বাড়ছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ

7

অমল বড়ুয়া

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে পৃথিবী এখন প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে সন্ত্রস্ত। হুমকীর মুখে প্রাণ-প্রকৃতি। বাড়ছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ। ঝুঁকির সম্মুখীন জীবন ও জীবিকা; পরিবেশ ও প্রতিবেশ। ওয়ার্ল্ড মেটিওরোলজিক্যাল অর্গানাইজেশন (ডবিøউএমও)’র তথ্য অনুয়ায়ী, তাপমাত্রা বাড়ছে সাইবেরিয়া থেকে মধ্য এশিয়া, পূর্ব চীন থেকে জাপান পর্যন্ত। জাপানের ইতিহাসে উষ্ণতম বছর ছিল ২০২৩ সাল। একই সঙ্গে এ সময় প্রশান্ত মহাসাগরের উত্তর পশ্চিমাঞ্চল অর্থাৎ এশীয় অংশের তাপমাত্রা ছিল সর্বোচ্চ। গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধির জেরে এশিয়ার হিমালয় পবর্তমালা এবং এই পর্বতমালার হিন্দুকুশ ও তিব্বত রেঞ্জের ২২টি হিমবাহের মধ্যে অন্তত ২০টির বরফের মজুত ২০২৩ সালে ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে। তাপমাত্রা বৃদ্ধির পাশাপাশি জলসৃষ্ট দুর্যোগও মোকাবিলা করতে হচ্ছে এশিয়াসহ বিশ্বকে। ২০২৩ সালে এশিয়ায় বড় আকারের ঝড়, বন্যা ও তুমুল বর্ষণের ঘটনা ঘটেছে অন্তত ৭৯টি। এতে প্রাণ হারিয়েছেন ২ হাজারেরও বেশি মানুষ এবং সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন অন্তত ৯০ লাখ মানুষ। জাতিসংঘ বলছে, ইউরোপজুড়ে যে দাবদাহ চলছে তা আরও রেকর্ড ভাঙবে। আবহাওয়া ও মহাসাগরের আচরণ দিনদিন জটিল আকার ধারণ করছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বিশ্বজুড়ে নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঘটনাও বেড়েছে। প্রাণহানির পাশাপাশি আর্থিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও বাড়ছে সমানতালে। ২০২২ সালে বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে ২৬০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। প্রাণহানির বিবেচনায় ২০২২ সালের শীর্ষ প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছিল বন্যা। পাকিস্তান, নাইজেরিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, ব্রাজিল ও ভারতে বন্যায় ৩ হাজারের মতো মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। এর বাইরে আফগানিস্তান ও ইন্দোনেশিয়ার ভূমিকম্প এবং পূর্ব আফ্রিকার দেশগুলোতে খরার কারণে প্রাণ হারিয়েছেন আরও কয়েক হাজার। ২০২২ সালে সংঘটিত বড় ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলোর মধ্যে একটি হলো পাকিস্তানের বন্যা। প্রাণহানির দিক বিবেচনায় জুন মাস থেকে অক্টোবর পর্যন্ত চলা এ বন্যাই সবার ওপরে। প্রায় ৫ মাসব্যাপী এ বন্যায় ১ হাজার ৭৩৯ জন প্রাণ হারিয়েছেন। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশটির প্রায় ৩ কোটি ৩০ লাখ মানুষ। পানিতে তলিয়ে গেছে ১৭ লাখ বাড়িঘর। এ বন্যায় আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ১ হাজার ৮০০ কোটি ডলার। এ বন্যা দেশটির অর্থনীতির মেরুদন্ডই ভেঙে দিয়েছে বলা চলে। ২০২২ সালে আফগানিস্তানে বন্যায় ১৮২ জন মানুষ মারা যায়।
আফ্রিকার দেশ নাইজেরিয়ায় প্রায় ৬ মাসব্যাপী এক বন্যায় প্রাণ হারান ৬১২ জন। এতে দেশটির ১৪ লাখ মানুষ অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হয়। দক্ষিণ আফ্রিকার বন্যায় ৪৬১ জন মারা যান। ২০২২ সালে মার্চ- এপ্রিলে পেট্রাপোলিসে বন্যায় ২৩৩ জনের মৃত্যু হয়। প‚র্ব আফ্রিকার অধিকাংশ এলাকায় ব্যাপক খরা দেখা দেয় ২০২২ সালে; জাতিসংঘ এ খরাকে বিগত ৪০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে ভয়বাহ বলে আখ্যা দিয়েছে। ওই খরায় কেবল উত্তর-পূর্ব উগান্ডায় অন্তত ২০০ জনের মৃত্যু হয়েছে খাবারের অভাবে। ২০২২ সালের ২১ নভেম্বর ইন্দোনেশিয়ার সিয়াঞ্জুরে আঘাত হানে ৫ দশমিক ৬ মাত্রার ভ‚মিকম্প। ওই ভ‚মিকম্পে অন্তত ৩৩৪ জন প্রাণ হারান। ২০২২ সালে আফগানিস্তানে ভ‚মিকম্পে ১ হাজারের বেশি মানুষ মারা যায়।
বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা-ডব্লিউএমও-এর মতে, ২০২৩ সালে এশিয়ায় হাইড্রো-মেটিওরোলজিক্যাল ইভেন্টের সঙ্গে যুক্ত ৭৯টি বিপর্যয়ের খবর পাওয়া গেছে। তার মধ্যে ৮০ শতাংশের বেশি ক্ষেত্রে হয়েছে বন্যা ও ঝড়। যাতে দুই হাজারের বেশি মানুষ মারা গেছে। পানির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যেমন: বন্যা, খরা, তাপদাহ, অতিবৃষ্টি, ঘুর্ণিঝড়, আকস্মিক বন্যা, ঝড়, অতিরিক্ত তুষারপাতকে হাইড্রো-মেটিওরোলজিক্যাল ইভেন্ট বলে। জাতিসংঘের দুর্যোগের ঝুঁকি হ্রাসকরণ দপ্তরের এশিয়া ও প্রশান্ত অঞ্চলের তথ্যমতে, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বজুড়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ৪০ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। জাতিসংঘের বৈশ্বিক আবহাওয়া ও জলবায়ু নিরাপত্তা বিষয়ক সংস্থা ওয়ার্ল্ড মেটেরোলজিক্যাল অর্গানাইজেশনের (ডব্লিউএমও) এক প্রতিবেদনমতে, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিভিন্ন দুর্যোগের কারণে ২০২৩ সালে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এশিয়া মহাদেশভুক্ত দেশগুলো। ডব্লিউএমও’র মতে, অন্যান্য মহাদেশের চেয়ে এশিয়ায় বৈশ্বিক উষ্ণায়নের প্রভাব পড়েছে বেশি। এ কারণে এই মহাদেশের তাপমাত্রাও বাড়ছে। ১৯৯১ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে এশিয়ার গড় তাপমাত্রা বেড়েছে ১ দশমিক ৮৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এমনকি ২০২০ সালের তুলনায় গত বছর এশিয়ার গড় তাপমাত্রা ছিল দশমিক ৯১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি। ২০১৫ সালে দুর্যোগ ঝুঁকি কমানোর জন্য বিশ্বব্যাপী সেন্দাই ফ্রেমওয়ার্ক ফর ডিজাস্টার রিস্ক রিডাকশন চুক্তি করা হয়। সেন্দাই ফ্রেমওয়ার্ক ফর ডিজাস্টার রিস্ক রিডাকশন’ একটি বৈশ্বিক চুক্তি, যা এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোকে দুর্যোগ পরিকল্পনা, মোকাবিলা ও পুনর্বাসনে সহায়তার উদ্দেশ্যে করা হয়েছিল। কিন্তু তাদের সেই পদক্ষেপেও আশানুরূপ ফলাফল আসেনি।
নরওয়েভিত্তিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ডিসপ্লেসমেন্ট মনিটরিং সেন্টার (আইডিএমসি) থেকে প্রকাশ করা বৈশ্বিক অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুত প্রতিবেদন-২০২৪-এর তথ্যমতে, প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে মোট বাস্তুচ্যুত হয়েছে ২ কোটি ৬৪ লাখ মানুষ। দুর্যোগে চীনে গত বছর ৪৭ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে, যা সর্বোচ্চ। ওই তালিকায় চীনের পরে রয়েছে তুরস্কের নাম। দেশটিতে ভূমিকম্পের কারণে ৪০ লাখ ৫৩ হাজার মানুষ, ফিলিপাইনে বন্যা ও ঘ‚র্ণিঝড়ের কারণে প্রায় ২৬ লাখ এবং সোমালিয়ায় ২০ লাখ ৪৩ হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছে। এসব মানুষের বড় অংশ অস্থায়ীভাবে বাস্তুচ্যুত হয়ে আর্থিকভাবে ক্ষতির মুখে পড়েছে। এর পরের অবস্থানেই রয়েছে বাংলাদেশ। প্রতিবেদনমতে, ২০২৩ সালের ১৪ মে এশিয়ায় সবচেয়ে শক্তিশালী ঘ‚র্ণিঝড় ‘মোখা’ বাংলাদেশ ও মায়ানমারের উপক‚লে আঘাত হানে। ওই ঝড়ে শুধু বাংলাদেশে ১৩ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়। এতে মায়ানমারের ৯ লাখ ১২ হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়। একক দুর্যোগ হিসেবে ঘ‚র্ণিঝড় মোখা এবং তুরস্কের ভূমিকম্পে সবচেয়ে বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিজ্ঞানীদের শঙ্কা, একইভাবে ২০২৪ সালে নানা ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখোমুখি হবে বিশ্ব।
ওয়ার্ল্ড ক্লাইমেট রিস্ক ইনডেক্স’র সর্বশেষ তথ্যমতে, পৃথিবীর যেসব দেশ সবচেয়ে বেশি জলবায়ু ঝুঁকিতে আছে, তার মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষ দশে। গ্রান্থাম রিসার্চ ইন্সটিটিউট অন ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড দ্য এনভায়রমেন্ট ও সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ ইকোনমিক্স অ্যান্ড পলিসির সমীক্ষামতে- বাংলাদেশের ৬০ শতাংশ মানুষ বন্যার উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে। এছাড়া ১৯৭১ থেকে ২০১৪ সাল অর্থাৎ ৪৩ বছরে হওয়া ৭৮টি বন্যায় ৪১ হাজার ৭৮৩ জন মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। আর এতে অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে ১২ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারের। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (এডিবি) প্রতিবেদনমতে- কেবল ২০১৪ সালের বন্যায় অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ দুই দশমিক দুই বিলিয়ন ডলার, যা দেশের মোট জিডিপির প্রায় দেড় শতাংশ। একই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে- ‌২০২২ সালের বন্যায় সাত দশমিক তিন মিলিয়ন মানুষ এবং এক বিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হয়েছে। ২০২৪ সালের আগষ্টে বাংলাদেশে ভয়াবহ বন্যা দেখা দেয়। এই বন্যায় আক্রান্ত হয়েছে ১১টি জেলার ৭৭টি উপজেলা। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, এই বন্যায় পানিবন্দী পরিবারের সংখ্যা মোট ৯ লাখ ৪৪ হাজার ৫৪৮। ক্ষতিগ্রস্ত লোকের সংখ্যা ৪৯ লাখ ৩৮ হাজার ১৬৯ জন।
প্রাকৃতিক দুর্যোগজনিত বিপর্যয়ের ঝুঁকি ও ক্ষতি মোকাবিলার পরিকল্পনা হিসাবে বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় ১৪টি জলবায়ু ঝুঁকি চিহ্নিত করে দীর্ঘমেয়াদে সমন্বিতভাবে ‘জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা’ (ন্যাপ) গ্রহণ করে সরকার। তারপরও ঝুঁকি ও ক্ষতি মোকাবিলার সক্ষমতা এখনো গড়ে ওঠেনি। দুর্যোগের ঝুঁকি মোকাবিলায় দরকার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া। এর মধ্যে দুর্যোগের ঝুঁকি কমানো ও ঘুরে দাঁড়ানোর সক্ষমতা বাড়াতে টেকসই ও প্রত্যাশিত অর্থায়ন নিশ্চিত করা, অন্তর্ভূক্তিমূলক পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন, স্থানীয় পর্যায়ে দুর্যোগ ঝুঁকি কমাতে সমন্বয় এবং আগাম সতর্কীকরণ ব্যবস্থা জোরদার; আশ্রয়ণ ও পুনর্বাসনে প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামো গড়ে তোলা, নদীশাসন ও পরিবেশ দূষণরোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ অতীব গুরুত্বপূর্ণ।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট