এম এ হোসাইন
ফুটপাত পুরোটাই দখলের পর সড়কেরও অর্ধেকজুড়ে রাখা হয়েছে ইট-বালু-কনক্রিটসহ নির্মাণসামগ্রী। কিছুক্ষণ পর পর ডাম্প ট্রাকে করে ইট-বালু এনে সেগুলো নামিয়ে রাখতে বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে পুরো সড়ক! চলাচল বন্ধ করে দেওয়ায় থামতে থামতে গাড়ির দীর্ঘ সারি-এই দৃশ্য নগরীর ব্যস্ততম বহদ্দারহাট-কাপাসগোলা আরাকান সড়কের বাদুরতলা জঙ্গি শাহ মাজার গেট এলাকার। গত দুই বছর ধরে চলছে এমন তুঘলকি কারবার। ব্যস্ততম সড়কের পাশ ঘেঁষে বহুতল ভবনটি ইতোমধ্যে ১০ তলা পর্যন্ত উঠেছে। কিন্তু কোনোদিকে কোনো ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
সরেজমিনে দেখা গেছে, বহদ্দারহাট আরাকান সড়কে যখন শত শত রিকশা-ট্যাক্সিসহ বিভিন্ন যানবাহন যাত্রী নিয়ে চলছে, সেই সময়েই রাস্তা দখল করে নির্মাণসামগ্রী-মিক্সার ভবনের ওপরে তোলা হচ্ছে ক্রেন দিয়ে, কোনো নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছাড়াই। এতে যে কোনো মুহূর্তে ক্রেন ছিঁড়ে ঘটতে পারে বড় দুর্ঘটনা। পাশ দিয়ে মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে যাতায়াত করছেন পথচারীরা। পরিস্থিতি এমন যে, দেখলেই বুঝা যায়, পথচারীর মাথার ওপর যমদূত হয়ে পড়তে পারে ইট,পাথর কিংবা লোহা।
দীর্ঘদিন ধরে ভবনটির মালিক ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় কাজ অব্যাহত রাখলেও এলাকাবাসী কেউ মুখ খোলার সাহস পায়নি। কারণ, ভবনটির মালিক পতিত বিগত আওয়ামী ফ্যাসিস্ট সরকারের নেতাদের ঘনিষ্ঠ বলে প্রচার রয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন স্থানীয় বাসিন্দা বলেন, ‘রাস্তার উপর সব ধরনের সরঞ্জাম রেখে দিনের বেলায়ও নির্মাণ কাজ চলছে। বিভিন্ন সময় ইট, পাথর এসে পথচারীর উপরও পড়ছে। নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছাড়াই ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। কোনো সরকারি নির্দেশনা মানা হচ্ছে না। আওয়ামী লীগের একজন নেতা ভবনের সঙ্গে জড়িত বলে শুনেছি, তবে কাউকে কখনো দেখিনি।’
ইমারত নির্মাণ বিধিমালা না মেনে এ ধরনের নির্মাণকাজ চলছে নগরের প্রায় বিভিন্ন স্থানে। নকশাবহির্ভ‚তভাবে যেমন ভবন উঠছে, তেমনি নকশা নেয়ার পরও মানা হচ্ছে না নীতিমালা। রাস্তা ও ফুটপাত দখল করে রাখা হচ্ছে নির্মাণ সরঞ্জাম, যা পথচারীদের দুর্ভোগে ফেলছে। এর ফলে তৈরি হচ্ছে মারাত্মক ঝুঁকি। এছাড়া, অধিকাংশ নির্মাণাধীন ভবনে নিরাপত্তা বেষ্টনী এবং প্রয়োজনীয় সুরক্ষা ব্যবস্থা নেই। যদিও ইমারত নির্মাণ বিধিমালা ২০০৮ অনুসারে, নতুন ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের দুর্ঘটনা ঘটলে নির্মাণকারী মালিককে সাত বছরের কারাদন্ডের বিধান রয়েছে। তবে এ বিষয়ে সিডিএ (চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ) ব্যাপক উদাসীন।
সিডিএ চেয়ারম্যান প্রকৌশলী নুরুল করিম বলেন, ‘পরিকল্পিত নগরী গড়তে অনুমোদনহীন ও নকশা বহির্ভূত ভবন অপসারণের বিকল্প নেই। এখন থেকে নির্মাণাধীন ভবনগুলো নিয়মিত মনিটরিং করা হবে। যাতে নতুন করে কেউ অনুমোদনহীন বা নকশা বহির্ভূত ভবন তৈরি করতে না পারে।’
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, সিডিএ’র সংশ্লিষ্ট বিভাগের তদারকি না থাকায় নকশা বহির্ভূত বা অনুমোদনহীন ভবন নির্মাণ বেড়ে যাচ্ছে। নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা ছাড়াই নির্মিত হচ্ছে বেশিরভাগ ভবন। অথচ এসব নির্মাণ তদারকি করার দায়িত্ব সিডিএ’র। অসাধু কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় ভ‚মি মালিকরা অপরাধমূলক কাজ করছেন।
সিডিএ’র প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস বলেন, ‘নকশাবহির্ভূতভাবে ছোট-বড় অসংখ্য ভবন নগরীতে নির্মিত হয়েছে। ভুক্তভোগী চাইলে সিডিএতে অভিযোগ করতে পারেন। আমাদের ম্যাজিস্ট্রেট রয়েছে, যারা মামলা করতে পারবে। চেয়ারম্যান মহোদয় এ বিষয়গুলো নিয়ে খুবই শক্ত অবস্থানে আছেন। ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করলে তিনি তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। প্রয়োজনে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে জেল-জরিমানা করা হবে।’
সম্প্রতি মেহেদীবাগ এলাকায় সিডিএ’র নকশা বহির্ভূতভাবে ভবন নির্মাণের অভিযোগ উঠেছিল মঞ্জুর আলম নামে এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে। স্থানীয় বাসিন্দারা অভিযোগ করেন, ১০ তলা ভবনের অনুমতি নিয়ে মঞ্জুর আলম নকশা বহির্ভূতভাবে ভবন নির্মাণ করছেন। শহিদ উল্লাহ নামে একজন বাসিন্দা দাবি করেন, আমাদের যাতায়াতের রাস্তার সীমানা বরাবর মঞ্জুর আলমের স্থাপনা চলে এসেছে। এটি নির্মাণের কোনো আইনি ভিত্তি নেই। ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে নাগরিক অধিকার এবং জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি।
অভিযুক্ত মঞ্জুর আলম বলেন, ‘আমি শারীরিকভাবে অসুস্থ, বাসা থেকে বের হতে পারছি না। ভবনের মালিকদের দেখাশোনা করেন তারা। আমি বিষয়টি সম্পর্কে নিশ্চিত নই।’
নির্মাণ কাজের নিরাপত্তাহীনতা ও নিয়ম-নীতি না মানার ফলে দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়ছে। সিডিএ’র তদারকির উপর জোর দিচ্ছেন ভুক্তভোগীরা। শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে এ বিষয়ে সতর্কতা ফিরিয়ে আনা উচিত বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।