধ্যে প্রথমটা হচ্ছে, সম্বোধনের পালা থেকে মুক্তি পেয়েছি। এখানে কেউ সম্বোধন করে নাই। সম্বোধন করার দিন শেষ হয়ে গেছে এখন। হাতে এখন সম্বোধন করার সময় নেই।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য বলেন, ‘দ্বিতীয় যেই শিক্ষা, সেটা হচ্ছে, দেশের একটি রাজনৈতিক দলের কর্মসূচিতে এখানে যারা বসে আছেন, তাদের উপস্থিতি সাধারণত থাকে না। কিন্তু বিএনপি একটা নজির স্থাপন করেছে। যারা বিএনপি করে না কিন্তু বিএনপির ফোরামে এসে তারা তাদের কথাগুলো বলতে পারে। এটা অনেক বড় পরিবর্তন পলিটিক্যাল কালচার হিসেবে। মানে রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে অনেক বড় পরিবর্তন।’
তিনি আরও বলেন, ‘তৃতীয় শিক্ষাটি হলো সামনে নেতারা বসে আছেন। কিন্তু কেউ বক্তৃতা দেননি। এটা বিএনপির রাজনীতিতে, বিএনপির সংস্কৃতি, রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে যে পরিবর্তন এসেছে, এটা আজকের এ অনুষ্ঠান প্রমাণ করেছে।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য বলেন, ‘কেননা, শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পরে দেশের জনগণের মনোজগতে বিশাল পরিবর্তন যেটা এসেছে, সেটা যারা অনুধাবন করতে পারবে না, ধারণ করতে পারবে না। তাদের কোনো রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নেই। সে দলেরও নেই, রাজনীতিবিদেরও নেই। আমি মনে করি, সেটা আমরা (বিএনপি) ধারণ করতে পেরেছি।’
ক্ষমতায় আসলে ১৮ মাসে ১ কোটি লোকের চাকরির ব্যবস্থা করা হবে জানিয়ে তিনি বলেন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা কখন হয়? যখন জনগণের ভোটে সরকার গঠন করা হয়, যেই সরকার জনগণের কাছে জবাবদিহি থাকে, নির্বাচিত হওয়ার জন্য জনগণের কাছে বারবার যেতে হয়, তখনই রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকে। শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ নিয়ে বিএনপির প্রতিশ্রæতি জানিয়ে তিনি বলেন, আগামী দিনে শিক্ষা খাতে জিডিপির ৫ শতাংশ বরাদ্দে বিএনপি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। দেশের রিপ্রোডাক্টিভ যেটা, ব্যবসা হোক বা চাকরি হোক, এটা প্রোডাক্টিভ করার জন্য প্রধান যে কাজ তা হল শিক্ষা। সারা বিশ্বে শিক্ষার বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আমরা সবচেয়ে নিচের দিকে। এজন্য বিএনপির ৩১ দফায় আমরা প্রস্তাব দিয়েছি, আগামী দিনে জিডিপির ৫ শতাংশ বাজেট বরাদ্দ করা হবে। এটা একটা বড় অ্যাকাউন্ট। এই বাজেট ব্যয় করা হবে স্কিল ডেভেলপ করতে, রি-স্কিল ডেভেলপ করতে। এই বিনিয়োগে বিএনপি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।
অর্থনীতির কাঠামোগত সমস্যার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, বাংলাদেশ একটি ‘হাইলি রেগুলেটেড কান্ট্রি’। এটি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা। এর কারণে আমাদের ইনভেস্টমেন্ট ডিসিশন নিতে গেলে যত ধরনের বাধা আছে, সমস্যা আছে, সেগুলো রিমুভ করা যায়। শুরুতে এই বাধাগুলো ইরেগুলেশন ও লিবারালাইজেশনের মাধ্যমে যদি আমরা রিমুভ করতে পারি, তাহলে প্রথম ইনসেনটিভ হলো সবার জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করা। অর্থাৎ ডেমোক্রেটাইজেশন অব দ্য ইকোনমি। আপনি শুধু রাজনীতিকে গণতান্ত্রিক করবেন, আর অর্থনীতিকে করবেন না, এটা হবে না। অর্থনীতিকে গণতান্ত্রিক করতে হবে, যাতে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের সুযোগ থাকে। এটা হল সবচেয়ে বড় ইনসেনটিভ। দ্বিতীয় হলো জনসংখ্যাকে জনশক্তিতে পরিণত করতে হবে।
প্রযুক্তি বিষয়ে তিনি বলেন, টেকনোলজিক্যালি জাতিকে এগিয়ে আসতে হবে। যে দেশ টেকনোলজিতে পিছিয়ে থাকবে, তাদের সামনে যাওয়ার সুযোগ নেই। সেটা কৃষি হোক, সেবা হোক, ইন্ডাস্ট্রিয়াল ম্যানুফ্যাকচার হোক বা সরকার পরিচালনায় হোক। স্বচ্ছতা বাড়াতে, প্রোডাক্টিভিটি বাড়াতে অবশ্যই বিশ্বের মানদÐ অনুযায়ী টেকনোলজি উন্নয়ন করতে হবে।
গার্মেন্টস সেক্টর নিয়ে বিএনপির নীতিমালা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আগামীতে আমরা গার্মেন্টসসহ আরও ১০–১২টা সেক্টরকে লিবারালাইজ করবো। আমরা এদেরকে ব্যাক-টু-ব্যাক এলসি, বন্ডেড হাউজ দেবো—যা অনেক বড় সুযোগ তৈরি করবে। গার্মেন্টস সেক্টরে ব্যাক-টু-ব্যাক এলসি সুযোগ থাকায় তরুণরা উঠে আসার সুযোগ পাচ্ছে, আগামীতে অন্য যে সেক্টর রয়েছে, সেগুলোতেও এই সুযোগ দেওয়া হবে।
বিনিয়োগে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূর করার পরিকল্পনার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের যাতে আমলাদের কাছে যেতে না হয়, সে পরিকল্পনা আমাদের আছে। আমরা যে টেকনোলজির কথা বলছি, সেটা হবে—সব কিছুর সিদ্ধান্ত অনলাইনে হবে। বাসায় বসে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে যে কোনো কোম্পানি রেজিস্ট্রেশন করা যাবে। এক্ষেত্রে যত ধরনের সরকারি অনুমতির বিষয় আছে, সব কিছু অনলাইনে করা যাবে।
বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে নতুন উদ্যোগের কথা জানিয়ে তিনি বলেন, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য বিএনপি যে পদক্ষেপের কথা বলছে, তা দক্ষিণ এশিয়ার কোথাও নেই। যারা বিদেশ থেকে বিনিয়োগ করতে আসবে, তাদের প্রত্যেকের জন্য বিডা থেকে একজন করে ‘ক্যাপ্টেন’ নিয়োগ করব। দেশের ইয়ং শিক্ষিত ছেলে-মেয়েরা এই ক্যাপ্টেনের দায়িত্ব পালন করবে।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের উপদেষ্টা মাহদী আমিনের উপস্থাপনায় সেমিনারে বিভিন্ন বিষয়ের উপর বক্তব্য রাখেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও এক্টিভিস্ট ডা. জাহেদ উর রহমান, বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপকমিটির সদস্য ইসরাফিল খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ইস্টডেল্টা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক নাজিম উদ্দিন, স্টেট ইউনির্ভাসিটির ভিসি আখতার হোসেন, প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি নসরুল কদির, যুক্তরাষ্ট্রের স্যানট্যান্ডার ব্যাংকের সিনিয়র ডাইরেক্টর শাফকাত রাব্বী, ইস্ট ডেল্টা ইউনিভার্সিটির প্রতিষ্ঠাতা সাইদ আল নোমান, অনলাইন অ্যাক্টভিস্ট সাইয়েদ আব্দুল্লাহ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রোভিসি কামাল উদ্দিন, চট্টগ্রাম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ওমর ফারুক, বিশ্বখ্যাত টেকনোলজি কোম্পানি ওয়ারকলের সিনিয়র ইঞ্জিনিয়ারিং ম্যানেজার মুনতাসির মুনীর, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. নাহরিন খান, বিশিষ্ট চলচ্চিত্র নির্মাতা মাবরুর রশিদ বান্নাহ, যুক্তরাষ্ট্রের কর্ণেল ইউনিভার্সিটির শিক্ষক ড. জামাল উদ্দিন, ডিজিটাল প্লাটফর্ম পাঠাও এর সিইও ফাহিম আহমেদ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও বিশ্লেষক ড. আব্দুল্লাহ-আল-মামুন।