পূর্বদেশ ডেস্ক
বিচারপতি অপসারণে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল পুনরুজ্জীবিত করে যে রায় সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ সাত বছর আগে দিয়েছিল, পর্যালোচনার পর সেই সিদ্ধান্তই বহাল রেখেছে সর্বোচ্চ আদালত। সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে আপিল বিভাগের দেওয়া ওই রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন করেছিল রাষ্ট্রপক্ষ। প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বে ৬ বিচারপতির আপিল বেঞ্চ গতকাল রোববার শুনানি শেষে কিছু নির্দেশনাসহ তা নিষ্পত্তি করে দিয়েছে।
এখন কোনো বিচারপতি দায়িত্ব পালনে অসমর্থ হলে বা পেশাগত অসদাচরণের কোনো অভিযোগ উঠলে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া যাবে। ফলে বিচারপতি অপসারণ প্রক্রিয়া নিয়ে গত সরকারের সময় যে জটিলতা তৈরি হয়েছিল, এই রিভিউ রায়ের মধ্য দিয়ে তার অবসান ঘটল বলে আইনজীবীরা মনে করছেন। খবর বিডিনিউজের।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারপতি অপসারণ ক্ষমতা সংসদের হাতে ন্যস্ত করা হলে সর্বোচ্চ আদালতের সঙ্গে টানাপড়েন তৈরি হয়। এরপর এক রিট মামলার রায়ে ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করে আপিল বিভাগ।
২০১৭ সালের ওই রায়েই বিচারপতি অপসারণে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল পুনরুজ্জীবিত করার কথা বলা হয়। তখনকার প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার নেতৃত্বাধীন আপিল বেঞ্চের ওই রায় সরকারের সঙ্গে সর্বোচ্চ আদালতের টানাপড়েনে নতুন মাত্রা দেয়। রাষ্ট্রপক্ষ ওই রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন করলেও পরে আর শুনানির উদ্যোগ নেয়নি।
নিয়ম অনুযায়ী, সুপ্রিম কোর্টের ওই রায়ের পর সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল গঠন করে বিচারপতি অপসারণে কোনো বাধা ছিল না। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি এবং রিভিউ আবেদন ঝুলে থাকায় গত সাত বছরে সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল আর গঠন হয়নি। ফলে দুর্নীতির অভিযোগ উঠার পরও হাই কোর্টের তিন বিচারপতির বিরুদ্ধে তদন্ত ঝুলে রয়েছে পাঁচ বছর ধরে।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তাদের ‘দোসর’বিচারকদেরও অপসারণের দাবি তোলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। তাদের সুপ্রিম কোর্ট ঘেরাও কর্মসূচির মধ্যে গত সপ্তাহে ১২ জন বিচারককে আপাতত বেঞ্চ না দেওয়ার সিদ্ধান্ত দেন প্রধান বিচারপতি। তখনই ষোড়শ সংশোধনী মামলা ফের আলোচনায় আসে।
আন্দোলনের সূত্র ধরে ষোড়শ সংশোধনী মামলার রিভিউ আবেদনটি গতকাল আপিল বিভাগের কার্যতালিকায় আসে। রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান ও রিট আবেদনকারীদের পক্ষে আইনজীবী মনজিল মোরসেদ শুনানিতে অংশ নেন। এ ছাড়া সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মো. রুহুল কুদ্দুস আদালতের অনুমতি নিয়ে শুনানি করেন।
রায়ের পর রুহুল কুদ্দুস সাংবাদিকদের বলেন, ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদের ২ থেকে ৮ পর্যন্ত ধারা বাতিল করা হয়েছিল। আপিল বিভাগ সেগুলো পুনর্বহাল করেছে।
আর অ্যাটর্নি জেনারেল আসাদুজ্জামান বলেন, এই রায়ের ফলে এখন থেকে কোনো বিচারপতির বিরুদ্ধে অসদাচরণের অভিযোগ এলে সেই অভিযোগ নিষ্পত্তির জন্য প্রধান বিচারপতি ও আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ দুইজন বিচারপতিকে নিয়ে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠিত হবে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল ওই বিচারপতিকে অপসারণ বা ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠাবেন। রাষ্ট্রপতি সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের সুপারিশ অনুযায়ী পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন।
ষোড়শ সংশোধনীর আগে সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদের ছয়টি ধারা পুনর্বহাল হওয়ায় বিচারক অপসারণ প্রক্রিয়ার নিষ্পত্তির জন্য ১৯৭৭ সালে জিয়াউর রহমানের সময় করা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বিধান ফিরে এসেছে। ওই অনুচ্ছেদের পুরনো ৩ নম্বর ধারায় বলা আছে, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠিত হবে প্রধান বিচারপতি এবং দুজন জ্যেষ্ঠ বিচারককে নিয়ে। কাউন্সিলের কোনও সদস্য যদি অনুপস্থিত থাকেন, অসুস্থতা কিংবা অন্য কোনো কারণে কাজে অসমর্থ হন অথবা কাউন্সিলের কোনো সদস্যের বিরুদ্ধেই যদি তদন্ত চলে, সেক্ষেত্রে পরবর্তী জ্যেষ্ঠ বিচারক কাউন্সিলের সদস্য হিসেবে কাজ করবেন।
কাউন্সিলের দায়িত্ব সম্পর্কে ৪ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, বিচারকদের জন্য পালনীয় একটি আচরণবিধি কাউন্সিল নির্ধারণ করে দেবে এবং একজন বিচারকের বিরুদ্ধে অভিযোগ পেলে সে বিষয়ে তদন্ত করবে।
৫ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, কাউন্সিল অথবা অন্য কোনো সূত্র থেকে রাষ্ট্রপতি যদি জানতে পারেন যে, কোনো বিচারক শারীরিক বা মানসিক আগমর্থ্যরে কারণে দায়িত্ব পালনের অযোগ্য হয়ে পড়েছেন বা তার বিরুদ্ধে গুরুতর অসদাচরণের অভিযোগ রয়েছে, তাহলে রাষ্ট্রপতি কাউন্সিলকে বিষয়টি তদন্ত করে ফলাফল জানানোর নির্দেশ দিতে পারেন।
তদন্ত করার পর কাউন্সিল যদি সংশ্লিষ্ট বিচারকের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ বা তার অসমর্থ্যতার প্রমাণ পায় এবং বিষয়টি রাষ্ট্রপতিকে জানায়, তাহলে ৬ নম্বর দফা অনুসারে রাষ্ট্রপতি ওই বিচারককে অপসারণের আদেশ দেবেন।
৭ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, তদন্তের ক্ষেত্রে কাউন্সিলই নিজের কর্মপদ্ধতি ঠিক করবে এবং সুপ্রিম কোর্টের মত ক্ষমতা ধারণ করবে।