বাসুদেব খাস্তগীর
বিজয় ভূষণ খাস্তগীর ফটিকছড়ি উপজেলার পাঁচপুকুরিয়া গ্রামের একজন কৃতী শিক্ষকের নাম। শিক্ষকতাই ছিল যেন যাঁর আজন্ম লালিত স্বপ্ন। সে স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে যিনি শিক্ষকতাকে মহান ব্রত হিসাবেই নিয়েছিলেন। জীবনের অনেক লোভ লালসাকে তুচ্ছ জ্ঞান করে শিক্ষকতাকেই আঁকড়ে ধরেছিলেন পরম মমতায়। যে সময়ে তিনি গ্রামীণ পরিবেশে অনেক সংগ্রাম করে পড়ালেখার পথ পাড়ি দিয়েছিলেন সে সময় জীবন সংগ্রামের সাথে তাল মিলিয়ে পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়াই ছিল কঠিন একটা ব্যাপার। সেই কঠিন সংগ্রামের পথ পাড়ি দিয়ে নিজের জীবন নিজের পরিবার সবকিছু সামলিয়ে এক সফল শিক্ষকের প্রতিকৃতি হয়ে ওঠা চাট্টিখানি কথা ছিল না। তাঁর একজন সন্তান হিসাবে অনেক কিছুই আমার দেখা আবার অনেক কিছুই আবার তাঁর মুখে শোনা। কত স্মৃতি স্মৃতির অতলে হারিয়ে গেলো তা মনেই করতে পারি না। গ্রামীণ পরিবেশে বেড়ে ওঠা সারা জীবনই গ্রামের মানুষের জন্য অকাতরে নিজেকে বিলিয়ে দেয়া একজন মানুষ মাস্টার বিজয় ভূষণ খাস্তগীর। যাঁর মধ্যে চলাফেরায় অত্যন্ত সহজ সরল মানুষের প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠতো বলে সাদা পায়জামা পাঞ্জাবি ছাড়া আর কোনো পোশাকে তাঁকে দেখা যায়নি। কোনো আভিজাত্য তাঁকে স্পর্শ করেনি এবং তিনি তা পছন্দও করতেন না। কারণ জীবনে কষ্ট নামক যে শব্দটা তিনি উচ্চারণ করতেন তা তাঁর হৃদয়ের গভীর থেকে যেন উচ্চারিত হতো। কে কতটুকু বুঝতো সেটা জানি না, তবে তাঁর উপলব্ধিটা আমাকে ছুঁয়ে যেতো। দায়িত্ব কী জিনিস তা তিনি তাঁর জীবনের পরতে পরতে বুঝিয়ে দিয়েছেন। সামর্থ্যরে মধ্যে যার জন্য যতটুকু করার প্রয়োজন তার প্রচেষ্টা ছিল আন্তরিক। একটি যৌথ পরিবারে বড় হয়ে ওঠা মানুষ সময়ের প্রয়োজনে পরবর্তীতে আলাদা হয়ে গেলেও কিন্তু দায়িত্বশীলতার জায়গা থেকে তার কোনো ঘাটতি ছিল না। আত্মকেন্দ্রিকতার এযুগে এ গুণ বর্তমান সময়ে তা দুর্লভ। পিতামাতার ছয় ভাইয়ের মধ্যে তিনি ছিলেন চতুর্থ। পরিবারের পারিবারিক সদস্যদের নানা টানা পোড়েনের মধ্যেও তিনি কখনো উচ্চবাচ্যে নিজেকে পরিচিতি করাননি। তিনি একজন অত্যন্ত ধীরস্থির মার্জিত স্বভাবের নিরেট ভদ্রলোক ছিলেন। কারো অভদ্রজনোচিত আচরণে খুবই ব্যথিত হতেন তিনি। নানা দুঃখ বা বেদনাবোধে তাড়িত হলেও খুব নিকটজন ছাড়া কারো কাছে তা প্রকাশ করতেন না। গ্রামের সকল লোকের কাছে একজন সম্মানীয় ব্যক্তি হিসাবে তাঁর পরিচিত ছিলো ব্যাপক। এলাকায় এখনো তার নাম মুখে মুখে ফেরে। তাঁর একসময়ের ছাত্র ছাত্রছাত্রীরা এখনো সম্মানের সহিত তাঁকে স্মরণ করেন। এলাকার তাঁর প্রচুর ছাত্রছাত্রী ছড়িয়ে আছে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। একজন বিনয়ী মানুষ হিসাবে এবং সামাজিক মানুষ হিসাবে তাঁর তুলনা তিনি নিজেই। শিক্ষক হিসাবে অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিলেন বলেই এলাকার বিচার আচার ও সামাজিক বিভিন্ন কর্মকান্ডে তাঁর অপরিহার্যতা ছিল প্রশ্নাতীত। স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধিরা তাঁকে নিয়েই এলাকার নানা কর্মকান্ডে ব্যাপৃত হতেন। একজন বিশ্বাসযোগ্য মানুষ হিসাবেও তার ম‚ল্যায়ন সাধারণ মানুষরা এখনো স্মরণ করেন। হালদা নদীর কোলঘেঁষা বাড়িতে নদীর ভাঙনের সাথে যুদ্ধ করে বন্যা, পরিবারের নানা টানাপোড়েনের সাথে সংগ্রাম করে বেড়ে ওঠা মানুষ তিনি। যাঁর পথ চলা অনেক পরিশ্রমের ও সংগ্রামমুখর। নানা প্রতিবন্ধকতা তাঁর শিক্ষার পথচলাকে বাধাগ্রস্ত করলেও থেমে থাকেনি তাঁর পথচলা। শিক্ষকতার পাশাপাশি নিজের একাডেমিক শিক্ষাকেও এগিয়ে নিয়েছেন নানা প্রতিক‚লতায়। ১৯৫৬ সালে তিনি নাজিরহাট কলেজিয়েট হতে মেট্রিকুলেশন পাস করার কিছুদিন পরই তিনি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসাবে যোগদান করেন। শিক্ষকতার নেশায় পাওয়া এ মানুষটি পরবর্তীতে নানা পেশায় যাবার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও অন্য পেশায় নিজেকে সমর্পণ করেননি। সরকারি পোস্ট অফিসেও তাঁর চাকরি হয়েছিলো কিন্তু নিজের গ্রাম ও পরিবারের মোহে তিনি অনেকটা তা বিসর্জন দিয়েছিলেন। চাকরিকালীন অবস্থায় প্রাইভেট পরীক্ষার্থী হিসাবে তিনি ১৯৬৮ সালে কুমিল্লা বোর্ডের অধীনে এইচ.এস.সি এবং দীর্ঘ বিরতিতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বহিরাগত পরীক্ষার্থী হিসাবে ১৯৭৫ সালে বি,এ পাস করেন। শিক্ষকতায় প্রবেশ করে ১৯৬৫ সালে ইস্ট পাকিস্তান ডিভিশনাল ডিরেক্টর অব এডুকেশন চট্টগ্রাম থেকে সিইনএড ডিগ্রি নেন। একাডেমিক এ অর্জনগুলো তাঁর শিক্ষকতার সময়কালীন সময়েই। দেশে উপজেলা পরিষদ গঠনের প্রাথমিক পর্যায়ে ১৯৮৫ সালে তৎকালীন ফটিকছড়ি উপজেলা পরিষদ থেকে তাঁকে প্রাথমিক শিক্ষার অগ্রগতিতে অবদান রাখায় আনুষ্ঠানিকভাবে সনদপত্রসহ স্বীকৃতি প্রদান করে। অত্যন্ত গোছালো ও হিসাবনিকাশে পরিপাটি এ মানুষটির যাবতীয় তথ্য গোছালোভাবে রাখতে ভালোবাসতেন। শুধু তাঁর নিজের নয়, বিশ্বাস করে যারা তাঁকে সম্মান করতেন তাঁদের ক্ষেত্রেও তা দেখা গেছে। অত্যন্ত আর্থিক অনটনের মধ্যে তাঁর জীবনের বেড়ে ওঠা বলে সকলকেই সঞ্চয়েই উৎসাহ দিতে অনুপ্রাণিত করতেন। এলাকার খুব সাধারণ মানুষের কাছে তাঁর বিশ্বাসযোগ্যতা ছিল প্রশ্নাতীত এবং অনেকের আশা ভরসা ও উপদেশ পরামর্শের আশ্রয়স্থল ছিলেন তিনি। অতি আপনজনের দেয়া নানা দুঃখ কষ্টও নিজের মধ্যে আড়াল করে নিজেকে সংযত রাখার যে চেষ্টা তাঁর মধ্যে বিদ্যমান ছিল তা যে কারো জন্যই শিক্ষণীয়। যে কারো উপকারকে অকুণ্ঠচিত্তে স্বীকার করতে তাঁর কোনো কার্পণ্যবোধ ছিল না। যা অনেক মানুষের কাছে বর্তমান সময়ে দুর্লভই বটে। আমাদের গ্রামের এক সময়ের খ্যাতিমান ব্যক্তিত্ব ডা. দেবেন্দ্র লাল খাস্তগীরের সন্তান দাদা অর্ধেন্দু খাস্তগীর (বাবুল) ১৯৯৬ সালে চট্টগ্রাম মেডিকেল হাসপাতালে তাঁর চরম এক সংকটময় অসুস্থতার সময়ে নিজের রক্ত দিয়ে বিপন্ন জীবন রক্ষা করেছিলেন জীবদ্দশায় তিনি তা ভুলেননি। নানা কথা প্রসঙ্গে তিনি সে কথা সকলের কাছে অকপটে বলতেন। তিনি ভুলে যাননি সে সময় আমার বড় জ্যাঠাতো ভাই প্রকৌশলী দীপক খাস্তগীরের কয়েকজন বন্ধুর কথা যারা তৎকালীন সময়ে চট্টগ্রাম মেডিক্যালে পড়া নবীন ছাত্র ডা. বিজন কুমার নাথ, ডা. প্রকাশ কুমার চৌধুরীসহ অনেকের কথা। তেমনি তাঁকেও ভুলে যাননি তাঁর অনেক প্রিয় ছাত্র যারা ডাক্তার হয়ে দেশের সেবা করেছেন। সেই স্মৃতিকথা একবার আমি একটি লেখায় উল্লেখ করেছিলাম। এ বছর তাঁর মৃত্যুর বারো বছর পার হলো। প্রাণের টানে গ্রামে গেলে গ্রামের অনেক মানুষের ভালোবাসায় মুগ্ধ হই তাঁর কারণেই। পরিবারের তাঁর ভাইদের মধ্যে সবচেয়ে বড়জন বিধু ভ‚ষণ খাস্তগীর কলকাতায় থাকলেও দায়িত্ববোধে তাঁর সাথে সবসময় যোগাযোগ রাখতেন পত্রের মাধ্যমে এবং কলকাতা গেলেও তাঁর সাথে দেখা না করে আসতেন না। দ্বিতীয় ভাই আমার জ্যাঠা মশাই নিধু ভ‚ষণ খাস্তগীর গ্রামে থাকতেন এবং তৃতীয়জন বিনয় ভ‚ষণ খাস্তগীর বিসিআইসির অধীন কর্ণফুলী পেপার মিলের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ছিলেন। নানা পারিবারিক টানা পোড়েনেও সম্পর্ক কখনো বৈরিতায় গড়ায়নি। বাবার ভাইয়ের এ দুজনের কাছে আমি নানাভাবে ঋণী। জ্যাঠা নিধু ভূষণ খাস্তগীর অত্যন্ত সহজ সরল একেবারে সাদা মনের একজন মানুষ ছিলেন। তাঁর স্নেহ ভালোবাসার সাহচর্য এখনো আমাকে নস্টালজিয়ায় ফিরে নিয়ে যায়। আর জ্যাঠা বিনয় ভূষণ খাস্তগীর আমার বিশ্ববিদ্যালয় পড়াকালীন বিভিন্ন সময়ে তাঁর নানা উপদেশ পরামর্শে আমি বারবার ধন্য হয়েছি। লেখার প্রতি অনুরাগ বা ভালোবাসা আমার বাবা মাস্টার বিজয় ভূষণ খাস্তগীরের ছিল অন্যরকম। বাজারে গেলে পত্রিকা নিয়ে আসতেন। স্কুল কলেজে পড়াকালীন সময়ে মাঝে মাঝে লেখা ছাপা হলে এক ধরনের খুশির অনুভব তাঁর মধ্যে লক্ষ করা যেতো। কলকাতা প্রবাসী প্রখ্যাত ডা. বিমল কৃষ্ণ খাস্তগীর তাঁর বাল্য বন্ধু ছিলেন। একবার দেশে আসলে গ্রামের সেই শৈশবের স্মৃতি বিজরিত অনেক জায়গায় তাঁকে নিয়ে ঘুরে বেরিয়েছেন। কলকাতায় গিয়ে ‘ডাক্তারের ডাইরি’ নামে একটি বইও লিখেছিলেন, সেটা তাঁর সংরক্ষণে ছিল। এখনো আমার কাছে আছে বইটি। ভাইদের মধ্যে ছোট ভাই মাস্টার সনজিৎ কুমার খাস্তগীর। তাঁর জীবদ্দশার শেষদিকে আমার সাথে নানা পারিবারিক বিষয়ে এক ধরনের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিলো একান্ত প্রয়োজনে। নানা আলাপচারিতায় বাবাসহ পারিবারিক বন্ধনের অনেক ইতিবাচক বিষয় উঠে আসতো তাঁর কথোপকথনে। ইতিবাচক সে ভাবনার পারিবারিক অনেক অজানা বিষয়-আশয় নিঁখুতভাবে তাঁর কাছ থেকে জেনেছি। স্মৃতির অতলে সবকিছুই আজ অতীত। এভাবেই জীবন ও পারিবারিক বন্ধন ধীরে ধীরে একধরনের দূরত্বে নিজেকে সমর্পণ করে। মাস্টার বিজয় ভূষণ খাস্তগীর ১৯৩৯ সালের ২২ অক্টোবর ফটিকছড়ি উপজেলার পাঁচপুকুরিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা মহিম চন্দ্র খাস্তগীর ও মাতা ঊর্মিলা খাস্তগীর। কীর্তিমান এ শিক্ষক ২০১৩ সালের ১৫ এপ্রিল জাগতিক মায়া ত্যাগ করে ইহলোক ত্যাগ করেন। শিক্ষকতাকে পেশা নয়, মহান ব্রত হিসাবে নিয়ে সমাজ ও পরিবারে অনন্য উদাহরণ হয়েই ছিলেন তিনি, যা এখনকার সমাজে সত্যিই বিরল। পরিবারে বড়দের প্রতি শ্রদ্ধা ও ছোটদের প্রতি স্নেহশীল হবার শিক্ষা এবং ক্ষমা ও ঔদার্যের যে নান্দনিক সৌন্দর্য আছে তাঁর জীবদ্দশাই তা প্রমাণ করে।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও শিশুসাহিত্যিক
সহকারী অধ্যাপক- বি এম সি ডিগ্রি কলেজ, চট্টগ্রাম