বান্দরবানে পাহাড়ধসের ঝুঁকিতে লাখো মানুষ

2

মো. শাফায়েত হোসেন, বান্দরবান

বান্দরবানে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পাহাড়ের পাদদেশে বসবাস করছেন প্রায় লক্ষাধিক মানুষ। জেলার সাতটি উপজেলা ও ২টি পৌরসভা এবং ৩৪টি ইউনিয়নে প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞার তোয়াক্কা না করেই পাহাড় কেটে ঘর-বাড়ি নির্মাণ করে ঝুঁকিতে বাস করে এসব মানুষ। অপরিকল্পিতভাবে পাহাড় কাটা এবং বৃক্ষনিধনের কারণে পাহাড় ধসে ঘটছে মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনা। এসবের পরও বন্ধ হচ্ছে না বান্দরবানে পাহাড় কাটাসহ অবৈধ বসতি স্থাপন। গত ১০ বছরে বান্দরবান জেলার বিভিন্ন স্থানে প্রবল বর্ষণ ও ভ‚মিধসে বিভিন্ন বয়সী নারী-শিশুসহ প্রায় শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে।
ঝুঁকিতে থাকা এসব পরিবারকে আশ্রয় কেন্দ্রে নিতে জোর তৎপরতা চালাচ্ছে প্রশাসন। সেই সাথে করা হচ্ছে সতর্কতামূলক মাইকিং। প্রস্তুত করা হয়েছে ২২০টি আশ্রয় কেন্দ্র। জোগান রাখা হয়েছে প্রয়োজনীয় খাদ্যের। প্রস্তুত রাখা হয়েছে স্বেচ্ছাসেবক, জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয় প্রশাসনকে। অব্যাহত ভারী বৃষ্টিপাতে পাহাড়ধসে সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে রুমা উপজেলা। সেখানে সড়ক থেকে মাটি সরানোর কাজ করছে সেনাবাহিনী।
স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও বিভিন্নি সংস্থার তথ্যে দেখা গেছে, বান্দরবানের সাতটি উপজেলায় এবং দুইটি পৌর এলাকায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পাহাড়ের ঢালুতে (পাদদেশে) বসবাস করছেন প্রায় লক্ষাধিক পরিবার। যার মধ্যে প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ হাজারেরও বেশি পরিবার অতিঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে।
স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মতে, বর্ষার শুরুতেই প্রতিদিনই মাইকিং করা হচ্ছে নিরাপদ স্থানে সরে যেতে। বান্দরবানের বেশিরভাগ এলাকা পাহাড়বেষ্টিত; আর তাই পাহাড় কেটে অথবা পাহাড়ের আশেপাশেই প্রতিদিনই তৈরি হচ্ছে অসংখ্য নতুন নতুন স্থাপনা। তবে পাহাড় কর্র্তন আর ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে বসত রোধে প্রশাসনের তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে।
এদিকে গেলো কয়েকদিন ধরে টানা মাঝারি ও ভারী বৃষ্টিপাত অব্যাহত রয়েছে বান্দরবান জেলাজুড়ে। বৃহস্পতিবার গভীর রাত থেকে টানা বর্ষণে শহরের বনরূপা, হাফেজঘোনা, মেম্বার পাড়াসহ বেশ কিছু নিচু এলাকায় সড়কের উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হতে দেখা গেছে। এছাড়াও ঝড়ো হাওয়ায় বেশ কিছু সড়কে গাছ ভেঙ্গে পড়ে ও পাহাড়ের মাটি পড়ে যান চলাচলে বাঁধা সৃষ্টি হয়েছে। রাতভর ভারী বৃষ্টিপাত হওয়ায় ঐসব এলাকা প্লাবিত হয়।
পাহাড়ের পাদদেশের ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় বসবাসকারী বাসিন্দাদের নিরাপদে সরে যেতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিভিন্ন এলাকায় মাইকিং করা হচ্ছে। এছাড়াও জেলার সাতটি উপজেলায় ঝুঁকিপূর্ণভাবে যারা বসবাস করছে তাদেরকে নিরাপদে সরে যেতে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষে থেকে সর্বোচ্চ সতর্কতা জারি করেছে। আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে ঝুঁকিতে থাকা পরিবারগুলোকে নিয়ে যেতে বেশ তোরজাড় করছে প্রশাসন। জেলা প্রশাসন, পৌর প্রশাসন ও উপজেলা প্রশাসন এলাকাগুলোতে মাইকিং করছে।

বিচ্ছিন্ন রুমা উপজেলা
টানা বৃষ্টিতে পাহাড় ধসের ঘটনায় রুমা উপজেলার সঙ্গে জেলা সদরের সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। গতকাল শুক্রবার দুপুর থেকে ওয়াইজংশন-রুমা সড়কের একটি অংশে পাহাড়ধসে পড়ায় যান চলাচল বন্ধ যায়। বান্দরবান-রুমা সড়কের পরিবহন মালিক ও শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ওয়াইজংশন থেকে দুই কিলোমিটার পর সড়কের ওপর বড় ধরনের পাহাড়ধস হয়েছে। দুপুরের পর থেকে সড়ক পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। ধসের জায়গায় যাত্রী নামিয়ে দুই পাশে গাড়ি চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে। তবে সড়ক রক্ষণাবেক্ষণে নিয়োজিত সেনাবাহিনীর ২৬ ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন ব্যাটালিয়নের (২৬ ইসিবি) কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ধসে পড়া মাটি সরানোর কাজ চলছে। দ্রুত সড়ক চলাচলের উপযোগী করা সম্ভব হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
পাহাড়ে ঝুঁকিতে বসবাসকারীরা জানান, পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসকারীরা প্রায় শ্রমিক শ্রেণির মানুষ। যারা ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে তাদের মধ্যে হতদরিদ্র পরিবারের সংখ্যাই বেশি। জীবিকার তাগিদে পাহাড়ের ঢালুতে পাহাড় কেটে তৈরি করা আবাসস্থলগুলোতে কম ভাড়ায় বসবাস করা যায়। কিন্তু বৃষ্টি শুরু হলেই মাইকিং করে লোকজনকে আশ্রয়কেন্দ্রে সরিয়ে নেয়। তবে সরকারের পক্ষ থেকে তাদের জন্য অন্যত্র আবাসনের ব্যবস্থা করে না দেয়ায় নিজেদের ভিটেমাটি ছেড়ে যেতে চান না তারা। সরকারিভাবে স্থায়ী পুনর্বাসনের উদ্যোগ নিতে অনুরোধ জানান ঝুঁকিতে বসবাসকারীরা।
বান্দরবান মৃত্তিকা গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মাহবুবুল ইসলাম বলেন, পাহাড়ধস তাৎক্ষণিক ঘটনা মনে হলেও এটি দীর্ঘ মেয়াদী প্রক্রিয়ার ফসল। ভ‚মিক্ষয়ের মাধ্যমে পাহাড়ে ফাটল তৈরি হয় এবং ধস নামে। পাহাড় ধসের অন্যতম কারণ হচ্ছে নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন, অপরিকল্পিতভাবে পাহাড় কাটা এবং উপযুক্ত পদ্ধতি অবলম্বন না করে পাহাড়ে চাষাবাদ করা। তবে পাহাড়ধস রোধে বৃক্ষ নিধণ এবং পাহাড় কাটা বন্ধ করতে হবে। তা না হলে প্রতিনিয়ত প্রাণহানির ঘটনা আরোও বাড়বে।
জেলা প্রশাসক শামীম আরা রিনি বলেন, পাহাড়ের পাদদেশে ও ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় বসবাসরত বাসিন্দাদের সরে যেতে অনুরোধ জানানো হয়েছে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও স্বেচ্ছাসেবীদের সতর্ক থাকতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও জেলা সদরসহ সাতটি উপজেলায় ২২০টি অস্থায়ী আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে। জেলা প্রশাসক আরোও বলেন, জেলা এবং উপজেলা পর্যায়ে বিভিন্ন স্কুল কলেজকে অস্থায়ী আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এছাড়াও জেলা সদরে একটি সাইক্লোন সেন্টার রয়েছে সেটাকেও প্রস্তুত রাখা হয়েছে। মানুষ যেন নিরাপদে থাকতে পারে সে ব্যবস্থা করা হয়েছে। বান্দরবানের সাত উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের নিদের্শনা প্রদান করা হয়েছে এবং যেকোনো ধরনের দুর্যোগ মোকাবেলায় আশ্রয়কেন্দ্রগুলো দ্রুত পরিস্কার ও প্রস্তুত রাখা, শুকনো খাবার মজুদ করা ও দুর্যোগ মোকাবেলায় সহায়তাকারীদের প্রস্তুত রাখার জন্য নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে।