মুহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মাসুম
রাব্বুল আলামীন আপন প্রিয় হাবীব রাসূলে আরবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে যে সকল মু’জিয়া দান করেছেন, তাঁর মধ্যে মিরাজে গমন এক মহাবিশ্বয়কর মুজিয়া। মহাগ্রন্থ আল-কুরআন যেমন বিশ্বের যেকোন সাহিত্যকর্ম ও জ্ঞানগ্রন্থের মোকাবেলায় অপ্রতিদ্বন্দ্বী, ঠিক তেমনি প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার মিরাজ গমন বর্তমান তথ্য প্রযুক্তির যুগে বিজ্ঞানীদের নিকট এক অনন্য সাধারণ গবেষণার বিষয়। বিজ্ঞানের যতই উৎকর্ষ সাধিত হচ্ছে ইসলামের বিধি-বিধান বুঝাও ততই সহজতর হচ্ছে। এক সময় বিজ্ঞানীরা বলত, কোন প্রাণীর পক্ষে আকাশ ভ্রমণ সম্ভব নয়। তাই তারা মিরাজকে অস্বীকার করত। কিন্তু বিংশ শতাব্দীর শেষে তারাই প্রমাণ করল, মানুষ শুধু আকাশ নয়, বরং গ্রহ হতে গ্রহান্তরে, শুন্য হতে মহাশুন্যে বিচরণ করতে পারে। আমেরিকার নভোচারী পৃথিবী হতে দু’লক্ষ চল্লিশ হাজার মাইল দূরের চাঁদের সাথে মিতালী করে বিশ্বকে অবাক করে দিয়েছে। তারপর বিচরণ করল মঙ্গল গ্রহে। এখন প্রতিযোগীতা চলছে, কে বুধ, কে শুক্র, ইউরেনাস ও নেপচুনে গিয়ে পৌঁছবে। তারপরেও মিরাজুন্নবী বিষয়ে কয়েকটি প্রশ্ন উত্থাপিত হয়, তন্মধ্যে তিনটি উল্লেখযোগ্য। ওই তিনটি প্রশ্নের সমাধানই আমার আজকের প্রয়াস।
প্রথম প্রশ্ন : দুর্বল হৃদপিন্ড নিয়ে মানুষের পক্ষে নভোমÐল ভ্রমণ সম্ভব নয়। কেননা মানুষের হৃদপিন্ড কেবল বায়ুমন্ডলের অভ্যন্তরে কাজ করে। পৃথিবীর উপরে কেবল ৫২ মাইল ব্যাপী বায়ুমন্ডল অবস্থিত। এর উপরে রয়েছে হিলিয়াম, ক্রিপ্টন, জিয়ন প্রভৃতি হালকা গ্যাসীয় পদার্থ। বায়ুস্তর ভেদ করে হালকা গ্যাসীয় পদার্থের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে কোন প্রাণী তার প্রাণ রক্ষা করা সম্ভব নয়। এজন্যই নভোচারীগণ মহাশুন্যের উদ্দেশ্য যাত্রার পূর্বে অভিজ্ঞ ডাক্তার দ্বারা তাদের শারীরিক সহিষ্ণুতার কৌশল, রক্তচাপ, হৃদয় ক্রিয়া, বুদ্ধির পরিমাপ, পঞ্চেন্দ্রিয় প্রভৃতি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নভোমন্ডল ভ্রমণের উপযুক্ততা বিবেচনা করা হয়। অতঃপর তাকে সর্বপ্রকার ব্যবস্থা সহকারে মহাকাশে প্রেরণ করা হয়। এখন প্রশ্ন জাগে, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার জন্যও তদ্রুপ ব্যবস্থা করা হয়েছিল কি না। কোন অভিজ্ঞ ডাক্তার কি তাঁর শরীরে অস্ত্রোপাচার করেছিলেন?
উত্তর : নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার জীবন চরিত অধ্যয়ন করলে জানা যায়, যেসব ব্যবস্থা নভোচারীদের জন্য করা হয়, তার চাইতেও অনেক উন্নতর ব্যবস্থা সুনিপুন ও শক্তিশালী ডাক্তার দ্বারা নবীজির জন্য করা হয়েছিল। তাঁকে সবকাজে উপযোগী করতে মহান আল্লাহ কর্তৃক নিয়োজিত মহাবিজ্ঞ ডাক্তার জিব্রাইল আমীন আলাইহিসসালাম দু’বার তাঁর বক্ষ বিদারণ করেছিলেন এবং তাঁর বক্ষ মুবারক নূর দ্বারা শক্তিশালী করেছিলেন। প্রথমবার ৪ বছর বয়সে মা মালিমার গৃহে অবস্থান কালে। আরেকবার মিরাজ রজনীতে মিরাজে যাওয়ার প্রাক্কালে। এদিকে ইঙ্গিত করে মহান আল্লাহ তাআলা সূরা ইনশিরাহতে ইরশাদ করেন-আমি কি আপনার জন্য আপনার বক্ষ প্রশস্ত করিনি? প্রসিদ্ধ হাদীস গ্রন্থ মিশকাত শরীফে বর্ণিত রয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- ‘আমার হৃদপিন্ড বের করা হল। তারপর ঈমানে পরিপূর্ণ এক সোনার তশতরী আনা হল এবং আমার হৃদপিন্ড ধৌত করা হল। তারপর তা ঈমানে পরিপূর্ণ করা হল এবং যথাস্থানে স্থাপন করা হল।’ প্রমাণিত হল, মিরাজে গমনের পূর্বে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার হৃদপিন্ডকে এমন এক শক্তি দ্বারা পূর্ণ করা হয়েছে, যার প্রভাবে হুযূর পুরনূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সপ্তাকাশ অতিক্রম করে ঊর্ধ্বজগত তথা লা-মকানে পাড়ি জমান।
দ্বিতীয় প্রশ্ন : আকাশ ভ্রমণে সবচেয়ে বড় বাধা মধ্যাকর্ষণ শক্তি, যা অতিক্রম করার জন্য অত্যাধিক দ্রুতগামী যানের প্রয়োজন। যেমন- নভোচারীরা মহাশূন্য যানের মাধ্যমে নভোমন্ডলে অভিযান চালায়। যেগুলোর গতিবেগ ঘন্টায় ২৬ হাজার হতে ৩২ হাজার মাইল। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কি কোন দ্রুতগামী যানের মাধ্যমে মধ্যাকর্ষণ শক্তিকে ভেদ করে ঊর্ধ্বজগতে পাড়ি জমিয়েছেন ?
উত্তর : উল্লেখিত প্রশ্নের সমাধান আজ থেকে পনের শত বৎসর পূর্বে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেই দিয়েছেন। নবীজি ইরশাদ করেন, আমার আকাশ ভ্রমণ সংঘটিত হয়েছে আল্লাহ প্রদত্ত জিব্রাইল কর্তৃক আনীত কল্পনাতীত গতিসম্পন্ন স্বর্গীয় বাহন বোরাকের মাধ্যমে। যার গতিবেগ ছিল প্রতি সেকেন্ডে কোটি কোটি মাইল। জামে তিরমিযীতে বর্ণিত রাসূলুল্লাহর বাণীই তার সাক্ষ্য বহন করে। তিনি ইরশাদ করেন, ‘অতঃপর আমার নিকট গাধা হতে বড় খচ্চর অপেক্ষা ছোট একটি প্রাণী আনা হয়, যাকে বোরাক বলা হয়। তার চলার গতি এমনই ক্ষিপ্র ছিল যে, দৃষ্টিসীমার শেষপ্রান্তে গিয়ে পড়ত তার পায়ের খুর।’ আকাশের দিকে তাকালে অজস্র নক্ষত্র আমাদের চোখে পড়ে। কোন নক্ষত্র কতদূরে অবস্থিত, তার হিসাব দেয়া খুবই কঠিন। সাধারণত আকাশে দৃশ্যমান নক্ষত্ররাজির মাঝে ধ্রæবতারা অন্যতম। যা দ্বারা দিক নির্ণয় করা হয়। আর পৃথিবী হতে ধ্রুব তারার দূরত্ব ৪৭ আলোকবর্ষ। এক আলোকবর্ষ এক বছরের আলোর গতি। সুতরাং ৪৭ আলোকবর্ষ সমান দুইশত বিরাশি লক্ষ কোটি মাইল। এভাবে নক্ষত্ররাজি নিয়ে হিসাব করলে আমাদের চক্ষু স্থির হয়ে যায় বোরাকের গতিবেগ দেখে। অসাধারণ গতিবেগ নিয়েই বোরাক চলছিল মহাকাশের দিকে আল্লাহর হাবীবকে বহন করে। যার যাত্রা শুরু হয়েছিল বায়তুল্লাহ হতে এবং সমাপ্ত হয় সিদরাতুল মুনতাহায়। অতঃপর সিদরাতুল মুনতাহা হতে বোরাক অপেক্ষা দ্রুতগামী নূরের বাহন রফরফের মাধ্যমে আলমে লা মকানে গিয়ে আল্লাহ রাববুল ইজ্জতের সান্নিধ্যে গমন করেন।
তৃতীয় প্রশ্ন : সফরের সময়ের মেয়াদ নিয়েও কেউ কেউ প্রশ্ন করে থাকেন। শুভযাত্রার সময় মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওযু করেন গৃহদ্বারে। ফিরে এসে দেখেন যে, ওযুর পানি তখনো গড়িয়ে যাচ্ছে। এর অর্থ দাড়ায়, তিনি কয়েক মুহুর্তের মধ্যেই উক্ত সফর সমাধান করেন। সুতরাং ওই অল্প সময়ের মধ্যে কীভাবে বায়তুল মুক্কাদাস হয়ে সপ্ত আসমান, জান্নাত-দোযখ ও লা-মাকানের ভ্রমণ ও দীদার ইলাহী সম্পন্ন করা সম্ভব হল?
উত্তর : রাষ্ট্রীয় নেতৃবৃন্দের সফরের বিশৃঙ্খলা এড়ানোর লক্ষে বিশেষ বিশেষ সড়কে বা স্থানে নিদিষ্ট সময়ের জন্য যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়। নেতা বা নেতৃবৃন্দকে বহনকারী গাড়ি সে স্থান অতিক্রম করার পর আবার শুরু হয় স্বাভাবিক যান চলাচল। ওই সময়ে থেমে থাকা যানবাহনগুলোর মাইল-মিটারের কাঁটাগুলো স্থির হয়ে বসে থাকে। তাফসীরে রহুল মাআনী ও রুহুল বয়ান ইত্যাদি অধ্যয়ন করে জানা যায়, নূরনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হলেন সৃষ্টি জগতের প্রাণ। যখন নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মিরাজ রজনীতে বিশ্ব নিয়ন্তা আল্লাহর দাওয়াতে তাঁর দরবারে যাচ্ছিলেন, তখন সমস্ত বস্তুকে সচল পেয়েছিলেন। হুযুর যখন ঊর্ধ্বজগতে চলে গেলেন তখন সৃষ্টি তথা বিশ্ব কারখানাও বন্ধ হয়ে গেল। ঠান্ডা-গরম অবস্থায় থেমে যায়। হুযুরের বিছানায় উষ্ণতাও আপন অবস্থায় থেমে যায়। ওযুর পানির প্রবাহ বন্ধ হয়ে যায়। দরজার কড়া নড়াচড়া বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু নবীজি যখন মিরাজ হতে প্রত্যাবর্তন করেন, আল্লাহর নির্দেশে কুদরতের কারখানা আবার সচল হয়, যে বস্তু স্থিতিশীল হয়ে পড়েছিল, তা গতিশীল হতে শুরু করে। ওযুর পানি প্রবাহিত হতে শুরু করে, দরজার কড়া নড়াচড়া করতে লাগল। বস্তুত জগতের পরিবর্তনের জন্য স্পন্দন দরকার। এর তখন স্পন্দন ছিল না। তাই মহাবিশ্বের কর্মযজ্ঞ বন্ধ ছিল। উপরোক্ত আলোচনা থেকে বুঝা যায়, মিরাজ সামান্য সময়ে সংঘটিত হয়নি, কিন্তু জগতের স্পন্দন না থাকায় জগৎবাসী তা অনুধাবন করতে পারেনি।
মিরাজুন্নবী উপলক্ষে মহান প্রভু আপন মাহবুব ও তাঁর উম্মতকে অনেক নেয়ামত দান করেছেন। প্রবাসী গৃহে প্রত্যাবর্তনের সময় পরিবার-পরিজনের জন্য সাধ্যমত উপহার নিয়ে আসেন। আমাদের আক্বা মাওলা এক মহাসফরে গিয়েছিলেন। এই সফর ছিল অশ্রæতপূর্ণ ও অতুলনীয় মর্যাদার। সফর থেকে প্রত্যাবর্তনের সময় উম্মতের জন্য উপহার স্বরূপ নিয়ে এসেছেন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ। যা বান্দা আপন প্রতিপালককের দর্শন লাভের সোপান।
লেখক: আরবি প্রভাষক ও ইসলামী গবেষক