নাজমুল হাসান চৌধুরী হেলাল
বিশিষ্ট সমাজসেবক, শিক্ষানুরাগী, আবদুল করিম সওদাগর ছিলেন সমাজ সংস্কারক। ফটিকছড়ি ‘বারমাসিয়া’ সুয়াবিল ইউনিয়নের একটি গ্রাম। গ্রামের নামকরণটিও বেশ সুন্দর। বারমাসিয়া খাল গ্রামের বুক ছিঁড়ে হালদায় মিলিত হয়েছে। বারমাস পাহাড়ের সচ্ছ জলরাশি প্রবাহমান ছিলো বলে বারমাস্যে খাল হতে বারমাসিয়া গ্রাম। পাখি ঢাকা ছায়াঘেরা, খাল, পুকুর, টিলা, পাহাড় চির সবুজের হাতছানি দেওয়া জলছবির মতো বারমাসিয়া। গ্রামটি অবস্থান হালদা নদীর কাছাকাছি। একসময় গ্রামের পাশে নৌঘাঁটি ছিল। নৌকা সাম্পানও ভিড়ত ঘাটে। তখনখার দিনে নদীর ছোটো-ছোটো ঢেউ তুলে বারোমাস। ছায়াঢাকা এক মনোরম পরিবেশে বন বনানীতে ঘেরা উত্তর চট্টলার সুয়াবিল ইউনিয়নের বারমাসিয়া গ্রাম তথা সুয়াবিল এলাকার অনেক গ্রাম শিক্ষাদীক্ষায় অনেকটা অনগ্রসর ছিল। যোগাযোগ ব্যবস্থা অনুন্নত থাকার কারণে ছেলে মেয়েদের দূরবর্তী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যাতায়াতে অসুবিধার সম্মুখীন হতে হতো। বিশেষ করে মেয়েদের পড়ালেখা করার মত সুযোগ একেবারেই সীমিত ছিল। এমতাবস্থায় তখনকার সময়ে এ বিস্তীর্ণ অঞ্চলের অবহেলিত ছেলেমেয়েদের পড়ালেখার সুযোগ সুবিধা এগিয়ে নেয়ার প্রচেষ্টা চালিয়েছেন সরকার বাড়ির হাজী বাকর আলী সরকার। তিনি বারমাসিয়া চা বাগানের ব্যবস্থাপক হিসেবে কর্মরত থাকা অবস্থায় বাগানের এক বিদেশি কর্মকর্তার অনুপ্রেরণায় স্থানীয় গণ্যমাণ্য ব্যক্তিদের উদ্বুদ্ধ করে তাদের সাথে নিয়ে বারমাসিয়া গ্রামে ১৯২৮ সালে প্রতিষ্ঠা করেন বারমাসিয়া মিডল ইংলিশ স্কুল (বারমাসিয়া এম ই স্কুল) তখন বিদেশি কর্মকর্তারা স্ব-পরিবারে চা বাগান এলাকায় বসবাস করতেন। এ বিদ্যালয়ের কার্যক্রম শুরু হয়েছিল ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণি পাঠদানের মধ্য দিয়ে। পাকভারত দেশভাগের পরে স্কুলটি কার্যক্রম পরিচালনা করা কঠিন হয়ে পড়ে। পঞ্চাশ দশকের পরে আর্থিক দৈন্যদশায় বিদ্যালয়টি বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলে, তৎকালীন সভাপতির দায়িত্বে থাকা কাজী বাড়ী নিবাসী আবদুল জব্বার বিএ সাহেব এবং সেক্রেটারির দায়িত্বে ছিলেন আবদুল জলিল সরকার। ১৯৬১ সালে আবদুল জলিল সরকার সেক্রেটারির দায়িত্ব অর্পণ করেন পশ্চিম সুয়াবিলের ধনাঢ্য ব্যবসায়ী ও শিক্ষানুরাগী জনাব আবদুল করিম সওদাগর সাহেবকে। স্কুল প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই আবদুল করিম সওদাগর সক্রিয়ভাবে সম্পৃক্ত দিলেন। এ বিত্তশালী ব্যক্তি দায়িত্ব গ্রহণের পর স্কুলের অবকাঠামোগত পরিবর্তন শুরু করেন। বাঁশের বেড়া টিনের ছাউনি স্কুল গৃহের স্থলে, তাঁর আন্তরিক প্রচেষ্টায় দ্বিতল পাকা ভবন নির্মাণ করেন। বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে তিনি এই স্কুলকে উচ্চ বিদ্যালয়ে রূপান্তরের কাজে নেমে পড়েন। তাঁর প্রচেষ্টা ছিল স্কুলটিকে উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে রূপান্তরের। তার আন্তরিক উদ্যোগে ১৯৬৭ সালে নবম শ্রেণি চালু করেন এবং দৌলতপুর এবিসি বিদ্যালয় থেকে ১৯৬৯ সালে শিক্ষার্থীরা এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহন করেন।এবং সকল শিক্ষার্থী শতভাগ সাফল্য অর্জন করে বিদ্যালয়কে একধাপ এগিয়ে নেন। ইতিমধ্যে ১৯৬৮ সালে বিদ্যালয়ের নাম আর একবার পরিবর্তিত হয়। সর্বস্তরের জনগণের মতামতের ভিত্তিতে ও সকলের সমর্থনে নতুন নামকরণ করা হয় বারমাসিয়া আবদুল করিম উচ্চ বিদ্যালয়।এই নামকরণের মাধ্যমে একজন প্রকৃত শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিকে যথাযতভাবে সম্মানিত করা হয়েছে বলে সকলে সহমত ব্যক্ত করেন। ১৯৭০ সালে মানবিক বিভাগ থেকে বিদ্যালয়ের প্রথম ব্যাচ এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে সকল পরীক্ষার্থী সফলতার সাথে উত্তীর্ণ হয়।ফলাফলে প্রথম ব্যাচ পরীক্ষার্থীর মধ্যে ১জন প্রথম বিভাগ, ১১জন দ্বিতীয় বিভাগ, ৪জন তৃতীয় বিভাগ অর্জন করেন। প্রথম ব্যাচের পরীক্ষায় আশানুরূপ ফলাফলে শিক্ষক, অভিভাবক ও পরিচালনা পরিষদ সকলে আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে ওঠে।এতে বিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি সমুজ্জ্বল হয়ে ওঠে।আবদুল করিম সওদাগরের সক্রিয় ভূমিকায় একটি ভাল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিদ্যালয়ের নাম চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে। তৎকালীন শিক্ষাবোর্ড ছিল কুমিল্লায়, সেই সময় শিক্ষা অফিসার আতাউর রেজার সহযোগিতায় বিদ্যালয়ের কার্যক্রম দ্রæত এগিয়েছিল। পর্যায়ক্রমে ১৯৭৪ সালে মাধ্যমিকে বিজ্ঞান বিভাগ চালু করার অনুমতি দেয় শিক্ষাবোর্ড। ১৯৭৬ সালে অনুমতি দেয় বানিজ্য বিভাগ চালু করার।এভাবে আবদুল করিম সওদাগরের পরিশ্রম ও আন্তরিকতায় এবং শিক্ষক শিক্ষার্থী ও অভিভাবক সহ বিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট সকলের সহযোগিতায় বারমাসিয়া আবদুল করিম উচ্চ বিদ্যালয় সমৃদ্ধি লাভ করে। শিক্ষা উন্নয়নের পূর্বশর্ত।শিক্ষা ব্যতিত সচেতন ব্যাক্তি সৃষ্টি কোনক্রমই সম্ভব নয়। শিক্ষায় যে দেশ যত বেশি উন্নত সে দেশ ততই বেশি অগ্রসরমান। সামগ্রিক পরিকল্পনার সফল বাস্তবায়নে শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। এই বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সাথে জড়িত ব্যক্তিবর্গের দক্ষতা দৃঢ়তা ও বলিষ্ঠ নেতৃত্বে কারণে আজ সুয়াবিল, সুন্দরপুর হারুয়ালছড়িবাসী ঘরে ঘরে শিক্ষার আলোয় আলোর অভিযাত্রী হতে পেরেছে। আবদুল করিম সওদাগর ১২ নভেম্বর ১৯৬১ থেকে ১৪ অক্টোবর ১৯৮৭ পর্যন্ত একাধারে ২৭ বৎসর বিদ্যালয় পরিচালনা পরিষদের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৮৮০ সালে রহমত আলী ও আতর জাহানের প্রথম সন্তান তাদের কোলে যে আলো হয়ে এসছিল, তারা কি জানতেন তাদের সন্তান শিক্ষার আলোয় আলোকিত করবে পুরো এলাকা? তখনকার একটা সাধারণ পরিবারের ছেলের মতই বেড়ে উঠেছিলেন তিনি।কিন্তু স্বপ্নের ব্যাপ্তি ও উচ্চতায় তিনি ছিলেন ব্যতিক্রম। শৈশব পেরিয়ে দুরন্তপনার কৈশোরে পা রাখতেই তিনি বাবাকে হারান। কিন্তু কিশোর বয়সেও তাকে দায়িত্বে অপরিপক্ব রাখতে পারেনি। তিনি পরিবারের হাল ধরেন। ১৯ বছর বয়সে তিনি ছোট আকারে ব্যবসা শুরু করেন। অভিজ্ঞতা আর সময়ের সাথে তার ব্যবসার পরিসর বৃদ্ধি পেতে লাগলো। তার একটি বিশেষ গুণ ছিল ব্যবসায়িক দুরদর্শিতা। আবদুল করিম সওদাগরকে যারা কাছ থেকে দেখেছেন তাদের মতে, তার মাঝে এই গুণটা প্রখরভাবে ছিল। সকলের কাছে তিনি পরিচিত হয়ে উঠলেন একজন সফল ব্যবসায়ী ও শিক্ষানুরাগী হিসেবে। ব্যবসার পাশাপাশি তিনি অবহেলিত জনগোষ্ঠীকে পড়ালেখার সুযোগ সুবিধা জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়ার জন্য জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত চেষ্টা চালিয়ে নেন। তিনি একজন আদর্শ ও কর্তব্যপরায়ণ মানুষ ছিলেন। এই বিদ্যালয়কে একটি আদর্শ বিদ্যালয়ে উন্নত করা ব্রত হিসেবেই তিনি গ্রহন করেছিলেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি বিনয়ী, সদালাপী, প্রচার বিমুখ ও মুক্তচিন্তার অধিকারী ছিলেন। তাঁর অসংখ্য গুণগ্রাহী রয়েছে। এমন নিঃস্বার্থ, নির্লোভ, বিদ্যালয় প্রেমিক আবদুল করিম সওদাগর মানুষ হিসেবে তথা পার্থিব জগতের লোভ লালসা ত্যাগ করা নিরহংকার, অত্যন্ত সাধাসিধে জীবন যাপন, ভাল মানুষ হিসেবে এলাকা বাসীর কাছে সুপরিচিত ছিলেন। তিনি পড়ালেখা শিখেছিলেন মাঝ বয়সে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মরহুম ছাবেদুর রহমানের কাছে। তিনি প্রাথমিক শিক্ষার গÐি পেরুতে পারেননি,তখন থেকেই তার মাঝে ভাবনা ছিল শিক্ষা বিস্তারে কিছু করার যাতে এলাকার মানুষ উপকৃত হয়। সংগ্রাম ও সফলতায় গাঁথা আবদুল করিম সওদাগরের পার্থিব জীবনের ইতি ঘটে ১৪মে ১৯৯৪ সালে পহেলা জ্যৈষ্ঠ ১৪০১ বঙ্গাব্দে। শিক্ষার চলমান গ্রোতে তার রেখে যাওয়া প্রতিষ্টান শিক্ষার আলো ছড়াবে যুগ যুগ ধরে। একটি আদর্শ বিদ্যালয় বলতে যা বুঝায়, বারমাসিয়া এ কে উচ্চ বিদ্যালয়ে তা রয়েছে বিধায় এ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী হতে পেরে আমি নিজেকে ধন্য মনে করছি। এই বিদ্যালয়টি দেশের সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রূপ লাভ করুক সেটাই আমাদের প্রত্যাশা। তথ্যগুলো যাদের থেকে পেয়েছি,আমার শ্রদ্ধেয় বাবা মরহুম আহমদ ছোবহান চৌধুরী, আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক মোহাম্মদ নুরুল আলম স্যার।
লেখক : প্রাবন্ধিক