বাঙালি মুসলমানের নবজাগরণের পথিকৃৎ মশুরীখোলার হযরত কেবলা শাহ আহসানুল্লাহ (রহ.)

2

ইমরান হুসাইন তুষার

তের থেকে আঠারো শতকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত বাংলাদেশ তুর্কি, স্বাধীন সুলতানি, মুঘল সুবাদারি ও নবাবি শাসনের অধীন ছিল। রাষ্ট্র ও অর্থনীতির প্রভাবে মধ্যযুগে বাংলার সমাজ ও সংস্কৃতি নির্মিত হয়েছিল। বাংলার মধ্যযুগের ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন হয়েছে। আর এক্ষেত্রে বাঙালি মুসমানের প্রভাব ব্যাপক। মধ্যযুগে মুসলিম শাসনামলে ইসলাম প্রচার, চরিত্র গঠন, আত্মার উৎকর্ষ সাধন, মানব কল্যাণে কাজ করা ইত্যাদি আদর্শকে সম্মুখে নিয়ে সুফিসাধকগণ। বাংলার প্রতিটি আনাচে-কানাচে তাদের প্রতিষ্ঠিত ‘খানকা’ গুলো আধ্যাত্মিক, মানব কল্যাণ ও বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তার প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। ক্রমে তারা বাংলার লোকায়ত সংস্কৃতি ও ধর্মীয় চিন্তাকে সমন্বিত করে সুফিরা। আর এ প্রভাব শুধুমাত্র শাসন ক্ষেত্রেই নয় সমাজজীবনেও স্থায়ী আসন লাভ করেছিল। কিন্তু ঔপনিবেশিক আমলে চিত্র সম্পূর্ণ রূপে পাল্টে যায়। সুফিরা শুধু নয় বাঙালি মুসলমানরা হয়ে পরে পশ্চাৎপদ। সমাজ, রাষ্ট্রে বাঙালি মুসলাম হয়ে পরে গৌণ। এর পিছনে শিক্ষা, সংস্কৃতি, রাজনীতি, অর্থনীতির অংশগ্রহণে অনিহা এবং রাষ্ট্রীয় ষড়যন্ত্র ছিল। এজন্য মুসলমানদের রাজনীতি সচেতনা, আধুনিক শিক্ষাসহ আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন অপরিহার্য হয়ে দাড়াঁয়। এক দিকে পরাক্রমশালী সাম্রাজ্যবাদী শক্তির হাত থেকে উপমহাদেশের আযাদী। অপর দিকে শিক্ষা, সংস্কৃতি, রাজনীতি, অর্থনীতিতে পিছিয়ে থাকা বাঙালি মুসলমানের অবস্থার পরিবর্তন। এই দুই বিষয়কে সমানভাবে প্রাধান্য দিয়ে ঔপনিবেশিক আমলে বাঙালি মুসলমানের নবজাগরণের পথিকৃৎদের মধ্যে অন্যতম হলেন, ঢাকার ঐতিহ্যবাহী মশুরীখোলা দরবার শরীফের প্রতিষ্ঠাতা হযরত কেবলা শাহ মুহাম্মদ আহসানুল্লাহ (রহ.)।
তিনি একজন আধ্যাত্মিক সাধক এবং দ্বীনের নিরলস খাদেম। ঔপনিবেশিক আমলে সর্বমহলে গ্রহণযোগ্য এক প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব। সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে রেখে গেছেন অনন্য কৃতিত্বের ছাপ। অত্যান্ত সাদামাটা জীবন-যাপনে অভ্যস্ত ছিলেন। আপাদমস্তক একজন জনহিতৈষী। তিনি রাজনীতি না করলেও এ ক্ষেত্রে ছিলেন সচেতন ও দূরদর্শী। হযরত কেবলা শাহ আহসানুল্লাহ (রহ.) এই বঙ্গের মুসলমানদের ইতিহাস ঐতিহ্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ। গত দুই শতাব্দিকাল জুড়ে তাঁর উত্তরসূরিদের ইসলাম ও মানবতার কল্যাণে নিরবিচ্ছিন্ন খেদমত বিস্তৃত।
বাংলা ত্রয়োদশ শতাব্দীর মহান মুজাদ্দিদ তথা সংস্কারক (জুমার নামাজ পুন:প্রতিষ্ঠাকারী), খলিফাতুর রসুল, ইসলামের প্রথম খলিফা, হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.)’র বংশধর হযরত কেবলা শাহ মুহাম্মদ আহসানুল্লাহ রহমাতুল্লাহি আলাইহি। এ মহান সাধক পুরুষ ১৭৯৮ খ্রিস্টাব্দে মাওলানা শাহ্ নূর মুহাম্মদ রহ.’র ঘরে আড়াইহাজার থানার টেটিয়া নামক একটি ছোট্ট গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পূর্বপুরুষ ছিলেন হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদ্বি.’র বংশধর বিশিষ্ট ধর্মপ্রচারক হজরত নাওজাওয়ান (রহ.)। যিনি হযরত বাবা আদম শহীদ (রহ.)’র অন্তরঙ্গ বন্ধু। ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে তিনি সুদূর আরব হতে ভারত হয়ে এ বালায় আগমন করেন। হযরত কেবলা ছিলেন এ বংশের উজ্জ্বল নক্ষত্রতূল্য আধ্যাত্মিক মহাপুরুষ। তিনি ভারতের আল্লামা নিজাম উদ্দিন সুজাতপুরী (রহ.)’র নিকট হতে তাফসির ও হাদিস শাস্ত্রে বুৎপত্তি অর্জন করেন। মাত্র ১২ বছর বয়স হতে তাহাজ্জুতের নামাজ পড়া শুরু মধ্যে দিয়ে আধ্যাত্মিক উন্নয়নে আত্মনিয়োগ করেন। প্রথম ১৪ বছর মীরপুর হযরত সৈয়দ শাহ্ আলী বোগদাদী (রহ.)’র মাযার শরীফে, ৩ বছর নারায়ণগঞ্জ শাহী কেল্লা মসজিদ সংলগ্ন মাযারে এবং ১ বছর লালবাগ প্রিন্স আযম কেল্লা মসজিদ সংলগ্ন সুড়ঙ্গে রিয়াজত (চিল্লাকুশি) করেন। দুধু মিয়ার অনুসারীদের অপতৎপরতায় এই দেশে জুমার নামাজ বন্ধ হয়ে যায়। হযরত কেবলার প্রচেষ্টায় ১৮৯০ সালে ঐতিহাসিক বাহাসের মধ্যে দিয়ে আবার জুমার নামাজ পুনঃপ্রচলন শুরু হয়। তিনি ১৮৩৮ সালে হযরত সৈয়দ কলিম শাহ্ বোগদাদী (রহ.)’র নিকট হতে বায়াত ও হেকেমী (চিকিৎসা শাস্ত্র)’র দীক্ষা গ্রহণ করেন। ১৮৫৮-১৮৭০ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ১২ বছর তাসাউফের কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে বেলায়েত প্রাপ্ত এবং চিশতিয়া তরিকার মহান বুজুর্গ হযরত খাজা লস্কর মোল্লা (রহ.)’র নিকট চিশ্তীয়া ১৮৭০ সালে খিলাফত লাভ করে মহান বুজুর্গ হিসেবে আবিভর্‚ত হন। তিনি বহু ভারত, পাকিস্তান, ইরাক, ইরান, তুরস্ক, ফিলিস্তিনসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মহান বুজুর্গদের সহচর্য লাভ করেন। ১৯০১ সালে অনাবৃষ্টির কারণে ঢাকার নবাব খাজা সলিমুল্লাহ’র অনুরোধে এস্তেখার নামাজ পড়ান। নামাজ চলাকালেই এক হাঁটু পানিতে পল্টন ময়দান তলিয়ে যায়। এছাড়াও ১৯২১ সালে খিলাফত আন্দোলনের নেতা মুহাম্মদ আলী ও শওকত আলীকে খিলাফত আন্দোলনের মাধ্যমে মুসলমান জাতির জন্য স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার উপদেশ প্রদান করেন। এর ২৬ বছর পর ১৯৪৭ সালে উপমহাদেশের আজাদী লাভ হয়। ১৯২৬ সালে এই মহান মনীষী ইন্তেকাল করেন। এরমধ্যে দিয়ে তাঁর অন্তরদৃষ্টি তথা কাশফ-কারামত ফুটে উঠে।
তিনি ১৮৮৩ সালে বড়পীর গাউছুল আযম মহিউদ্দিন হযরত আবদুল কাদের জিলানী (রা.)’র ‘আল-কাসিদাতুল গাউছিয়া’ পদ্যের ফার্সি তরজমা করেন। স্ব-হস্তে পবিত্র কুরআনুল কারিমের অসংখ্য কপি লিপিবদ্ধ করেন। যার একটি কপি তিনি তাঁর অন্যতম খলিফা ও আখলাকে আহ্সানিয়ার লেখক মানিকগঞ্জ জয়মন্টপ পীরবাড়ি দরবার শরীফের প্রতিষ্ঠাতা মুন্সী শাহ আবদুল ওয়াহেদ (রহ.) উপহার দেন। দুর্লভ হস্তলিখিত কুরআন শরীফটি পীরজাদা মাহমুদুল হুদা খানের মাধ্যমে হযরত কেবলার সুযোগ্য নাতি আল্লামা শাহ মুহাম্মদ আহছানুজ্জামান (রহ.)’র হস্তগত হয়। বর্তমানে পবিত্র কুরআন শরীফটি মশুরীখোলা দরবারে সংরক্ষিত আছে।
ইসলামের প্রচার-প্রসারে অনবদ্য অবদান রাখেন এই মহান মনীষী। তিনি মশুরীখোলা সাভারে নিজ বাড়িতে ১৮৫৮ সালে মক্তর প্রতিষ্ঠা করেন। মাদরাসাটি নদী ভাঙ্গনে বিলন হলে। তাঁর সুযোগ্য নাতি আল্লামা শাহ মুহাম্মদ আহছানুজ্জামান (মা..জি.আ.) ১৯৮১ সালে দাখিল মাদরাসা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৭৬ সালে একই গ্রামে একটি মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৭১ ঢাকায় দারুল উলুম আহসানিয়া মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। যা বর্তমানে কামিল (মাস্টার্স) উন্নিত। ১৯১০ সালে ঢাকা নারিন্দা মশুরীখোলা শাহ সাহেববাড়ী জামে মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন। এছাড়াও তিনি ১৯১২ সালে নিজের অর্জিত সম্পত্তির বড় একটা অংশ দ্বীনি খেদমতের জন্য ওয়াকফ করেন। বর্তমানে এই ওয়াকফ এস্টেট ও তাঁর নামে প্রতিষ্ঠিত কমপ্লেক্স কমিটি ১৯টি মাদরাসা, কারিগরি এবং স্কুল পরিচালনা করছেন। আর এসবের পিছনে ছিলো তাঁর প্রজন্মের যোগ্য উত্তরসূরী মশুরীখোলা দরবার শরীফের চতুর্থ গদ্দিনেশীন পীর সাহেব ও হযরত শাহ আহসানুল্লাহ (রহ.) ওয়াকফ এস্টেটের ৮ম মোতাওয়াল্লী আল্লামা শাহ মুহাম্মদ আহছানুজ্জামান (রহ.)’র নিরলস শ্রম, অর্থ। তিনি তাঁর পিতামহ হযরত শাহ মুহাম্মদ আহসানুল্লাহ (রহ.), বড় চাচা হযরত শাহ আবদুল আজিজ (রহ.) এবং পিতা হযরত শাহ আবদুল লতিফ (রহ.)’র স্থলাভিষিক্ত হিসেবে দরবার ও কমপ্লেক্সের ব্যাপক উন্নয়ন সাধন করেন। হযরত কেবলার রেখে যাওয়া ৩টি প্রতিষ্ঠানে সংস্কার ও উন্নয়নে ভূমিকা রাখেন। বর্তমানে দুই শতাব্দীকালে ঐতিহ্যবাহী দরবার শরীফের গদ্দিনেশীন স্থলাভিষিক্ত চতুর্থ প্রজন্মের উত্তরসূরী ও আল্লামা শাহ মুহাম্মদ আহছানুজ্জামান (রহ.)’র ছোট সাহেবজাদা হাফেজ মাওলানা মুফতি সাইফুজ্জামান। হযরত কেবলা শাহ মুহাম্মদ আহসানুল্লাহ (রহ.) তাঁর প্রপিতামহ।
হযরত শাহ আহসানুল্লাহ (রহ.) শুধু ধর্মীয়ভাবেই নয় এই বঙ্গে মুসলমানদের রাজনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন। যার মধ্যে ১৯১২ সালে হযরত কেবলা তাঁর মুরিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নাথান কমিশনের সদস্যশামছুল উলামা আবু নসর ওয়াহেদ (রহ.)’র মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় তিন হাজার টাকা অনুদান প্রদান করেন। একজন পীর সাহেবের ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি আধুনিক শিক্ষার প্রতি প্রবল আগ্রহবোধ ঔপনিবেশিক আমলে বাঙালি মুসলামনের জন্য ছিলো অনুপ্রেরণার পাথেয়। বাংলা একাডেমি হতে প্রকাশিত জালালাবাদের কথা গ্রন্থে দেওয়ান নূরুল আনোয়ার হোসেন চৌধুরী বিষয়টি গুরুত্বের সাথে তুলে ধরেন। তিনি শিক্ষার পাশাপাশি বাঙালি মুসলমানের সামাজিক, সংস্কৃতি উন্নয়নে বিশ্বাসী ছিলেন। তাঁর অনুপ্রেরণায় ১৯২০ সালে বহুভাষাবিদ ড.মুহম্মদ শহীদুল্লাহ আঞ্জুমান-ই-ইশা‘আৎ-ই-ইসলাম প্রতিষ্ঠা করেন। হযরত কেবলা’কে সভাপতি ও বহুভাষাবিদ ড.মুহম্মদ শহীদুল্লাহ নিজে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।
হযরত কেবলা উপমহাদেশের ইসলামী শিক্ষা, সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিমÐলে অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তাই তিনি উপমহাদেশের ইতিহাসের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। এজন্য ইতিহাস নির্ভর গবেষণায় হযরত কেবলা শাহ মুহাম্মদ আহসানুল্লাহ রহমাতুল্লাহি আলাইহি অত্যান্ত প্রাসঙ্গিক ছিলেন। হযরত কেবলার শিষ্য এ.এফ.এম.আবদুল মজীদ রুশ্দী ১৯৬০ সালে “হযরত কেবলা” শিরোনামে এ জীবনালেখ্য’টি রচনা করেন। এখানে তিনি মোট চৌদ্দটি অধ্যায় হযরত কেবলার জীবনের নানাদিক সম্পর্কে আলোকপাত করেন। এ গ্রন্থ’টি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের ধর্ম মন্ত্রণালয়ে অধিনস্থ ‘ইসলামিক ফাউন্ডেশন পুন:মুদ্রণ করেন। লেখক গ্রন্থ’টি উৎসর্গ করেন হযরত কেবলার দ্বিতীয় সাহেবজাদা হযরত শাহ আবদুল লতীফ (রহ.)’কে। উপমহাদেশের প্রখ্যাত আলেম, পশ্চিমবঙ্গের লেখক ও গবেষক আল্লামা রুহুল আমিন বশিরহাটী (রহ.)’র বঙ্গ ও আসামের পীর আউলিয়া কাহিনী’তে বঙ্গ ও আসামের অন্যতম পীর শাহ আহসানুল্লাহ (রহ.) বলে উল্লেখ করেন। ইমামে আহলে সুন্নাত আল্লামা গাজী আজিজুল হক শেরে বাংলা আল কাদেরী (রহ.) তাঁর ফার্সি কাব্যগ্রন্থ দিওয়ানÑই-আজিজ এ হযরত কেবলাকে আলেমদের শিরমণি, আরিফদের আদর্শ এবং উচ্চ আধ্যাত্মিক ক্ষমতা সম্পন্ন যুগপ্রসিদ্ধ মহান মনীষী বলে উল্লেখ করেন। যার বাংলা অনুবাদ করেন আল্লামা এম.এ. মান্নান। ১৯৮২ সালে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের বিশ্বকোষে শাহ আহসানুল্লাহ (র.) সম্পর্কে তথ্য সন্নিবেশিত হয়। বহুভাষাবিদ ড.মুহম্মদ শহীদুল্লাহ’র বড় কন্যা মাহযুযা হক ড.মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ও পারিবারিক জীবন গ্রন্থে হযরত কেবলা সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দেন। ১৯৪৬ সালে প্রকাশিত হেকিম হাবিবুর রহমানের আসুদেগানে ঢাকায় হযরত কেবলা (রহ.)’র কথা লিখেন। গ্রন্থটি বাংলা অনুবাদ করেন মাওলানা আবুল কাজমী ও সম্পাদনা করেন ড. মোমতাজ উদ্দিন আহাম্মদ এবং প্রকাশ করে ঐতিহ্য প্রকাশনী। ১৯৯৬ সালে বাংলা একাডেমী হতে প্রকাশিত বরেণ্য গবেষক ড. মুহাম্মদ আবদুল্লাহ বাঙলায় খিলাফত অসহযোগ আন্দোলন প্রসঙ্গে তিনি হযরত কেবলার ভূমিকা সম্পর্কে লিখেন যৎসামান্য। তবে ১৯৯১ সালে ইসলামিক ফাউন্ডেশন হতে প্রকাশিত ঢাকার কয়েকজন মুসলিম সুধী শিরোনামে সবিস্তারের হযরত শাহ মুহাম্মদ আহসানুল্লাহ (রহ.) সম্পর্কে লিখেন ড. মুহাম্মদ আবদুল্লাহ। যেহেতু হযরত কেবলা শাহ মুহাম্মদ আহসানুল্লাহ (রহ.) এই বাংলার মুসলমানদের অধিকার আদায় ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে নানাবিধ অবদান রাখেন। তাই ইতিহাসের পাঠআর্বতে তাঁর আলোচনা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। তবে তাঁর খলিফা মুন্সী আবদুল ওয়াহেদ শাহ (রহ.)’র পুথিঁ আখলাকে আহসানিয়া সবচেয়ে ব্যতিক্রম এবং সর্বপ্রথম গ্রন্থ। লেখক মুন্সী আবদুল ওয়াহেদ শাহ (রহ.) ত্রিপদী তিন চরণবিশিষ্ট কাব্যের ছন্দ এবং প্রাচীনতম এ বাংলা ছন্দ তথা দ্বিপদী ছন্দ পয়ার আকারে লিখেন। পয়ার’কে অবশ্য ‘সাধু বাংলার ছন্দ বলে’। এখানে তিনি আল্লাহ পাক ও রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শানে স্তুতি পাঠ, আধ্যাত্মিকতা, তরিকতের শিক্ষা, জিকির-আজকার, উপদেশ, তরিকতের পরম্পরা, ঊর্ধ্বতন শায়খদের জীবনী, হযরত শাহ আহসানুল্লাহ (রহ.)’র বর্ণাঢ্য জীবনÑকর্মের নানা দিক সম্পর্কে সবিস্তারের অধ্যায় ভিত্তিক আলোকপাত করা হয়েছে। সর্বশেষ ৭টি মুর্শিদ সম্পর্কিত স্তুতি সন্নিবেশিত হয়েছে ১৩২ পৃষ্ঠার এই গ্রন্থে। ১৩২৩ বঙ্গাব্দে দারুল উলুম কমিটির পক্ষ সেক্রেটারী মৌলভী নুরুল হক চৌধুরী গ্রন্থটি প্রকাশ করেন। ৯ আনা হাদিয়া নির্ধারিত হয়। যা হযরত কেবলার প্রতিষ্ঠিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ধর্মীয় সংস্থার কল্যাণে ব্যয়ের প্রতিশ্রুতি দেন লেখক। আখলাকে আহসানিয়ায় ১৩টি ত্রিপদী এবং ২৪টি পয়ার স্থান পায়।
১৯২৬ সালে এই মহান মনীষী ১২৮ বছর ৩ মাস ২৭ দিন বয়সে বৃহস্পতিবার বাদ ফজর ইন্তেকাল করেন। (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহিরাজিউন)।এরি মধ্যে দিয়ে হযরত কেবলা শাহ আহসানুল্লাহ (রহ.)’র বর্ণাঢ্য জীবনÑকর্মের পরিসমাপ্তি ঘটে। তাঁর মাযার শরীফ মশুরীখোলা দরবার শরীফ ৪৭ নং শাহ সাহেব লেন নারিন্দা ঢাকায় অবস্থিত। যুগে যুগে যাঁরা মানুষকে দ্বীনের দাওয়াত দিয়েছেন, তাঁদের মানবতাবাদী চিন্তাধারা, অসা¤প্রদায়িক চেতনা, অসাধারণ মানবপ্রেম, অনুপম চারিত্রিক মাধুর্য, অতুলনীয় মানবিক মূল্যবোধ, দৃষ্টান্তমূলক সৎকর্ম, আমল ও পরিশুদ্ধ মননশীলতা দ্বারা বিশাল জনগোষ্ঠীকে আকৃষ্ট করতে সমর্থ হয়েছিলেন। এর ফলে দলে দলে মানুষ ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় নেয়। তিনি ছিলেন যুগশ্রেষ্ঠ সংস্কারক। তাঁর মত একজন আধ্যাত্মিক গুণে জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব জগতে সত্যই বিরল। প্রতি বছর ১১ কার্তিক তাঁর ওফাত দিবস ইসলামী ভাবধারা পালিত হয়। এ বছর ২৭ অক্টোবর ২০২৫ তাঁর ওফাত শতবার্ষিকী। এ উপলক্ষে ঢাকার ৪৭ শাহ সাহেব লেন নারিন্দাস্থ মশুরীখোলা দরবার শরীফে ২দিনব্যাপী নানা আয়োজন হাতে নেয়া হয়েছে।
আল্লাহ পাক আমাদের সকলকে এই মহান মনীষীর রূহানী ফয়েজ ধন্য করেন। আমিন।

লেখক : কো-অর্ডিনেটর, সেন্টার ফর ইসলামিক হেরিটেজ