পূর্বদেশ ডেস্ক
অভ্যুত্থানের দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), জামায়াতে ইসলামীসহ ধর্মভিত্তিক দলগুলোর দাবির মুখে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। সেই সঙ্গে ছাত্র-জনতার গণ আন্দোলন দমানোর অভিযোগে বিচারের মুখোমুখি করতে আওয়ামী লীগের বিচারের পথ খুলতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন সংশোধনের সিদ্ধান্ত হয়েছে উপদেষ্টা পরিষদের জরুরি বৈঠকে।
গতকাল শনিবার রাতে উপদেষ্টা পরিষদের জরুরি সভা শেষে এসব সিদ্ধান্তের কথা জানান আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল। সভায় তিনটি সিদ্ধান্ত হওয়ার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পরিপত্র পরবর্তী কর্মদিবসে জারি করা হবে।
বিচার না হওয়া পর্যন্ত সন্ত্রাসবিরোধী আইনের অধীনে ‘সাইবার স্পেসসহ’ আওয়ামী লীগের যাবতীয় কার্যক্রম বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
দেশের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা, জুলাই আন্দোলনের নেতাকর্মীদের নিরাপত্তা এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বাদী ও সাক্ষীদের সুরক্ষাকে কারণ হিসেবে তুলে ধরার কথা বলেন আইন উপদেষ্টা। খভর বিডি ও বাংলা ট্রিবিউনের।
টানা দুই দিন ধরে শাহবাগে আন্দোলনকারীদের অবস্থানের মধ্যে গতকাল রাতে ডাকা উপদেষ্টা পরিষদের জরুরি এ সভায় জুলাই ঘোষণাপত্র আগামী ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে চূড়ান্ত করে তা প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত হওয়ার কথা জানান আইন উপদেষ্টা।
উপদেষ্টা পরিষদের সিদ্ধান্তগুলোর বিষয়ে দেওয়া বিবৃতি আসিফ নজরুল বৈঠক শেষে বিফ্রিংয়ে পড়ে শোনান। তিনি বলেন, উপদেষ্টা পরিষদের বিশেষ সভায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল আইনের সংশোধনী অনুমোদন পেয়েছে।
সংশোধনী অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল কোনো রাজনৈতিক দল, তার অঙ্গসংগঠন বা সমর্থক গোষ্ঠীকে শাস্তি দিতে পারবে। বিবৃবিতে বলা হয়, উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও তার নেতাদের বিচার কার্যসম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত দেশের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা, জুলাই আন্দোলনের নেতাকর্মীদের নিরাপত্তা এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বাদী ও সাক্ষীদের সুরক্ষার জন্য সন্ত্রাসবিরোধী আইনের অধীনে সাইবার স্পেসসহ আওয়ামী লীগের যাবতীয় কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
তৃতীয় সিদ্ধান্তের ব্যাপারে আসিফ নজরুল বলেন, জুলাই ঘোষণাপত্র আগামী ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে চূড়ান্ত করে তা প্রকাশ করা হবে।
উপদেষ্টা পরিষদের সভায় আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের খবর আসা মাত্র শাহবাগ ও হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের মোড়ে অবস্থান নেওয়া আন্দোলনকারীরা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন। অনেকেই স্লোগান দেন, ‘এ মূহূর্তে খবর এলো, আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হলো’।
প্রসঙ্গত, ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন পুরান ঢাকার রোজ গার্ডেনে ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’ নামে প্রতিষ্ঠিত হয়। মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং শামসুল হক প্রমুখ সূচনালগ্নে এই দলের নেতৃত্ব দেন। পাকিস্তানের মধ্যে পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসন, অর্থনৈতিক ন্যায্যতা, এবং বাংলা ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এই দলটি গঠন করা হয়।
১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট গঠন করা হয়। আওয়ামী লীগ যুক্তফ্রন্টের অংশ হিসেবে প্রাদেশিক নির্বাচনে বিজয়ী হয়। ২১ দফা কর্মসূচির মধ্যে বাংলা ভাষার মর্যাদা ও স্বায়ত্তশাসন অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৯৫৭ সালে মাওলানা ভাসানী পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে মতবিরোধে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) গঠন করেন।
১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে পূর্ব পাকিস্তানের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে ছয় দফা আন্দোলন উত্থাপিত হয়। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় (১৯৬৮) শেখ মুজিবসহ ৩৫ জনের বিরুদ্ধে পাকিস্তান ভাঙার অভিযোগে মামলা দায়ের করা হয়, কিন্তু গণআন্দোলনের চাপে মুক্তি পান।
১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে ১৬৯টির মধ্যে ১৬৭টি আসন লাভ করে। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতা হস্তান্তরে অস্বীকৃতি জানায়।
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে প্রবাসী সরকার গঠিত হয় এবং ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। স্বাধীন দেশে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সরকার গঠিত হয়। ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে আওয়ামী সরকার গঠন করে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সেনাবাহিনীর একটি অংশ শেখ মুজিব ও তার পরিবারকে হত্যা করে। পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হয়।
১৯৮১ সালে শেখ হাসিনা প্রথম আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিএনপির কাছে পরাজিত হলেও ১৯৯৬-এর জুনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফেরে। এরপর ২০০৯ থেকে টানা ক্ষমতাসীন ছিল আওয়ামী লীগ। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটে।