মিঞা জামশেদ উদ্দীন
দু-দুবার যাওয়া হয় বাংলা একাডেমিতে। প্রথমবার যাওয়া হয় ২০২২সালে, যাওয়ার কারণ হলো, বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক মহোদয়ের সাথে সৌজন্য দেখা-সাক্ষাৎ করা এবং আমার লেখা ‘৭১’ গ্রন্থটির একটি কপি সরাসরি হস্তগত করা, যাতে করে যেন কোনোপ্রকার হেরফের না হয়, অর্থাৎ তা নিশ্চিত করা। কিন্তু একাডেমির মহাপরিচালকের সাথে দেখা হলো না; তবে, তিনি কার্যালয়ে উপস্থিত আছেন, তা জানালেন ওনার ব্যক্তিগত সচিব- তিনি তখন রুদ্ধধার বৈঠক করছিলেন, সেখানে সংশ্লিষ্ট ঊধ্বর্তন কর্মকর্তারাও উপস্থিত আছেন। সম্ভবত বাংলা একাডেমির পদক সংক্রান্ত-বিষয়ে জরুরি বৈঠক চলছে। কিন্তু কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর চরম হতাশ হয়ে পড়লাম। তবে কবে বৈঠক শেষ হবে তা-ও ঠিক নেই, হয়তো আজ মহাপরিচাল মহোদয়ের সাথে আর দেখা হবে না। সর্বশেষ সিদ্ধান্ত নিই, একান্ত সচিব মহোদয়ের নিকট একটি বই দিয়ে আসলে তো হয়; কিন্তু কেনযেন সন্দেহ উদয় হলো মনে! বইটি আদো যথাসময়ে হস্তগত হবে কিনা? সেটি জন্ম নেয়ার কারণ হলো, বিদ্যমান এ পরিস্থিতিতে কে-কার খবর রাখে? এমন একটা অবস্থা সর্বত্র বিরাজ করছে। না হয় এ-টুকু সন্দেহ কেন, বা এ ভাবনায় আসবে কেন- কথা হলো, সুদুর চট্টগ্রাম থেকে যাওয়া, এইটুকু সংশ্লিষ্টদের বোধে যদি আসে, তা হলে অবশ্যই এটি দায়িত্বে পড়ে তাঁদের। না, সেই-বোধ বহু আগে স্খলন ঘটছে- দেখা যাবে বই হাত থেকে নিয়ে যেখানে রেখেছেন, সেখানে পড়ে আছে; হয়তো পরে ঝঞ্ঝাট পরিষ্কার করতে গিয়ে দূরের কোথাও ডাস্টবিনে ফেলে দিবে, নয়তো আগুনে পুড়িয়ে ফেলতে নির্দেশ দিবে, ভাগ্যক্রমে সেটিও না করা হয়, তা হলে ফেরিওয়ালার কাছে হলেও কেজির মাফে বিক্র করে দিবে! এ কিছু দিন আগেই, এমন একটি ঘটনায়, জাতিকে বিস্ময়কর অবস্থা না হড়ে পারেনি; ৫ জানুয়ারি ২০২৫ ইং চট্টগ্রাম কোর্ট বিল্ডিংয়ে, ২৮-৩০ কোর্টের বিচারাধীন কেস-ডুকেট গায়েব হয়ে যায়। এগুলো একজন পাবলিক প্রসিকিউটরের হেফাজতে ছিল। যাকিনা পরক্ষণে অফিসে সংকুলান না হওয়ায়, অফিসের বাহিরে বস্তাভর্তি করে রেখে দেয়। কে-বা কারা তা কেজি ওজনে বিক্রয় করে দেয়। এ ঘটনায় আদালত পাড়ায় হৈচৈ পড়ে যায়। বিচারকও বিব্রতবোধ করেন। অবশ্য কয়েকদিন পরে মামলার ওইসব কপি ভাঙারি দোকান থেকে উদ্ধার করা হয়। তবে, এ ঘটনটি জানাজানি হয় কোতোয়ালি থানার একটি জিডির সূত্র ধরে। জিডিটি করেন খোদ পাবলিক প্রসিকিউটর মো. মফিজুর রহমান। তাহলে বুজতে পারছেন অবস্থা কি? যা বলছিলাম, দরদিয়ার কবি ও বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক নুরুল হুদা সাহেবের সাথে আগে জানাশোনা বা পরিচয় ছিল না। তিনি এখন জাতিসত্তার কবি হিসেবে খ্যাতি পেয়েছেন! রাতারাতি বিশেষণের এ তকমা জাতীয় পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়ে। তাঁর শুভানুধ্যায়ীরা এ বিশেষন বলেকয়ে হাঁপিয়ে তুলতে লাগলেন। তবে এর যৌক্তিকতা কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না; তবুও বলি, তা কিভাবে কোপালে জুড়েছে, আমার মতো আপনারাও অনুসন্ধান চালালে হয়তো খোঁজে পাবেন, আমি শতভাগ হলফ দিয়ে তা বলতে পারি, অবশ্য এর একটি হেতুই আছে-ই।
তিনি বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হওয়ার আগে কয়েক দফা তাঁর কক্সবাজার জেলায়-গ্রামের বাড়িতে কবি ও মহা কবিদের মহা সম্মেলনে হয়। চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে কয়েকশ কবি সমবেত হয় ওই অনুষ্ঠানে। তিনি নিজেই এ উদ্যোগে নেন। রীতিমতো কবি, লেখক ও সাংস্কৃতিক কর্মীদের খাওয়া-দাওয়াসহ যাতায়াতের জন্য গাড়ির ব্যবস্থা করা হয়। অবশ্য তাঁকে আকারে-গঠনে দেখতে একেবারে মন্দ না, ছয় ফুট দীর্ঘ-লম্বা তো হবেনই। এখন বয়সের ভারে চোয়াল ডেবে গেছে, চোখের কোটোরি টুনটুনি পাখির বাসার মতো। মুখে হালকা হালকা গোঁফ-দাঁড়ি আছে। রঙ বলতে হয়, মাসাল্লাহ- ফর্সা। আমি যখন বাংলা একাডেমির যাই এবং দেখা করে, তিনি বলেন, ‘কই, এ ধরনের কোন বইতো পায়নি।’ আমি নির্বাক-নিবৃত।
কেমন যেন গোলকধাঁধা থেকে গেল; এখনো বাংলা একাডেমি মুক্তভাবে শ্বাসনিঃশ্বাস নিতে পাচ্ছে না। আবারও পুরনো ভূত খামছে ধরেছে- এ দাবি তরুণদের। কিন্তু সেই অর্থে বাংলা একাডেমির কার্যক্রম দেখা যায়না। দেখা যায়না, বাংলা একাডেমির সার্বজনীনতাও। হ্যাঁ, তাদের দাবি হলো, বাংলা একাডেমি হবে লেখক, সাহিত্যি ও সাংস্কৃতি কর্মীদের প্রাণের আড্ডার স্থল। কিন্তু সেখানে বাংলা একাডেমির কথা ওঠলেই কেমন জানি অনেকে মুখ ফিরিয়ে নেন; যেখানে অসহায়, অপ্রকৃতিস্থ ও দুস্থ লেখক ও সাহিত্যকদের পাশে দাঁড়াবে বাংলা একাডেমি। অথচ সেই দৃষ্টান্ত তাদের হাতে নেই। এর বিপরীতে গড়ে উঠেছে অতি আমলা নির্ভর প্রতিষ্ঠান-রূপে এবং বড় বড় পদপদবীর ভারে ন্যুব্জ আজ বাংলা একাডেমির কার্যক্রম। তাছাড়া বর্তমানে বাংলা একাডেমি নিয়মিতভাবে যেকাজ হয়ে আসছে, সেটিও যথাযথ ভাবে সম্পূর্ণ করতে পারছে না। অনেকটা মুখথুবড়ে পড়েছে। বাংলা একাডেমির পদক নিয়েও নয়-ছয় এবং নানা বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। অবশেষে তা বাতিল করতে বাধ্য হয়, তীব্র সমালোচনার মুখে বাংলা একাডেমিকে। অথচ বছরে একবারই মাত্র বইমেলা আয়োজন করে আসছে বাংলা একাডেমি। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায় গণমাধ্যম, এবার বাইমেলার কলবর বেড়েছে। বাংলা একাডেমির প্রাঙ্গনসহ সরওয়ার্দী উদ্যানও ছেড়ে গেছে স্টলে স্টলে। এবার স্টলের সংখ্যা ৬৯৩টি, গত বছরের চেয়ে ৫১টি স্টল বেড়েছে। সাথে স্টলের বর্ণাঢ্যও বেড়েছে বহুগুণ। অথচ একসময় বাংলা একাডেমির রাস্তায় মাদুর-পাটি সাঁটিয়ে বইমেলা সূচনা হয়। সেই ইতিহাস কমবেশ সকলের জানা আছে। তবে যেসব দিক খেয়াল করা উচিত ছিল, স্টল বরাদ্দ ফি। সিংগল স্টল, ৭ হাজার, ডবল স্টল ১২ হাজার টাকা। এ ক্ষেত্রে বাংলা একাডেমি স্টল বরাদ্দের টাকা না নিয়ে ফ্রী দেওয়া উচিত ছিল। তারা তা করেনি। তা হলে পরিবর্তন আসলো কোথায়? এছাড়া প্রকাশকদের থাকা ও খাওয়া ব্যবস্থাও অতিতে ছিল, বর্তমানেও নেই। ২ ও ৩ ফেব্রæয়ারি দু’দিনব্যাপী জাতীয় কবিদের সম্মেলনে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। কবিদের রেজিস্ট্রেশনও বেশ কয়েকদিন ধরে চলে। ঢাকার এক বন্ধু মোবাইল ফোনে তা জানালো। সময় ও ব্যস্থতার কারণে রেজিস্ট্রেশন করতে পারেনি। একই সময়ে চট্টগ্রামের জিমনেসিয়াম চত্বরেও ১ ফেব্রুয়ারিতে থেকে ২৬ তারিখ পর্যন্ত ২৬ দিন ব্যাপী মেলা চলবে। আয়োজনে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন। এবার চট্টগ্রামে স্টল বরাদ্দ পায় ১৪০টি। গতবছর ছিল এ সংখ্যা- ১৬০টি।
এবার আমার কয়েকটি গবেষণা কথা বলবো। ২০২২ সালে বহু প্রতিক্ষিত আমার লেখা মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গ্রন্থ ‘৭১’ (একাত্তর) প্রকাশিত হয়। ৬৫৬ পৃ. এ গ্রন্থের প্রচ্ছদ শিল্পী ছিলেন উত্তম সেন। অগ্রসর পাঠকদের সুবিধার্থে গ্রন্থটিকে ৩টি পর্বে ভাগ করা হয়। ১ম পর্ব ভারত বর্ষে প্রাগৈতিহাসিক ইতিহাস উল্লেখ করা হয়, রেফারেন্স হিসেবে। অন্যথায় মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাবহুল বিচ্ছিন্ন বিচ্ছিন্ন মনে হবে, অর্থাৎ প্রজন্ম কাছে তা পরম্পরা নাও থাকতে পারে। দ্বিতীয় পর্বে মুক্তিযুদ্ধের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটও যুক্ত হয়। তৃতীয় পর্বে আঞ্চলিক ট্রাজেডি ও বীরদের জীবন্ত কাহিনি।
২০০৮ সালে চট্টগ্রামের বলাকা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হয়, স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস : সীতাকুন্ড অঞ্চল। গ্রন্থটি পৃ. ৪৮০। একই বছর ডিসেম্বর গ্রন্থটি দ্বিতীয় সঙ্কলণ হয়, অবনী প্রকাশন থেকে, পৃ. ৫১৬। এরপর এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে প্রকাশিত হয় ‘বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের জ্ঞানকোষ’। ১০ খন্ডের এ গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত লেখকও। গবেষণা অঞ্চল ছিল সীতাকুন্ড। বিশিষ্ট সাংবাদিক নাছির উদ্দিন-এর সম্পাদনা ‘মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম’। এ গ্রন্থেরও অন্তর্ভুক্ত লেখক। দীর্ঘ ২২ বছর ধরে ধরে মুক্তিযুদ্ধের ওপর গবেষণা কাজ করা হয়। এর থেকে কিছু পাওয়ার আছে বলে মনে করি না। শুধু জীবন- যৌবন হারালাম, আক্ষেপ থেকেই গেল।
লেখক : কবি, গবেষক ও কলামিস্ট