এম এ হোসাইন
শহরের ব্যস্ততম বাজারগুলো এখন ভেজাল ও মানহীন পণ্যের অদৃশ্য মেঘে আচ্ছন্ন। খাদ্যদ্রব্য থেকে শুরু করে প্রসাধনী, কসমেটিকস, ইলেকট্রনিক, এমনকি ওষুধ পর্যন্ত নকল ও নিম্নমানের পণ্য ভোক্তাদের হাতে পৌঁছাতে দেখা যাচ্ছে।
এর সরাসরি প্রতিক্রিয়া হচ্ছে, খাদ্যজনিত অসুস্থতা, ত্বক-সংশ্লিষ্ট জটিলতা, ওষুধের কার্যকারিতাহীনতা ও দীর্ঘমেয়াদে ক্রনিক রোগের ঝুঁকি বেড়ে যাওয়া। আর পরোক্ষভাবে এটি স্থানীয় উদ্যোক্তা ও বিশুদ্ধ ব্যবসার আস্থা কেড়ে নেয় এবং বাণিজ্যিক বিশ্বাসযোগ্যতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। যদিও শুধু সমন্বয় জোরদার করা গেলেই মানহীন পণ্যের বাজার বিলুপ্ত হতে বাধ্য, এমনটা মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বাজারে ভেজাল ও মানহীন পণ্যের প্রভাব ঘটাচ্ছে সংঘবদ্ধ কিছু চক্র। হাতে গোনা কয়েকটি চক্রের হাতেই রয়েছে পুরো নিয়ন্ত্রণ। চক্রটি প্রথমত, কাঁচামালের মিশ্রণ বা কৃত্রিম উপাদান দিয়ে মসলা, দুধ, ঘি ও কোমল পানীয়র মানহীন সংস্করণ তৈরি করে। দ্বিতীয়ত, নামি ব্র্যান্ডের নাম বা অনুরূপ প্যাকেজিং ব্যবহার করে সাব-স্ট্যান্ডার্ড প্রসাধনী ও কসমেটিকস সস্তায় বিক্রি করে। তৃতীয়ত, সীমাহীনভাবে সেলেরিং করে ইলেকট্রনিক সামগ্রীর অনুপযুক্ত এবং বিপজ্জনক মডেল বাজারে ছড়িয়ে দেয়।
বিএসটিআই চট্টগ্রাম আঞ্চলিক কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানী বলেন, এবার মান দিবসের প্রতিপাদ্যতেও সমন্বয়ের কথা বলা হয়েছে। মানকে উন্নত করতে চাইলে এককভাবে সেটা সম্ভব হবে না। সমন্বিতভাবে আমাদের কাজ করতে হবে। বিএসটিআই মান সম্পন্ন পণ্য বাজারে দিল, সে পণ্য উন্নত বিশ্বে পৌঁছানোর জন্য সরকারের উদ্যোগ নিতে হবে। যার যার জায়গা থেকে আমরা যখন কাজ করবো, তখন মানহীনতার আর প্রশ্ন থাকবে না।
তিনি বলেন, আমরা তদারকিতে আছি, প্রতিনিয়ত মোবাইল কোর্ট করছি। সবার সহযোগিতা বাড়াতে হবে। কোথাও অবৈধ কার্যক্রম দেখলে আমাদের অবহিত করতে হবে। দিন দিন পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। সবাই সচেতন হলে আরও উন্নতি হবে।
চট্টগ্রামের ভোক্তা অধিকার ও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সবচেয়ে উদ্বেগজনক দিক হলো ওষুধের নকলতা। নকল ওষুধ গ্রহণ করলে রোগ নিরাময় ব্যাহত হয়, অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে এবং রোগীদের জরুরি চিকিৎসায় ব্যর্থতা ঘটতে পারে। এছাড়া ত্বক-সংশ্লিষ্ট কসমেটিকস এ ব্যবহৃত বিষক্রিয়াশীল রাসায়নিক দেহে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব রেখে অঙ্গহানির কারণ হতে পারে। রোগীর কাছে দ্রুত ও কার্যকর প্রতিকার না গিয়ে হাসপাতাল ও ক্লিনিকের উপর চাপ বেড়ে যায়। ফলে স্বাস্থ্যব্যবস্থার অর্থনৈতিক ভারও বাড়ে। মানহীন পণ্যের বিস্তার শুধু স্বাস্থ্য নয়, অর্থনীতিকেও ক্ষতিগ্রস্ত করছে। বাজারে মানহীন পণ্যের দাপটে সৎ ব্যবসায়ীরা রাজস্ব হারাচ্ছেন, স্থানীয় উৎপাদকদের বিক্রি কমছে এবং বিনিয়োগকারীদের আস্থা নষ্ট হচ্ছে।
চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মানহীন পণ্য ও ভেজালের কারণে প্রতি বছর শুধুমাত্র খাদ্যখাতেই ৩০০ কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে। তাছাড়া ভোক্তার স্বাস্থ্যখরচ ও ভবিষ্যৎ চিকিৎসা-ভার বেড়ে যায়। ফলে সামগ্রিক অর্থনীতিও নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-ক্যাব সহসভাপতি এসএম নাজের হোসাইন বলেন, পণ্যের মান দেখার দায়িত্বে রয়েছে বিএসটিআই। পণ্যের মান ঠিক আছে কিনা সেটা পরীক্ষা করে মান সনদ দেয় প্রতিষ্ঠানটি। তবে বাজারে ছড়িয়ে থাকা মানহীন পণ্য চিহ্নিত বা বাতিল করতে তেমন কোনো পদক্ষেপ তাদের দেখা যায় না। আবার নানা ধরনের সমস্যাও আছে। লোকবলের অভাব, ম্যাজিস্ট্রেট না থাকা, সমন্বয়হীনতা এসব কারণও যুক্ত আছে। সৎ ইচ্ছে থাকতে হবে, তখন সংকুলতার মধ্যেও অনেক কিছু অর্জন করা সম্ভব হয়।
মানহীন পণ্যের তদারকির ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ। স্থানীয় পর্যায়ে বিএসটিআই, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর, জেলা প্রশাসন ও সিটি কর্পোরেশনের মাঠপর্যায়ে নিয়মিত তদারকি থাকলেও মানহীন পণ্যের ব্যাপারে যেন উদাসীন। যথেষ্ট পরীক্ষাগার না থাক, আইনগত প্রক্রিয়া নিতে দীর্ঘ সূত্রিতায় পরিস্থিতি আরো খারাপ হচ্ছে।
এ অবস্থার মধ্যে আজ মঙ্গলবার দেশে পালিত হবে বিশ্ব মান দিবস। ভোক্তা সংগঠনের মতে, সময় এসেছে দেশের মান নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণভাবে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে রূপান্তর করার। তাদের প্রস্তাব, প্রথমত, একটি আধুনিক ও শক্তিশালী ল্যাব নেটওয়ার্ক গড়ে তুলে অনলাইন রিপোর্টিং সিস্টেম চালু করতে হবে, যাতে পণ্যের মান যাচাই দ্রুত ও নির্ভরযোগ্যভাবে সম্পন্ন হয়। দ্বিতীয়ত, প্রতিটি পণ্যের প্যাকেজে কিউআর কোড বাধ্যতামূলক করা উচিত, যাতে ক্রেতারা মোবাইল স্ক্যানের মাধ্যমে সহজেই উৎপাদনের তারিখ, পরীক্ষার ফল ও অনুমোদনের তথ্য যাচাই করতে পারেন। তৃতীয়ত, হঠাৎ মোবাইল কোর্ট ও অভিযানের সংখ্যা বাড়াতে হবে, বিশেষ করে যেসব বাজার ‘হাই-রিস্ক জোন’ হিসেবে পরিচিত সেখানে নিয়মিত নজরদারি প্রয়োজন। চতুর্থত, ভোক্তা শিক্ষায় বিনিয়োগ বাড়াতে হবে, স্কুল-কলেজ পর্যায়ে এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ‘মান সচেতনতা কর্মসূচি’ চালু করা গেলে দীর্ঘমেয়াদে সাধারণ মানুষ নিজেরাই মানহীন ও ভেজাল পণ্য বর্জনে সচেতন হয়ে উঠবেন।











