বাতেনের বহুমুখী প্রতারণায় ‘নিঃস্ব’ ওয়াহিদ ফাউন্ডেশন

6

মনিরুল ইসলাম মুন্না

আব্দুল বাতেন, তিনি ওয়াহিদ ইলেকট্রিশিয়ান’স ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশনের স্বঘোষিত চেয়ারম্যান। এর আগে ওয়াহিদ নামে এক ব্যক্তি এ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর স্বাক্ষর জালিয়াতি করে আব্দুল বাতেন বনে যান ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান। এমন অভিযোগ ওয়াহিদ ইলেকট্রিশিয়ান’স ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশনের সদস্যদের। এমনকি সদস্যদের কাছ থেকে নানা অজুহাত ও ছলনার মাধ্যমে হাতিয়ে নিয়েছেন লাখ লাখ টাকা।
এসব বিষয় নিয়ে অনেক সদস্য থানায় সাধারণ ডায়েরি করেছেন। যার তথ্য-প্রমাণ প্রতিবেদকের হাতে আছে।
জানা গেছে, এক সময় ফাউন্ডেশনটির সাধারণ সদস্য ছিলেন তিনি। পরে একাধিক মামলা দিয়ে ফাউন্ডেশনকে জর্জরিত করে রাখেন ১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে। আবার জালালিয়াতির মাধ্যমে কমিটির পাঁচ সদস্যকে বাদ দিয়ে আব্দুল বাতেন নিজে হয়ে যান চেয়ারম্যান। তিনি নিজেকে পরিচয় দেন একই সাথে তিনটি প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ বলে। তিনি কখনও পরিচয় দেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনুসের নিজস্ব লোক বলে।
ফাউন্ডেশনের কয়েকজন সদস্য এবং ভুক্তভোগী কয়েকজনের সাথে কথা বলে জানা যায়, আব্দুল বাতেন একজন প্রতারক, মামলাবাজ এবং ভ‚মিদস্যু। তার প্রতারণার শিকার হয়েছেন অসংখ্য মানুষ। আদম পাচার থেকে শুরু করে সরকারি ট্রেনিং এর নামে সার্টিফিকেট বিতরণ ও অর্থ আত্মসাৎসহ রয়েছে অনেক অভিযোগ। তার প্রতারণা থেকে রেহাই পায়নি আপন ভাই, শ্বশুর, স্ত্রীর বড়ভাইসহ নিকট আত্মীয়রাও। তাছাড়া আব্দুল বাতেনের বেশিরভাগ সময় কাটে আদালত পাড়ায়। বিভিন্ন মানুষকে মামলার ভয় দেখিয়ে টাকা আত্মসাৎ করা তার মূল লক্ষ্য। বিভিন্ন মামলা ও নানা ভয়-ভীতি এবং কাগজপত্র জালিয়াতির মাধ্যমে সম্প্রতি চট্টগ্রামের স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান ওয়াহিদ ইলেকট্রিশিয়ান’স ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান পদ বাগিয়ে নেন।
অবৈধ চেয়ারম্যান হওয়ার পরই ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেড বহদ্দারহাট শাখার দরজায় তালা লাগিয়ে ফাউন্ডেশনের বিপুল পরিমাণ অর্থ নিজের আয়ত্তে আনার নানা অপকৌশল চালান। যার কারণে নিরুপায় হয়ে চান্দগাঁও থানায় জিডি করেন ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। সেই জিডিতেও উঠে আসে আব্দুল বাতেনের চেয়ারম্যান হওয়ার বৈধতার প্রশ্ন।
নগরীর হিলভিউ আবাসিকের বাসিন্দা এবং আব্দুল বাতেনের প্রতিবেশী সমাজসেবক সৈয়দ মো. জামশেদ জানান, আব্দুল বাতেনকে নিয়ে অভিযোগের শেষ নেই। সে একজন প্রতারক। যাকে তাকে প্রতারণার ফাঁদে ফেলে নিঃস্ব করে ছাড়ছে। সে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিভিন্ন নেতা-মন্ত্রীর সাথে আঁতাত করে ক্ষমতার অপব্যবহার করতো। সাধারণ মানুষ থেকে আত্মসাৎ করা টাকা চাইতে আসলে ২০২৩ সালের জানুয়ারির দিকে এলাকা ছেড়ে ঢাকায় পালিয়ে যেতে বাধ্য হয় সপরিবারে। পরবর্তী সময়ে চট্টগ্রামে আত্মগোপনে থেকে চট্টগ্রাম কলেজের সাবেক ছাত্র শাকিল থেকে বিদেশ নেওয়ার কথা বলে হাতিয়ে নেয় এক লক্ষ সত্তর হাজার টাকা। তাছাড়া ওয়াহিদ ইলেকট্রিশিয়ান’স ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশনে এক্সিকিউটিভ কমিটির মেম্বার করবে বলে একাধিক ব্যক্তির কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছে বিপুল পরিমাণ অর্থ।’
তিনি আরও বলেন, ‘আব্দুল বাতেন আমার প্রতিবেশী এবং সম্পর্কে ভাতিজা। তার প্রতারণা থেকে আপন ভাইসহ আত্মীয়-স্বজনরাও রক্ষা পায়নি। এমনকি নিজের শ্বশুরের কোটি টাকারও বেশি হাতিয়ে নিয়েছে।’
তার বিরুদ্ধে থানায় সাধারণ ডায়েরি করা ভুক্তভোগীরা জানান, আব্দুল বাতেন একজন সুদক্ষ প্রতারক। কোর্ট বিল্ডিং এর একাধিক অ্যাডভোকেটও তার বিরুদ্ধে অভিযোগের আঙ্গুল তুলেছেন। ২১টির বেশি একাউন্ট রয়েছে তার। সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নওফেল ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের নাম ব্যবহার করে নিজেই ৫ আগস্ট এর আগে ছাত্র আন্দোলন প্রতিহত করতে বহদ্দারহাটে মেয়র রেজাউল করিমের বাসায় বসে ছক আঁকতেন। আন্দোলনরত ছাত্রদের ওপর হামলার নেপথ্য নায়ক ছিল আব্দুল বাতেন।
ওয়াহিদ ইলেকট্রিশিয়ান’স ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশনের অন্তর্বর্তীকালীন কমিটির সাবেক সদস্য সচিব এম আওলাদ হোসেন বলেন, ‘আব্দুল বাতেন একজন দুর্র্ধর্ষ প্রতারক। তিনি আমার সাথে যে প্রতারণা করছে তার বর্ণনা করা কঠিন! আমাদের মত শিক্ষিত ব্যক্তিদের ঠকাতে পারলে সাধারণ মানুষ কিছুই না। আমার কাছ থেকে সংগঠনের কথা বলে বিভিন্ন সময় টাকা নেন। টাকা চাইতে গেলে তিনি আমাকে মারধরের হুমকি দেন। গতকালও আমি ফাউন্ডেশনের কথা তুললে আমাকে মারধর করে এবং জানে মেরে ফেলার হুমকি দেন। তাই আমি থানায় জিডি করি।
বন্দর থানায় সাধারণ ডায়েরির বিষয়ে তদন্তকারী কর্মকর্তা উপ-পরিদর্শক মো. রাজ্জাকুল ইসলাম রুবেল পূর্বদেশকে বলেন, ‘তার প্রতারণার বিষয়ে থানায় সাধারণ ডায়েরি হয়েছে। তাছাড়া ভুক্তভোগীদের হুমকির বিষয়টি আমরা জেনেছি। আদালতের নির্দেশে তদন্ত করে প্রতিবেদন জমা দিবো।’
চান্দগাঁও থানার সাধারণ ডায়েরির বিষয়ে ওসি মো. আফতাব উদ্দিন বলেন, গতকাল (মঙ্গলবার) রাত ৮টায় আওলাদ হোসেন নামে একজনকে মারধর ও প্রাণনাশের হুমকির ঘটনায় জিডি নিয়েছি। আমরা কোর্ট থেকে অর্ডার পেলেই তদন্ত কাজ শুরু করবো।
এসব বিষয়ে জানতে আব্দুল বাতেনের সাথে যোগাযোগ করার পর তিনি প্রতিবেদকের পরিচয় জানতে চান। পরে পূর্বদেশের নিজস্ব প্রতিবেদক পরিচয় দিয়ে প্রশ্ন করলে তিনি উত্তরে জানান, ‘আমি আপনার সাথে এসব বিষয়ে কথা বলতে চাই না’। এ কথা বলে তিনি ফোন কেটে দেন। এরপর একাধিকবার মুঠোফোনে কল দেওয়া হলেও তিনি কোন সাড়া দেননি।