বিদায় ২০২৪

1

আজ লাখো মানুষের কৌতুহলকে সঙ্গীন করে গোধূলি সন্ধ্যায় পশ্চিমা আকাশে ২০২৪ এর শেষ সূর্যটি অস্ত যাবে, এর সাথে বিদায় হবে একটি বছরের। বিদায় ২০২৪। সময় কারো জন্য অপেক্ষা করে না, আপন গতিতে বহমান সময় কখন যে ফুরিয়ে যায় কেউ বলতে পারে না। ২০২৪ ও তেমনি। ৩৬৫ দিনের বছরটি চোখের পলকে যেন হারিয়ে যাচ্ছে। এ বিদায়ক্ষণের অবস্থা বর্ণনায় একজন লেখক বলেছেন, সময় পুরায়নি, বরং সময় এসেছে দেনা-পাওনার হিসেব চোকানোর। আর এই দেনা-পাওনার হিসেব হচ্ছে মানবীয় জীবনের। যে সংকল্প নিয়ে আমরা শুরু করেছিলাম, এ বছর তা কতটুকু পূরণ করতে পেরেছি? কতটুকু অন্যের প্রতি মানবিক হতে পেরেছি? নিজ নিজ ধর্মীয় মূল্যবোধ পালন করতে পেরেছি কতটুকু? আজকেই উপযুক্ত সময় একটু পেছনে ফিরে তাকানোর। আর সেই পেছনে ফিরে যাওয়ার জন্য আমাদের কিছু প্রশ্নের সাহায্য নিতে হবে। মনে রাখতে হবে পেছনে ফিরে তাকানো মানে এই নয় যে, পেছনে পড়ে থাকা। এই পেছনে ফিরে তাকানোর মাধ্যমে আগামীতে সামনের দিকে চলার জন্য গতি পেতে সাহায্য করে। ইংরেজিতে বলে খড়ড়শরহম ইধপশ, ষড়ড়শরহম অযবধফ. কম বেশি সবার কাছে দূরে থাকা, বিচ্ছিন্নতা, আতঙ্ক, মহামারির একটি বছর ছিল ২০২৪। অনেকে জড়তা, ভয় ও শঙ্কাকে পাশে ঠেলে আবার জাগছে সব নতুন স্বাভাবিকতায়।
নানা ঘটনা, নানা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে বছরটি বিদায় নিয়েছে। ২০২৪ এর গণঅভ্যুত্থান এদেশের ইতিহাসের নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। এ বছরের জুলাই এর তীব্র ছাত্র-গণ আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের (৫ আগস্ট) পর দেশে এসেছে নতুন অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকার। নোবেলবিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত এই সরকারের যাত্রা শুরু হয়। ছাত্রহত্যার বিচার, রাষ্ট্রসংস্কারসহ বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে সরকার। মানুষ আশা করছে এর মাধ্যমে দেশে একটি কার্যকর পরিবর্তন আসবে এবং মানুষ জুলুম ও অবিচার থেকে স্থায়ীভাবে রেহাই পাবে। পাশাপাশি বিশ্বজুড়ে নানা সংঘাত, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, ফিলিস্তিনে ইতিহাসের বর্বর হামলা চালিয়ে ইসরায়েল কর্তৃক হাজার হাজার মানুষ হত্যাসহ নানা ঘটনা ঘটে। নতুন বছরে আমাদের শপথ নিতে হবে একটি সুন্দর এবং শান্তিপূর্ণ একটি বিশ্ব গড়ার, দেশ গড়ার। একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে মধ্যপ্রাচ্যে ভারসাম্য বজায় রাখতে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। আমাদের দেশেও নানারকম সমস্যা বিদ্যমান। এসব সমস্যার সমাধানে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। কোন দেশ বা ব্যক্তিকে খবরদারি আর নাক গলানোর সুযোগ দেওয়া যাবেনা কোনভাবেই। আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে যে ঐক্য গড়ে উঠেছে তা স্থায়ী ও মজবুত করতে সবাইকে কাজ করতে হবে। নতুন বছরে আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে গড়ে উঠা এই ঐক্য আরো সুদৃঢ় হোক। কোনসময় যেন আর কোন ফ্যাসিবাদ ফিরে আসতে না পারে সেজন্য সবাইকে সচেতন ও সজাগ থাকতে হবে। গড়ে তুলতে হবে জাতীয় ঐক্য। জুলাই বিপ্লবের চেতনা সমুন্নত রাখতে হবে। তাদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে পাওয়া নতুন এই বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে।
স্বাধীনতার এত বছর পরও আমরা কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারিনি। দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, সন্ত্রাস, খুন, পারস্পরিক অবিশ্বাসসহ নানা কারণে আমরা পিছিয়ে পড়েছি। পারছি না শিক্ষা-দীক্ষায়, বিজ্ঞানে উন্নতির শিখরে পৌঁছতে। নববর্ষে নতুন করে, গণঅভ্যুত্থানের স্পিরিট ধারণ করে তাই আমাদের শপথ নিতে হবে ঐক্যবদ্ধভাবে ভেদাভেদ ভুলে আমরা হাতে হাত ধরে যেনো এগিয়ে যেতে পারি। সকলকে নিয়েই তো আমার এদেশ, প্রিয় বাংলাদেশ। এদেশটিকে আমরা নিজেদের মনের মতো কি সাজাতে পারি না? অবশ্যই পারি যদি আমরা একতাবদ্ধ থাকি।
নতুন বছর হোক নতুন সম্ভাবনার। নতুন নতুন পরিকল্পনার মাধ্যমে এগোতে হবে আমাদের। দেশের গণতন্ত্র, উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির জন্য যে কোন ত্যাগ স্বীকারের প্রস্তুতি নিতে হবে। বিগত দিনের ভুলত্রæটিকে পেছনে ফেলে বাংলাদেশকে বিশ্বদরবারে একটি আদর্শ রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। পারস্পরিক সুন্দর সস্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে শান্তি স্থাপন এবং মানুষের অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত করতে হবে। কোন ধরনের অন্যায়, অনিয়ম, দুর্নীতি যেন দেশের এগিয়ে যাওয়ার পথ রুদ্ধ করতে না পারে সে ব্যাপারে আমাদের সজাগ থাকতে হবে। নিজেদের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব অক্ষুণœ রেখেই বিশ্বের দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক চাই। দেশের সীমান্ত নিরাপদ রাখতে ভিনদেশী কোন অন্যায় আচরণকে প্রশ্রয় দেওয়া যাবেনা। সীমান্তে আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ হত্যার উপযুক্ত জবাব দিতে হবে। দেশে অবস্থানরত রোহিংগা জনগোষ্ঠীকে নিজেদের দেশ মায়ানমারে ফেরত পাঠাতে চাই সক্রিয় ও কার্যকর পদক্ষেপ। দেশের গণতন্ত্র, অর্থনীতিসহ সবক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা জরুরি। মানুষের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় সবাইকে সচেতন থাকতে হবে। সাধারণ খেটেখাওয়া মানুষের জীবনমানের উন্নয়নে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। সবধরনের অপচয় রোধ করতে হবে। সঠিকভাবে সব ধরনের পরিকল্পনা গ্রহণ করে তা বাস্তবায়ন করতে হবে। তৃণমূল পর্যায়েও সব উন্নয়ন কাজ দুর্নীতিমুক্ত রাখতে হবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত সংস্কার কমিশনগুলোর মাধ্যমে কার্যকর পরিবর্তন আসুক- এই কামনা করি।
আগামী নতুন বছর ২০২৫ আমাদের জাতীয় জীবনকে গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার, সুশাসন এবং মানবিক মূল্যবোধে উজ্জীবিত করবে এমন প্রত্যাশা দেশের মানুষের। নতুন বছর নিয়ে আসুক সুখ, শান্তি ও কল্যাণ।