পাহাড়ের জুমিয়া পরিবারগুলো আগুন দেওয়ার মাধ্যমে জুম চাষের প্রস্ততি নিচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে যুগ যুগ ধরে সনাতন পদ্ধতিতে পাহাড়িরা জীবিকা নির্বাহে জুম চাষ করে আসছে। জুমিয়া পরিবারগুলো জুম চাষের মাধ্যমেই সারা বছরের খাদ্যের সংস্থান করে থাকেন। বান্দরবানে প্রতি বছরের ন্যায় জুমিয়ারা এবারো বন-জঙ্গল কেটে পাহাড়ি ভূমি জুম চাষের উপযোগী করে নিয়েছে। জেলা সদরসহ ৭টি উপজেলায় হাজার হাজার একর পাহাড়ি ভূমিতে বর্তমানে অগ্নিসংযোগের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। অনেকে আবার আগুন দেয়া ভূমির অবশিষ্ট গাছপালা কেটে পরিষ্কার করে নিয়েছে। মে-জুন মাসের মধ্যেই শুরু হবে জুমে বীজ বুননের কার্যক্রম।
জুম চাষিরা জানান, প্রতি বছর মার্চ-এপ্রিল মাসে জুমিয়ারা জুমের জন্য বাছাই করা পাহাড়ের বন-জঙ্গল কাটেন। এপ্রিল-মে মাসের দিকে জুমিয়া পরিবারগুলো পাহাড়ি ভূমিতে বীজ বুননের উপযোগী করতে পাহাড়ে আগুন দেয়। আগুনে পোড়ানো পাহাড়ে মে-জুন মাসের শুরুতে বীজ বুনন শুরু করেন। জুমে ধানের পাশাপাশি মরিচ, মিষ্টি কুমড়া, ভুট্টা, যব, মারফা (পাহাড়ি শশা), ছিনারগুলা (পাহাড়ি মিষ্টিফল), তুলা, টকপাতাসহ রকমারী কৃষিপণ্যের চাষ করে থাকেন।
পাহাড়ি নেতারা বলেন, পাহাড়ে চাষের জন্য জুমের বিকল্প নেই। ঐতিহ্যবাহী জুমচাষকে কেন্দ্র করে এ এলাকার সংস্কৃতি বা পরিবেশগত ভারসাম্য গড়ে উঠেছে। এখানে সংরক্ষিত বনাঞ্চল সৃষ্টির ফলে জুমচাষের নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। তাছাড়া, জুম চাষের ক্ষেত্র এবং জুমের ফসলগুলো উৎপাদন শক্তি হ্রাস পাওয়ায় জুমচাষীরা অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সচেতন মহলের মতে, বিশাল পাহাড়ি জনগোষ্ঠীকে জুম চাষের বিকল্প আয়ের সংস্থান করে দিলে প্রতি বছর হাজার হাজার একর বনভূমি রক্ষা পাবে। সেই সাথে পার্বত্যাঞ্চলের বিপন্ন প্রাণীকুল ও প্রাকৃতিক পরিবেশ জনবসতির অনুকূলে আসতে পারে। অন্যথায়, প্রতিবছর এ পদ্ধতিতে জুম চাষের ধারা বজায় থাকলে সবুজের ঢাকা পাহাড় রূপ নেবে মরুময়তায়।
মৃত্তিকা ও পানি সংরক্ষণ বিভাগের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মাহবুব আলম জানান, পাহাড়ে যখন আগুন দেয়া হয় তখন মাটির অনুজীব গুলো ধ্বংস হয়ে যায়। ফলে মাটি ক্ষয় হয় এবং উর্বরতা শক্তি কমে যায়। যার কারণে প্রথম বছর ফলন ভালো হলেও পরবর্তিতে সেই জমিতে গাছপালাতো দূরের কথা আগাছাও ভালোভাবে জন্মায় না। এ ছাড়াও আগুন দিয়ে বন জঙ্গল পুড়িয়ে ফেলার কারণে প্রকৃতির জীববৈচিত্রকে চিরস্থায়ী ধ্বংস এবং ভুগর্ভস্থ পানির উৎস স্থলও ধ্বংস করে দেয়া হচ্ছে। তার মতে, মানবিক কারণে সরকারও পাহাড়িদের জুম চাষে আইন প্রয়োগে উৎসাহী নয়। জুম চাষিদের আধুনিক পদ্বতিতে জুম চাষাবাদ করার জন্য উদ্বুদ্ধ করতে সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহবান জানান এই বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা।
জেলা কৃষি স¤প্রসারণ বিভাগের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ ড. এ কে এম নাজমুল জানান, জুম চাষের উপকারের চেয়ে ক্ষতিই হচ্ছে বেশি। জুমচাষে পাহাড় পোড়ানোর ফলে মাটির উর্বরতা কমে যায়। ভবিষ্যতে জুম চাষের ফলে মাটি ক্ষয়ের কারণে পাহাড় আর থাকবে না। পাহাড়ে আগুন না দিয়ে জুমচাষীরা যদি বিভিন্ন ফলের বাগান করেন তাহলে পাহাড়ের কোনো ক্ষতি হবে না।
এই কৃষিবিদের মতে, জুমের এখনো পর্যন্ত সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি। কারণ জুমিয়া পরিবারগুলো জুম চাষ মাত্র শুরু করেছেন। চাষীরা একই জমিতে একবার জুম চাষ করলে পরবর্তি বছর সেখানে আর জুম চাষ করে না, নতুন কোনো জমিতে আবাদ করে। ফলে জুমের আবাদি জমির পরিমাণ একই থাকতে পারে। তবে নতুন নতুন জায়গায় জুম চাষ করতে গিয়ে বন ধ্বংসের কথা স্বীকার করেন এ কর্মকর্তা।











