তুষার দেব
বৃহত্তম পাইকারি পণ্যের বাজার রিয়াজউদ্দিন বাজারসহ নগরীর বিভিন্ন স্থানে ব্যস্ততম বাণিজ্যকেন্দ্র গড়ে তোলা হয়েছে। সময়ের ব্যবধানে বাণিজ্যিক ভবনের পাশাপাশি বেড়েছে দুর্ঘটনার ঝুঁকিও। বাণিজ্যের প্রসার ঘটাতে স্থাপনাগুলো রীতিমত মৃত্যুকূপে পরিণত করা হয়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্যের উত্তরোত্তর প্রসার ঘটলেও স্থাপনাগুলোতে নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত ও দুর্ঘটনার ঝুঁকি হ্রাসের গরজবোধ করেনি কেউ। ফলে দুর্ঘটনা দিনে দিনে অনিবার্য পরিণতি লাভ করেছে।
ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষের সেফটি প্ল্যান অনুযায়ী, নগরীর বাণিজ্যিক স্থাপনাসহ বহুতল ভবনগুলোতে থাকার কথা দুটি পৃথক সিঁড়ি, হাইড্রেন্ট, হোস পাইপ, আন্ডার গ্রাউন্ড ওয়াটার রিজার্ভ, রাইজারসহ অগ্নিনির্বাপনের জরুরি নিরাপত্তা ব্যবস্থা। কিন্তু ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা পরিদর্শনকালে বহুতল ভবনগুলোর মধ্যে নয়শ’ ২৪টিতে এমন নিরাপত্তা ব্যবস্থা না থাকার কারণে সেগুলোকে ঝুঁকিপূর্ণ বা অগ্নিঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকায় রাখা হয়েছে। তাছাড়া বহুতল ভবনগুলো আবাসিক এলাকায় হলে সেগুলোর সার্বিক সুরক্ষিত যোগাযোগ ব্যবস্থার ২০ ফুট প্রশস্ত সড়ক প্রয়োজন। আর বহুতল ভবনগুলো বাণিজ্যিক এলাকায় হলে সড়ক হতে হবে ৩০ ফুট প্রশস্ত। অগ্নিনির্বাপক গাড়ি নিয়ে দমকল কর্মীদের দুর্ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে এমন সড়কের দরকার। কিন্তু নগরীর বেশির ভাগ বহুতল ভবনই গড়ে তোলা হয়েছে এ নির্দেশনা না মেনে। এতে করে অগ্নি-দুর্ঘটনায় ঘটনাস্থলে গিয়ে তা নেভাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের।
চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) ‘চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনে আগুনের ঝুঁকি’ শীর্ষক গবেষণায় দেখা গেছে, গত পাঁচ বছরে দুই হাজার পাঁচশ’ ১৪টি অগ্নিদুর্ঘটনার ৪৭ শতাংশ সংঘটিত হয়েছে আবাসিক এলাকায়। আর বাণিজ্যিক এলাকায় ঘটেছে ২৭ শতাংশ।
বিভাগীয় ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের উপ-সহকারী পরিচালক আবদুর রাজ্জাক বলেন, বহুতল ভবন-মার্কেট কিংবা বস্তি-কলোনি যাই হোক না কেন, আগুন নেভাতে গিয়ে সড়ক থাকায় বিপদে পড়তে হয় আমাদের। বহুতল ভবনের ক্ষেত্রে ফায়ার সার্ভিসের প্রদত্ত সনদে আবাসিক ভবন হলে ২০ ফুট ও বাণিজ্যিক ভবনের ক্ষেত্রে ৩০ ফুট সড়ক রাখার শর্ত দেওয়া হয়। বর্তমানে ফায়ার সার্ভিসের সর্বাধুনিক গাড়িটি ১৭ তলা পর্যন্ত পানি ছিটিয়ে আগুন নেভাতে সক্ষম। বহুতল ভবনে নিরাপত্তার জন্য আলাদাভাবে সেফটি ফায়ার প্ল্যাট বসানোর কথা। কিন্তু সেসব মেনে চলার অভ্যাস এখনও গড়ে ওঠেনি।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের প্রণীত সর্বশেষ তালিকা অনুযায়ী, নগরীর বহদ্দারহাটের হক মার্কেট, স্বজন সুপার মার্কেট, বখতেয়ার মার্কেট, নজু মিয়া হাট মার্কেট, বলিরহাট মার্কেট, ভেড়া মার্কেট, চাক্তাই চালপট্টি, শুঁটকিপট্টি, খাতুনগঞ্জ, আছাদগঞ্জ, মিয়াখান নগর পুরাতন ঝুট মার্কেট, ওমর আলী মার্কেট, পোর্ট মার্কেট, বড়পুল বাজার, ইশান মিস্ত্রি মার্কেট, ফকির হাট মার্কেট, নয়াবাজার মার্কেট, ফইল্ল্যাতলি বাজার, চৌধুরী মার্কেট, রেলওয়ে বস্তি, কলসি দিঘীর পাড় এলাকাধীন কলোনি, আকমল আলী এলাকাধীন কলোনি, চকভিউ সুপার মার্কেট, চকবাজারের কেয়ারি শপিংমল, গুলজার টাওয়ার, মতি কমপ্লেক্স, রিয়াজউদ্দিন বাজার, জহুর হকার মার্কেট, টেরিবাজার, তামাকুমন্ডি লেন, ঝাউতলা বস্তি.আমবাগান বস্তি, সেগুন বাগান বস্তি, কদমতলী রেলওয়ে বস্তি, সিঙ্গাপুর সমবায় সমিতি মার্কেট, কর্ণফুলী মার্কেট, দুই নম্বর গেট রেলওয়ে বস্তি এলাকা, অক্সিজেন রেল লাইন সংলগ্ন বস্তি, বার্মা কলোনি, ড্রাইভার কলোনি, রৌফাবাদ কলোনি ও শেরশাহ কলোনি অগ্নি দুর্ঘটনার অত্যধিক ঝুঁকিতে রয়েছে।
অগ্নি-দুর্ঘটনার অত্যধিক ঝুঁকির তালিকায় থাকা রেয়াজউদ্দিন বাজারের তামাকুমন্ডি লেনে ছোট-বড় একশ’ ৪০টি মার্কেটে প্রায় পাঁচ হাজার দোকান রয়েছে। বেশিরভাগ দোকানে পোশাক-আশাক, প্রসাধনী, কাপড় ও ইলেকট্রনিক্স মালামাল বিক্রি করা হয়। মার্কেটের গলিগুলো এতই সংকীর্ণ যে মানুষের হাঁটা-চলারও সুযোগ নেই। কোথাও দখল করে নেওয়া হয়েছে গলির একাংশ। কোথাও চলাচলের পথেই অবৈধভাবে দোকান তুলে দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি দু’জন মানুষ হাঁটা যায় না- এমন গলিপথও রয়েছে কোনও কোনও মার্কেটে। এসব মার্কেটে কখনো আগুন লাগলে ফায়ার সার্ভিসের অগ্নি-নির্বাপক গাড়ি ও দমকল কর্মীদের প্রবেশ করার সুযোগ নেই। মার্কেট ঘিরে থাকা বৈদ্যুতিক তারগুলো ঝুঁকিপূর্ণভাবে এলোমেলো অবস্থায় রয়েছে। মার্কেটের ওপরের তলার কক্ষগুলো গুদাম এবং আবাসিকের কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। তাছাড়া মার্কেটের ভেতরে বা আশপাশে আগুন নেভানোর মত পানির কোনও উৎস নেই। রাতের বেলা গেটগুলো বন্ধ থাকে। এ কারণে মধ্যরাতে দুর্ঘটনা ঘটলে ভেতর থেকে কোনও মানুষ বেরিয়ে আসারও সুযোগ নেই।
এর আগে চলতি বছরের গত ৮ ফেব্রুয়ারি রাত পৌনে দশটার দিকে ব্যস্ততম রিয়াজউদ্দিন বাজারের আমতল এলাকার এম এইচ চৌধুরী প্লাজা ভবনের পাঁচতলায় আগুন লাগে। যেখানে কয়েকটি তলা মিলে পোশাক বিক্রয় প্রতিষ্ঠান ‘রাজস্থানের’ বিক্রয়কেন্দ্র ও গুদাম রয়েছে। তারও আগে গত ২ ফেব্রুয়ারি নগরীর সবচেয়ে জনবহুল ও ব্যস্ততম জহুর হকার্স মার্কেটের পণ্যের গুদামে অগ্নিকান্ড সংঘটিত হয়েছে। গত বছরের ২২ ফেব্রুয়ারি নগরীর আন্দরকিল্লায় সমবায় মার্কেটে আগুন লেগে এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়। ওই বছরের ১২ জানুয়ারি রিয়াজউদ্দিন বাজারের নুপুর মার্কেটে, ২০২১ সালের ২১ সেপ্টেম্বর একই এলাকার হোটেল সফিনায়, ২০২০ সালে ৩০ আগস্ট চৌধুরী প্লাজায় এবং ২০১৯ সালে ১৯ অক্টোবর জহুর হকার্স মার্কেটে অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছিল।
ফায়ার সার্ভিসের তালিকায় নগরীর শতাধিক মার্কেট অগ্নি-দুর্ঘটনার ঝুঁকিতে রয়েছে। অগ্নি-দুর্ঘটনার ঝুঁকি হ্রাসে কার্যকর পদক্ষেপ না নেয়ার কারণে প্রতি বছরই কোনও না কোনও মার্কেটে অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটছে। এতে সম্পদের পাশাপাশি ঘটেছে প্রাণহানিও। বারবার অগ্নিকান্ডের মতো দুর্ঘটনা ঘটলেও পর্যাপ্ত অগ্নি-নির্বাপক ব্যবস্থা নেই বেশির ভাগ মার্কেটে।
নগরীর অন্তত ৪৫টি মার্কেট ও ১০টি বাজারের বেশিরভাগই গড়ে ওঠেছে অপরিকল্পিতভাবে। এসব বাজারের রাস্তা ও গলিগুলো সরু। ঘনবসতিপূর্ণ হওয়ায় এসব এলাকায় অগ্নিনির্বাপক গাড়ি ও যন্ত্রপাতি নিয়ে দ্রুত পৌঁছানোও কঠিন। এছাড়া উৎস না থাকায় পানিও পাওয়া যায় না।