বিপ্লব কান্তি নাথ
ত্বয়ৈব ধার্যতে সর্বং ত্বয়ৈতৎ সৃজ্যতে জগৎ।
ত্বয়ৈতৎ পাল্যতে দেবি ত্বমৎস্যন্তে চ সর্বদা \
অনুবাদ : হে দেবী, আপনিই এই জগৎ ধারণ করিয়া রহিয়াছেন। আপনি এই জগৎ সৃষ্টি করেন, আপনিই ইহা পালন করেন এবং সর্বদা প্রলয়কালে আপনিই ইহা সংহার করেন। (শ্রী শ্রী চন্ডী, প্রথম অধ্যায়)
শারদ আবহ চারিদিকে। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বছরব্যাপী অপেক্ষার পালা শেষ। মহাষষ্ঠী পূজার মধ্য দিয়ে শুরু সার্বজনীন শারদীয় দুর্গোৎসব। ধূপ-ধুনুচি, পঞ্চপ্রদীপ, উলুধ্বনি আর ঢাকের তালে সায়ংকালে আসনে অধিষ্ঠিত হয় দেবী দুর্গা। মন্ডপ আর মন্দিরে মুখরিত হয়ে উঠে ছিল ভক্তদের আরাধনায়। বিহীত পূজার মধ্যে দিয়ে শুরু শেষ হয় দশমী পূজার মধ্যে দিয়ে। শাস্ত্রমতে, যা কিছু দুঃখ-কষ্টের বিষয়, যেমন-বাধাবিঘ্ন, ভয়, দুঃখ-শোক, জ্বালা-যন্ত্রণা এসব থেকে ভক্তকে রক্ষা করেন দেবী দুর্গা। শাস্ত্রকাররা দুর্গা নামের অর্থ করেছেন- দুঃখের দ্বারা যাকে লাভ করা যায় তিনিই দুর্গা। দেবী দুঃখ দিয়ে মানুষের সহ্যক্ষমতা পরীক্ষা করেন। তখন মানুষ অস্থির না হয়ে তাকে ডাকলেই তিনি তার কষ্ট দূর করেন। দুর্গা পূজার সঠিক সময় বসন্তকাল। কিন্তু বিপাকে পড়ে রাজা রামচন্দ্র শরতে দেবীকে অসময়ে জাগিয়ে পূজা করেন। সেই থেকে অকালবোধন হওয়া সত্তে¡ও শরৎকালেই দুর্গা পূজার প্রচলন হয়। বিজয়া দশমীর তাৎপর্য :
‘দশমী’ কথাটির মধ্যে রয়েছে আবেগ ও মনখারাপ মিশ্রিত অনুভূতি ’/ ‘দশমী’ এলেই মনে আসে মায়ের ফিরে যাওয়ার আশঙ্কা / দুর্গাপুজোর অন্ত হয় দশমীর মাধ্যমেই
‘দশমী’ কথাটির মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে বাঙালির আবেগ ও মনখারাপ মিশ্রিত একটি অনুভূতি। দশমী এলেই বাঙালির মনে আসে মায়ের ফিরে যাওয়ার আশঙ্কা। অপেক্ষায় থাকতে হবে আরও একটা বছর। সাধারনত দুর্গাপুজোর অন্ত হয় দশমীর মাধ্যমেই। এই দিনেই মা দুর্গার প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হয়। তবে এই দিনটিকে বিজয়া দশমী বলার সঠিক অর্থ আজও জানেন না অনেকেই।
‘দশমী’ কথাটির সাধারণ অর্থ খুবই সহজবোধ্য। আশ্বিন মাসের শুক্ল পক্ষের দশমী তিথিতে পিতৃগৃহ ছেড়ে কৈলাসে স্বামীগৃহে পাড়ি দেন দেবী দূর্গা। সেই কারণেই এই তিথিকে ‘বিজয়া দশমী’ বলা হয়। তবে দশমীকে ‘বিজয়া’ বলার কারণ খুঁজলে অনেক পৌরাণিক কাহিনী পাওয়া যাবে। পুরাণের মহিষাসুর বধ কাহিনীতে বলা হয়েছে, মহিষাসুরের সঙ্গে ৯ দিন ৯ রাত্রি যুদ্ধ করার পর দশম দিনে তাঁর বিরুদ্ধে বিজয় লাভ করেছিলেনমা দুর্গা। তাই তাকে ‘বিজয়া’ বলা হয়। এছাড়াও শ্রীশ্রীচন্ডী কাহিনী অনুসারে, দেবীর আবির্ভাব হয় আশ্বিন মাসের কৃষ্ণা চতুর্দশীতে। পরে শুক্লা দশমীতে মহিষাসুর বধ করেছিলেন তিনি। তাই বিজয়া দশমী এই বিজয়াকেই চিহ্নিত করেন।
উত্তর ও মধ্য ভারতে এই দিনে দশেরা উদযাপিত হয়। তবে তার তাৎপর্য সম্পূর্ণ আলাদা। ‘দশেরা’ শব্দটির উৎপত্তি সংস্কৃত শব্দ ‘দশহর’ থেকে। যার অর্থ দশানন রাবণের মৃত্যু। বাল্মীকি রামায়নে বলা হয়েছে, আশ্বিন মাসের শুক্লা দশমী তিথিতেই লঙ্কেশ্বর রাবণকে বধ করেছিলেন রাম। কথিত আছে, রাবণ বধের পরে আশ্বিন মাসের ৩০তম দিনে অযোধ্যা প্রত্যাবর্তন করেন রাম, সীতা, ও লক্ষণ। রাবণ বধ ও রামচন্দ্রের এই প্রত্যাবর্তন উপলক্ষ্যেই যথাক্রমে দশেরা ও দীপাবলি পালন করা হয়ে থাকে। তবে দুর্গাপুজোর শেষ দিন হিসাবে দশমী শোকের ছায়া বহন করলেও শাস্ত্রে এই বিষয়টিকে সেই ভাবে দেখা হয়নি। এ প্রসঙ্গে শ্রীরামকৃষ্ণদেবের একটি কাহিনী উল্লেখযোগ্য। রানী রাসমণীর জামাতা মথুরবাবু একসময় আবেগপ্রবন হয়ে দশমীর দিনেও মা দুর্গাকে বিসর্জন দেবেন না বলে জেদ ধরে বসেন। তখন রামকৃষ্ণদেব তাঁকে বোঝান, বিজয়ার অর্থ দেবীমা ও সন্তানের বিচ্ছেদ নয়। তিনি আরও বলেন যে, মা কখনও তার সন্তানের থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকতে পারেন না। এতদিন মা দালানে বসে পুজো নিয়েছেন এরপর মা হৃদয়মন্দিরে বসে পুজো নেবেন। এরপরেই মথুর শান্ত হন এবং বিসর্জন হয় মা দুর্গার প্রতিমা।
বিজয়া দশমীর আরও একটি তাৎপর্য রয়েছে। হিমালয় রাজকন্যা দেবী দুর্গা বা পার্বতী বা উমা নিজের ইচ্ছায় বিয়ে করেছিলেন দেবতা শিবকে। শিবের আবাসস্থল কৈলাস পর্বত। সেখান থেকে দেবী দুর্গা বা পার্বতী পিতৃগৃহে আসেন। আশি^ন মাসের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠী তিথিতে। সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী এই তিন দিন পিত্রালয়ে থাকার পর দশমী তিথিতে পতিগৃহ কৈলাসে প্রত্যাবর্তন করেন। কন্যাকে বিদায় জানানোর বেদনায় বিধুর হয়, বিষাদাচ্ছন্ন হয় দশমী তিথি। তাই দশমী তিথি বিষাদের বেদনার।
দেবী দুর্গা তো অমর। তাহলে তার আবার বিসর্জন কী? হিন্দু শাস্ত্র মতে, দেবীকে পূজার জন্য আহŸান করে এনে মাটির প্রতিমাতে প্রতিষ্ঠা করা হয়। পূজা শেষ হলে দেবীকে বলা হয়, তুমি যেখানে ইচ্ছা যেতে পারো। তখন প্রতিমা থেকে তাকে মুক্ত করা হয়। তখন ওই মাটির প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হয়। সুতরাং বিসর্জন নামে দেবী বা কোনো দেবের ধ্বংস নয়, যে মাটির প্রতিমাতে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছিল, সেখান থেকে মুক্ত করে, তাকে যথা ইচ্ছা চলে যেতে বলা হয়। অনেক ক্ষেত্রে বিসর্জন দেওয়া হয় না। দেব বা দেবীর প্রতিমা গৃহেই থাকে। পরবর্তী পূজার আগে (বছরান্তে) পুরাতন প্রতিমা বিসর্জন দিয়ে নতুন প্রতিমা প্রতিষ্ঠিত করা হয়। কাঠের প্রতিমা হলেও তা নির্দিষ্ট সময়ের পর পরিবর্তন করা হয়। ধাতব কিংবা প্রস্তরের প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হয় না। সেই স্থলে নিত্য পূজা করা হয়। সুতরাং বিজয়া দশমীর তাৎপর্য হচ্ছে দুটি একটি দেবী দুর্গার বিজয়। অপরটি শ্রী রামচন্দ্রের বিজয়। রামচন্দ্র অকালে দেবী দুর্গার পূজা করে ছিলেন। তবে অন্য কবিদের রচিত রামায়ণে এবং পুরাণে রামচন্দ্রের দুর্গাপূজার বর্ণনা রয়েছে। দেবীর নিদ্রাকালে রাম তাকে জাগ্রত করেছিলেন বলে শরৎকালের দুর্গাপূজায় ‘বাধন’ নামক দেবীর জাগরণের একটি অনুষ্ঠান করা হয়। কিন্তু বসন্তকালের দুর্গাপূজায় এ বোধন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় না। তবে কেবল রামচন্দ্রই যে শরৎকালে দেবী দুর্গার পূজা করেছিলেন তা নয়, শরৎকালে দুর্গাপূজার রীতি অনেক স্থানেই প্রচলিত ছিল।
এ ক্ষেত্রে দেবী দুর্গার বিদায় বেদনা ও কন্যার বিদায় বেদনা এক হয়ে যায়। বাঙালি হিন্দুরা মনে করেন, বিজয়া দশমীতে তারা কেবল দেবী দুর্গাকে বিদায় দিচ্ছেন না, যেন নিজের কন্যাকে বিদায় দিচ্ছেন। এভাবে দেবী হয়ে ওঠেন ঘরের মেয়ে যে নাইওরে এসে, তিন দিন থেকে চার দিনের দিন স্বামীগৃহে ফিরে যান। এভাবে পূজাপার্বণের মধ্যে বাঙালির সমাজ ও যাপিত জীবনের প্রতিফলনও ঘটে। বিজয়া দশমী এমনই একটি ধর্মীয় কৃত্য যার মধ্য দিয়ে সমাজ জীবনের একটি দিকের প্রতিচ্ছায়া উপলব্ধি করা যায়।
লেখক : সংবাদকর্মী, সাধারণ সম্পাদক, রুদ্রজ ব্রাহ্মণ পুরোহিত সংঘ, বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় সংসদ