নিজস্ব প্রতিবেদক
আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতায় শৈথিল্যের সুযোগে খুনোখুনির ঘটনা বেড়েই চলেছে। প্রায় প্রতিদিনই নগরী বা জেলার কোথাও না কোথাও খুনের ঘটনা ঘটছে। মাত্র এক সপ্তাহের ব্যবধানে পৃথক ঘটনায় নগরী ও জেলায় এক নারীসহ নয়জন হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছেন। রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতার পাশাপাশি পারিবারিক বিরোধের জেরেও হত্যাকান্ড সংঘটিত হচ্ছে। এসব ঘটনায় থানায় মামলা হলেও জড়িতদের গ্রেপ্তারে পুলিশের কোন তৎপরতা এখন পর্যন্ত পরিলক্ষিত হয়নি।
নবনিযুক্ত জেলা পুলিশ সুপার রায়হান উদ্দিন খান বলছেন, প্রতিটি হত্যার ঘটনা নিয়ে থানায় মামলা রেকর্ড হয়েছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে জেলার থানাগুলোতে পুনর্গঠন প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। শিগগির প্রতিটি হত্যাকান্ডের তদন্ত কার্যক্রম পুরোদমে শুরু হবে। হত্যায় জড়িত সকলকে অবশ্যই আইনের আওতায় আনা হবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ক্ষমতার পট পরিবর্তনের পর আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতায় শৈথিল্যের সুযোগে অন্যান্য অপরাধের পাশাপাশি অনেকে খুনোখুনির মত ভয়ঙ্কর অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন। সর্বশেষ গত ৩ সেপ্টেম্বর জেলার দক্ষিণ ফটিকছড়ির জাফতনগর ইউনিয়নের আট নম্বর ওয়ার্ডে তেলপারই (তকিরহাটের পশ্চিমে) ছমদ বাড়িতে পারিবারিক কলহের জের ধরে প্রতিপক্ষের হামলায় জাহাঙ্গীর ও আলমগীর নামে দুই ভাই নিহত হয়েছেন। নিহত দুজন ওই এলাকার মোহাম্মদ ইসলামের পুত্র।
স্থানীয়রা জানান, পারিবারিক কলহের জের ধরে চার ভাই করিম, রাসেল, জাহাঙ্গীর ও আলমগীর একসাথে বিদেশ থেকে আসেন। ঘটনার দিন করিম তার স্ত্রী ও মেয়েকে মারধর করেন। এ সময় স্থানীয় কয়েকজন এসে বাধা দিলে তাদেরও মারধর করা হয়। পরবর্তীতে তারা এলাকাবাসীর সাথে হানাহানিতে জড়িয়ে পড়েন। এক পর্যায়ে প্রতিপক্ষের হামলায় জাহাঙ্গীর ও আলমগীর নামে দুই ভাই নিহত হন। আহত হন সাহাবুদ্দিন, বাচ্চু ও বোরহানসহ অন্তত ছয়জন।
দুই সহোদর হত্যাকান্ডের আগের দিন গত ২ সেপ্টেম্বর বাঁশখালীতে ঘটে জোড়া খুনের ঘটনা। ওইদিন উপজেলার গন্ডামারা এলাকায় এসএস পাওয়ার প্ল্যান্টে চুরি ঠেকাতে গিয়ে ছুরিকাঘাতে দুই নিরাপত্তাকর্মী নিহত হন। নিহতরা হলেন সারওয়ার আলম (৫১) ও রাশেদ জোয়ার্দার (২২)। হামলার সময় রাত তিনটার দিকে তারা নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করছিলেন।
সারওয়ার আলমের বাড়ি ফরিদপুরের নগরকান্দা উপজেলার তালমা গ্রামে আর রাশেদ জোয়ার্দারের বাড়ি রাজবাড়ির পাংশা উপজেলায়। নিহত সারওয়ার আলম কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির সিকিউরিটি ইনচার্জ ছিলেন।
জানা গেছে, দুই যুবক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি থেকে চুরি করে পালানোর চেষ্টা করলে তাদেরকে বাধা দেন নিরাপত্তাকর্মীরা। এ সময় দুই গার্ডকে ছুরিকাঘাত করা হয়। গুরুতর আহত অবস্থায় দুই নিরাপত্তাকর্মীকে উদ্ধার করে বাঁশখালী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাদের মৃত ঘোষণা করেন।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্র জানায়, গত ৩১ আগস্ট মধ্যরাতে মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চলে এস কিউ নামের বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম তৈরির নির্মাণাধীন একটি কারখানার সামনে ডাকাত সন্দেহে গণপিটুনিতে মো. রফিক নামের ইউনিয়ন বিএনপির এক নেতা নিহত হন। তিনি উপজেলার সাহেরখালী ইউনিয়নের কাজীর তালুক এলাকার মৃত তাজুল ইসলামের ছেলে। সাবেক ইউপি সদস্য মো. রফিক সাহেরখালী ইউনিয়ন বিএনপির যুগ্ম আহব্বায়ক ছিলেন। এ ঘটনায় আরও সাতজন আহত হন। বিক্ষুব্ধ লোকজন ওই বিএনপি নেতা ও তার সহযোগীদের বহন করা তিনটি অটোরিকশা জ্বালিয়ে দেন।
তবে বিএনপি নেতাদের দাবি, ডাকাতির নাটক সাজিয়ে পরিকল্পিতভাবে রফিককে হত্যা করা হয়েছে। এ ঘটনার দুদিন আগে ঘটে চাঞ্চল্যকর জোড়া খুনের ঘটনা। গত ২৯ আগস্ট রাত আটটার দিকে নগরীর অক্সিজেন-কুয়াইশ সড়কের নাহার কমিউনিটি সেন্টার এলাকায় মো. আনিস এবং হাটহাজারী উপজেলার পশ্চিম কুয়াইশ এলাকায় মাসুদ কায়সারকে গুলি ও কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। তারা দু’জনই স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের কর্মী এবং হাটহাজারী উপজেলা পরিষদের সদ্য সাবেক চেয়ারম্যান ইউনুচ গণির অনুসারী হিসেবে এলাকায় পরিচিত।
নিহতদের পরিবারের দাবি, রাজনৈতিক আধিপত্য নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে প্রতিপক্ষের হাতে তাদেরকে নির্মমভাবে খুনের শিকার হতে হয়েছে। চাঞ্চল্যকর এই জোড়া খুনের ঘটনায় নগরীর বায়েজিদ বোস্তামী ও জেলার হাটহাজারী থানায় পৃথক দুটি হত্যা মামলা দায়ের হয়েছে। এসব মামলায় দলীয় প্রতিপক্ষের বেশ কয়েকজন নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়েছে। বায়েজিদ-কুয়াইশ সংযোগ সড়কের নাহার গার্ডেনের সামনে গুলিতে আওয়ামী লীগ নেতা মো. আনিস নিহতের ঘটনায় তার স্ত্রী শামীমা আক্তার বাদী হয়ে বায়েজিদ বোস্তামী থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। এতে এজাহারনামীয় চারজন জনসহ অজ্ঞাতনামা আরও তিন-চার জনকে আসামি করা হয়েছে। এর আগে হাটহাজারীর কুয়াইশ-বুড়িশ্চর এলাকায় যুবলীগ কর্মী মাসুদ কায়সার খুনের ঘটনায় তার ছোট ভাই বাদী হয়ে হাটহাজারী থানায় অপর একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলায় ছয় জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত আরও আট-দশজনকে আসামি করা হয়েছে।
এর আগে গত ২৮ আগস্ট জেলার রাউজান থেকে আবদুল মান্নান নামে এক শ্রমিকলীগ নেতার মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। ওইদিন দুপুর আড়াইটার দিকে রাউজান পৌরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ডের রহমতপাড়া সড়ক থেকে শ্রমিক লীগ নেতার মরদেহটি উদ্ধার করা হয়। নিহত মান্নান রাঙামাটির রাঙামাটি পার্বত্য জেলার বেতবুনিয়া ইউনিয়ন শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তিনি রাঙামাটির কাউখালী উপজেলার বেতবুনিয়া ইউনিয়নের তিন নম্বর ওয়ার্ডেও বাসিন্দা কবির আহমেদের ছেলে।
স্থানীয় সূত্রগুলো জানিয়েছে, নিহত আবদুল মান্নান বালু ও কংক্রিটের ব্যবসা করতেন। রাজনীতি ও ব্যবসা নিয়ে এলাকায় প্রতিপক্ষের সাথে তার দ্ব›দ্ব ছিল। পূর্ব বিরোধের জেরেই রাঙ্গামাটির বেতবুনিয়া থেকে ধাওয়া করা হয় মান্নানকে। প্রায় দশ কিলোমিটার ধাওয়া করে রাউজানে এনে তাকে পিটিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। একইদিন দুপুর সাড়ে বারোটার দিকে নগরীর পতেঙ্গা থানার চরপাড়া এলাকার সৈকত থেকে অজ্ঞাত এক নারীর মরদেহ উদ্ধার করা হয়।
পুলিশ জানায়, চরপাড়ায় সৈকতে পাথরের ব্লকে আটকে ছিল মরদেহটি। স্থানীয় লোকজনের কাছ থেকে খবর পেয়ে লাশটি উদ্ধার কওে পুলিশ। ওই নারীর বয়স আনুমানিক ২৮ বছর। তার পরনে সালোয়ার কামিজ ছিল। নিহত নারীর বাম চোখে ও হাতে গুরুতর জখমের চিহ্ন আছে। তাই পুলিশের ধারণা, তাকে আগের রাতে কেউ হত্যা করে মরদেহ সৈকতে ফেলে গেছে। নিহত ওই নারীর পরিচয় শনাক্তে সিআইডির ফরেনসিক বিভাগের একটি টিম আঙ্গুলের ছাপ সংগ্রহ করেছে। এখন পর্যন্ত তার পরিচয়ের কোনও কিনারা হয়নি।