রশীদ এনাম
‘ওভাই আঁরা চাটগাঁইয়া নওজোয়ান ওভাই আঁরা চাটগাঁইয়া নওজোয়ান,
দইজজার কূলত বসত গরি শিনাদি ঠেগাই ঝড় তুয়ান’
মানুষ মানুষের জন্যে জীবন জীবনের জন্যে একটু সহানুভূতি কি মানুষ পেতে পারে না? ও বন্ধু মানুষ মানুষের জন্য-শিল্পী ভূপেন হাজারিকার গানের চরণটি খুব মনে পড়ছে। জুলাই -আগস্টজুড়ে যেন দেশে একে পর এক বড় অসুখ। একমাত্র বিধাতাই ভালো জানে এ অসুখ সারবে কবে। প্রাকৃতিক দুর্যোগে ভয়াবহ বন্যায় সীমাহীন দুর্ভোগে পড়েছে দেশের মানুষ। বন্যার জলে ভাসছে বেশকিছু জেলা। অর্ধকোটি মানুষ পানি বন্দী বানের পানিতে যেন ধূসর শহর চারিদিকে পানি আর পানি কিন্তু পান করার মতো নেই এক ফোটা পানি। এ যেন এক পাষাণপুরীর মৃত্যুপুরী ১৫ জনেরও বেশি মারা যাওয়ার খবর দেখেছি এ সংখ্যা বাড়তে পারে। মৃত্যুর মিছিলে হাটছে, শিশু -নারী, তরুণ- বৃদ্ধ। শান্তির পায়রা আজ মনিবের কথা শুনে না চক্রাকারে যেন উড়ছে আর উড়ছে। সবকিছু যেন এলোঝেলো দেশের মানুষ এমনিতে ট্রমায় তার মধ্যে বন্যা যেন গোদের উপর যেন বিষফোঁড়া। মানুষের মায়া, মমতা মানবিকতা, ভালোবাসার শেষ পেড়েকটুকু যেন কফিন বাক্সে বন্দী। কিছু মানুষের পাপ যেন গর্ভবতী হওয়ার মতো। গত কয়েকদিন অতিবৃষ্টি ও উজানের ঢলে দেশের প্রায় ১২/১৩ টি জেলা প্লাবিত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত কোটি মানুষ। চট্টগ্রাম বিভাগের ফেনী ছোট একটি জেলা ছবির মতো ৬টি থানা নিয়ে গঠিত।চোখের পলকে যেন বানের পানিতে তলিয়ে গেছে আহা মানুষের আহাজারি। ঢাকা চট্টগ্রামের সাথে সড়ক ও রেলযোগাযোগ গত বৃহস্পতিবার-শুক্রবার বিচ্ছিন্ন ছিল। সড়কের উপর সারি সারি বাস-পণ্যবাহি ট্রাক ও প্রাইভেট গাড়ি দাঁড়িয়ে ছিল ঘণ্টার পর ঘণ্টা। আবাহাওয়া অধিদপ্তর থেকে বন্যার কোন পূর্বাবাসও ছিল না। ভাদ্রমাসের শুরুতে হঠাৎ অতিবৃষ্টি উজান থেকে নেমে আসা পানির ঢল এবং ভারতে ত্রিপুরা রাজ্যে ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতি অবনিত হওয়ায় ত্রিপুরার ধলাই জেলার জলাধার ডুম্বুরের অস্বাভাবাকি পানির চাপ থাকায় স্ন্যাপ গেট খুলে দেওয়ায় ফেনী জেলায় পানিতে টইটম্বুর হয়ে যায়। পাশাপাশি কুশিয়ারা, মনু, ধলাই, খোয়াই, মুহুরী, ফেনী ও হালদা নদীর পানি হঠাৎ করে বেড়ে যায়। পানির স্রোতে অনেক নদীর বাঁধ ছিড়ে রাস্তা, সেতু, ফসলী জমি, গরু-মহিষ, হাস-মুরগী ও মাছের খামার বানের পানিতে ভেসে গেছে। ফেনীর খুব কাছের বন্ধু, জিয়া, হাসান, কাউছার মুঠোফোনে জানিয়েছিল, তাঁদের এলাকায় ১তলা বাড়িতে পানি ওঠে ২ তলা ছুঁই ছুঁই করছে। হাজার হাজার মানুষ পানি বন্দী, বানের পানিতে ভেসে যাচ্ছে। অনেকে পরিবার আশ্রয় কেন্দ্রে ঠাঁই হলেও অনেকে বাড়ির ছাদে, গাছে, বন জঙ্গলে আটকা পড়েছেন। সামাাজিক যোগাযোগ মাধ্যেমে গলা পরিমান পানিতে ছোট শিশুর ভয়ার্ত দৃষ্টিতে অবাক চোখে থাকিয়ে থাকা, একটা পাত্রে ফুলে মতো শিশু, আরেকটি পাত্রে দুটি বেড়াল ভেসে যাওয়ার দৃশ্য হাজারো মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে গেছে। গর্ভবতী মহিলার ভেসে যাওয়ার দৃশ্য, প্রবাসীর রেমিট্যান্সযোদ্ধার স্ত্রীপুত্রকে বাঁচানোর আর্তনাদ, এক পাল গরু, মহিষ, ফার্মের মৃত মুরগী, ছোট ভাইটির কোলে শিশুর ভেসে যাওয়া লাশ, বাবার কোলে সন্তানের লাশ, বৃদ্ধ বাবা-মাকে টিনের ছাদ থেকে নামিয়ে কাঁধে করে পানি থেকে রক্ষা করার দৃশ্যও চোখে পড়েছে। জলে ভেজা পরিধানের এক কাপড়ে কোর রকমে মৃত্যুর মুখ থেকে বেঁচে আসা মানুষের আহাজারি দেখে নিরবে নিভৃতে কেঁদেছি।
ফেনি, নোয়াখালী, লক্ষীপুর, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়ো, রাঙ্গামাটি, কক্সবাজার সিলেট, মৌলভীবাজার হবিগঞ্জ, চট্টগ্রামের মিরশ্বরাই, ফটিকছড়ি, খাগড়াছড়ি, নাজির হাট, রাউজান, ও রাঙ্গুনিয়া হাটহাজারিতে হালদার পানিতে ভেসে গেছে অনেক বাড়িঘর। ভালো লেগেছে চট্টগ্রামসহ দেশের মানুষ অনেকে নৌকা, স্পিড বোর্ড, হেলিকপ্টরে নিয়ে মানুষকে বাঁচানোর জন্য ভালোবাসার হাত বাড়িয়েছেন। বানভাসি মানুষের পাশে এগিয়ে এসেছে সেনাবাহীনি, নৌবাহিনী, বিজিবি, স্থানীয় প্রশাসন, বিভিন্ন ইশকুল, কলেজ বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা, জেনারেশন-জেড/জেন-জি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি, বিশেষ করে তরুণ সমাজ, ছোট শিশুরা পর্যন্ত তাঁদের ঈদসেলামীর জমানো টাকা নিয়ে বন্যাদুর্গতদের প্রতি ভালোবাসার হাত বাড়িয়েছে। বন্যার গ্রাসের অনেকে নিষ্পেষিত পরিবারের মানুষ সর্বস্ব হারিয়ে প্রতীক্ষা আছে ত্রাণের জন্য। প্রশংসার দাবীদ্বার গাউছিয়া কমিটি, হক কমিটি, আজকের প্রজন্ম, বন্ধুসভা, রেডক্রিসেন্টসহ আরো অনেক স্বেচ্ছাসেবী ক্লাব, সংগঠন যারা বন্যাদুর্গত মানুষের জন্য ত্রাণ বিতরণসহ নিবেদিত প্রাণ হয়ে নিরলসভাবে বানভাসিদের জীবন রক্ষায় উদ্ধার কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। সুযোগসন্ধানিরা অনেকে বাড়ি-ঘর ডাকাতি ও মালামাল লুন্ঠনে ব্যস্ত। কিছু স্বেচ্ছাসেবক আবার ডাকাতদের পাহাড়া দিচ্চে। বন্যাদুর্গত এলাকায় এখন সবেচেয়ে বেশি প্রয়োজনীয় খাবার পানি, পরিধানের জামাকাপড়, বিশেষ করে নারীও শিশুদের কাপড়, প্রয়োজনীয় খাবার, শিশু খাদ্য, ওষুধ। বন্যাকবলিত এলাকায় পানি কমার পর পানিবাহিত রোগ ব্যাধী ছড়িয়ে পড়বে এ ব্যাপারে আমাদের চিকিৎসা সবেক ও স্বাস্থ্য দপ্তরকেও এগিয়ে আসতে হবে এবং অবশ্যই প্রয়োজনীয় ওষুধ সরবরাহ করতে হবে। পাশাপাশি সরকারি বেসরকারি কর্মজীবীরা একদিনে বেতন কিংবা সামর্থ অনুযায়ী অর্থ, ব্যবসায়ীসংগঠন, বিত্তশালীরা প্রত্যেকে যাঁর যাঁর জায়গা থেকে এগিয়ে আসার জন্য তরুণরা সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখতে পারে। একটা সমাজে বা এলাকায় যে কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগে সবার আগে তরুণরা সবার আগে এগিয়ে আসেন।
তরুণদের প্রতি সবিনয় নিবেদন সর্বস্ব হারানোর বানভাসি নিষ্পেষিত মানুষের প্রতি ভালোবাসার হাত বাড়িয়ে দিন। ওদের পাশে দাঁড়ান। তরুণদের এক চিলতে ভালোবাসায় বন্যাদুর্গত অসহায় মানুষটি বেঁচে যাবে ছোট শিশুটির মুখে হাসি ফুটবে। তাই আসুন কবি শক্তিচট্টোপাধ্যায়ের বাসায় বলি মানুষ বড় কাঁদছে, তুমি মানুষের পাশে দাঁড়াও।
লেখক : প্রাবন্ধিক