বিদায় ২০২৪

1

নিজস্ব প্রতিবেদক

কালের পরিক্রমায় বিদায় নিতে চলেছে আরেকটি বছর। ক্যালেন্ডারের পাতায় আজ মঙ্গলবার খ্রিষ্টীয় বছর ২০২৪ সালের শেষদিন। গোধুলী বেলায় পশ্চিমাকাশে রচিত হবে বছরের শেষ সূর্যাস্ত। পুরনো বছরের তালিকায় জায়গা করে নেবে ঘটনাবহুল ২০২৪ সাল। প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, আনন্দ-বেদনা ও অর্জন-বর্জনের মিশেলে ঘটন-অঘটনে ঠাঁসা ছিল বিদায়ী বছর। তবুও বিদায় বেলায় নতুন বছরের (২০২৫) আবাহনে হোক নতুনের জয়গান।
কেমন ছিল বিদায়ী বছর? বৈশ্বিক পরিমÐলে বিদায়ী বছর যেমন নানা ঘটনা-দুর্ঘটনায় আলোচিত ছিল, তেমনি আমাদের জাতীয় জীবনেও নতুন ইতিহাস রচনার পাশাপাশি পরিবর্তনের এক অমিত সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত করেছে ২০২৪ সাল। দেশ ও জাতির সামনে নতুন দিগন্তের সূচনার অবারিত সুযোগ সৃষ্টি করেছে। বছরের মধ্যভাগে এসে ছাত্র-জনতার অবিস্মরণীয় অভ্যুত্থানের নব ইতিহাস রচিত হয়েছে। বছরের শুরুতে প্রথম সারির রাজনৈতিক দলগুলোর বর্জনের মধ্যে নিয়মরক্ষার নির্বাচনে টানা চতুর্থবারের মত ক্ষমতার মসনদ অটুট রাখা আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটেছে মাত্র ছয় মাসের ব্যবধানে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকার’। এমন সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের ঘটনা দেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন। এর আগে দেশ কখনও ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকার’ দ্বারা পরিচালিত হয়নি।
সঙ্গত কারণেই ২০২৪ সাল বাংলাদেশের জন্য ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও ঘটনাবহুল এক বছর। স্বাধীনতার অর্ধশত বছর পেরিয়ে এই বছরে দেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপটে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে। বছরের একেবারে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নানা ঘটনা জনমনে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। এবার বিদায়ী ২০২৪ সালের আলোচিত ঘটনাবলীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটনার দিকে ফিরে তাকানো যাক। ২০২৪-এর প্রথম দিনটিই শুরু হয় বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে শ্রম আইন লঙ্ঘনের দায়ে দোষী সাব্যস্ত হয়ে শিরোনাম হওয়ার মাধ্যমে। ইউনূসসহ গ্রামীণ টেলিকমের অন্য তিনজনের প্রত্যেককে ঢাকার শ্রম আদালত ছয় মাসের বিনাশ্রম কারাদÐ দেন এবং পরবর্তীতে রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার শর্তে এক মাসের জামিন দেন। এরপর দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় বিদায়ী বছরের ৭ জানুয়ারি। বিরোধী দলগুলোর বয়কটের মুখে শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ ‘ডামি’ নির্বাচনের মাধ্যমে টানা চতুর্থবার নির্বাচনে জয়লাভ করে। ৭ জানুয়ারি সকাল আটটা থেকে বিকাল চারটা পর্যন্ত এ নির্বাচনে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। এতে দুইশ’ ৯৯টি আসনের মধ্যে দুইশ’ ২৩টি আসন পেয়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ জয় পায়। জাতীয় পার্টি এবং আরও কয়েকজন স্বতন্ত্র প্রার্থী এ নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ তোলে। ৯ জানুয়ারি নির্বাচন কমিশন কর্তৃক ভোটের ফলাফলের গেজেট প্রকাশ করা হয় এবং অবশেষে ১০ জানুয়ারি জয়ী সাংসদরা শপথ গ্রহণ করেন।
বিদায়ী বছরের সবচেয়ে আলোচিত দূর্ঘটনা সংঘটিত হয়েছে ঢাকার বেইলি রোডে। একটি বহুতল ভবনে আগুন লেগে ৪৬ জনের মৃত্যু হয়। এ ছাড়া আরও ৭৫ জন বিভিন্নভাবে আহত অবস্থায় উদ্ধার হন। গ্রিন কোজি নামক বহুতল ভবনে ২০২৪ সালের ২৯ ফেব্রæয়ারি রাতে এই অগ্নিকাÐ সংঘটিত হয়। ভবনটিতে একাধিক রেস্তোরাঁ ও দোকান ছিল, যার মধ্যে কাচ্চি ভাই রেস্তোরাঁ, স্যামসাংয়ের শো-রুম, গ্যাজেট অ্যান্ড গিয়ার, ইল্লিয়িন, খানা’স ও পিৎজা ইন উল্লেখযোগ্য। একই বছরের ১২ মার্চ ‘এমভি আব্দুল্লাহ’ নামের একটি জাহাজ ছিনতাই করে সোমালিয়ান জলদস্যুরা। জাহাজটি মোজাম্বিক থেকে দুবাই যাচ্ছিল। জাহাজে ২৩ জন বাংলাদেশি নাবিক ছিলেন যাদের জিম্মি করেছিল সোমলিয়ান জলদস্যুরা। নানা দেনদরবারের পর ১৫ এপ্রিল সোমালিয়ান জলদস্যুদের হাত থেকে ছাড়া পায় এমভি আব্দুল্লাহ। চব্বিশের ২২ মে ভারতের কলকাতায় আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিমের লাশ উদ্ধার হয়। ভারতে চিকিৎসার উদ্দেশ্যে গিয়ে তিনি ১৩ মে থেকে নিখোঁজ ছিলেন। এই ঘটনায় তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। ২০ মে পর্যন্ত তাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। ২২ মে সকালে কলকাতার নিউটাউনে অভিজাত আবাসন সঞ্জীবা গার্ডেন থেকে তার শরীরের কিছু অংশ উদ্ধার হয়। তদন্তকারী কর্মকর্তাদের তথ্যমতে, ১৩ মে নিউটাউনের সেই বাড়িটিতেই তাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়।
কোটা সংস্কার আন্দোলন বা জুলাই-আগস্ট আন্দোলন অথবা ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান ২০২৪ সালে বাংলাদেশের সব থেকে বেশি আলোচিত বিষয়। ২০২৪ সালের ৫ জুন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ কর্তৃক ২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর বাংলাদেশ সরকারের জারি করা পরিপত্রকে অবৈধ ঘোষণার পর কোটা পদ্ধতির সংস্কার আন্দোলন আবার নতুনভাবে আলোচনায় আসে। শুরুতে আন্দোলন সভা-সমাবেশের মধ্যে স্থির থাকলেও ১৪ জুলাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার এক বক্তব্যে কোটা আন্দোলনকারীদের পরোক্ষভাবে ‘রাজাকারের নাতি-পুতি’ হিসেবে অভিহিত করেন বলে অভিযোগ উঠে। এর পর থেকেই কোটা আন্দোলন আরও জোরদার হয়। এ আন্দোলনে কয়েক হাজার শিক্ষার্থী ও আন্দোলনকারী আহত হওয়ার পাশাপাশি আবু সাঈদ ও মীর মুগ্ধ সহ ৬৭৩ জনের অধিক নিহত হন। পরিশেষে ২১ জুলাই বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট হাইকোর্টের দেওয়া রায় বাতিল করে এবং সরকারি চাকরিতে মেধার ভিত্তিতে ৯৩ শতাংশ নিয়োগ দেওয়ার নির্দেশ প্রদান করে। ২২ জুলাই এই বিষয়ে সরকার প্রজ্ঞাপন জারি করে। ৫ আগস্ট তীব্র আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার বাসভবনে প্রবেশ করে আন্দোলনকারীরা। এ সময় সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান অন্তবর্তীকালীন সরকার গঠনের ঘোষণা দেন। তীব্র আন্দোলনের মুখে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে পর বিরাজমান অরাজক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আলোচনার মাধ্যমে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে ড. মুহাম্মদ ইউনুসের নাম ঘোষণার তিনদিন পর ৮ আগস্ট শপথ গ্রহণের মাধ্যমে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের যাত্রা শুরু হয়। বছরের শেষের দিকে এসে গত ২৫ ডিসেম্বর গভীর রাতে প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়ে ভয়াবহ আগুন লাগার ঘটনা ঘটে। এতে গুরুত্বপূর্ণ পাঁচটি মন্ত্রণালয়ের অনেক নথি পুড়ে গেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ভয়াবহ এই অগ্নিকাÐের তদন্ত চললেও এখন পর্যন্ত রহস্যের কোনও কিনারা হয়নি।