বাসুদেব খাস্তগীর
বায়ান্নের একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের বাঙালি জাতিসত্তার বিকাশে অবিস্মরণীয় একটি দিন। বাঙালির এই যে হাজার বছরের ঐতিহ্য তা আমাদের বিশ্বে গৌরবের সাথে অনন্য এক পরিচয়ে পরিচিতি দান করেছে। একটি জাতির জাতিসত্তা নির্মাণ হয় হাজার বছরের পথ পরিক্রমায়। জাতিসত্তা হচ্ছে একটি জাতি বা গোষ্ঠিগত পরিচয়, এই জাতিসত্তা কিন্তু জাতীয়তা নয়। জাতিসত্তা রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্কযুক্ত নয় এবং অনেক ক্ষেত্রেই রাষ্ট্রের কোনো নির্দিষ্ট সীমানার মধ্যেও জাতিসত্তাকে আবদ্ধ রাখা যায় না। একাধিক জাতিসত্তার মানুষ যেমন একই রাষ্ট্রে বসবাস করে থাকে, আবার একই জাতিসত্তার মানুষ তেমনি একাধিক রাষ্ট্রে ছড়িয়ে থাকতে পারে। মূলত জাতিসত্তা নির্দিষ্ট কিছু জনগোষ্ঠী বা একটি জাতির আবহমানকাল ধরে জড়িয়ে থাকা কিছু চিরায়ত বৈশিষ্ট্য – যা কোনো নির্দিষ্ট ভূখন্ডে বিদ্যমান থাকে। সেটা কোনো রাষ্ট্রের সীমানায় হতে পারে বা নাও হতে পারে। কয়েকটি রাষ্ট্রের সীমানায় এর জাতিসত্তা দৃশ্যমান হতে পারে। আবহমান এই বাংলাদেশ ছাড়াও বিশ্বে বাংলা ভাষাভাষী বাঙালিদের মধ্যে এ জাতিসত্তার বৈশিষ্ট্য দৃশ্যমান হয়। বিশ্বে বাঙালি হিসাবে আমাদের যে পরিচয় তা আমাদের শিল্পসাহিত্য সংস্কৃতির আলাদা একটি পরিচয়ে পরিচয় দান করে। পৃথিবীর প্রত্যেক জাতির নিজস্ব একটি জাতিসত্তা আছে। সে জাতিসত্তার মাধ্যমেই আমরা সে জাতির পরিচয় পাই। সে জন্য পৃথিবীর প্রত্যেক জাতির জাতিসত্তা নির্মাণে সে জাতির দীর্ঘদিনের নানা প্রবাহমান সংস্কৃতি অবদান রাখে।
মূলত জাতিসত্তা মানে কোনো জাতির আত্মপরিচয়, যে পরিচয়ের মাধ্যমে কোনো জাতির পরিচয় অন্য জাতির পরিচয় থেকে আলাদা করে। সেটা ভাষা, সংস্কৃতি থেকে শুরু করে খাবার- দাবার চালচলন পোশাক পরিচ্ছেদ কথাবার্তাসহ অনেক কিছুই হতে পারে। ‘জাতি’ হচ্ছে একটি স¤প্রদায় যা একটি সাধারণ ভাষা, অঞ্চল, ইতিহাস, জাতিগততা ও সংস্কৃতির ভিত্তিতে গড়ে ওঠে। বাংলা ‘সত্তা’ শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে অস্তিত্ব বা বিদ্যমানতা। আর জাতিসত্তা হচ্ছে সে জাতির মধ্যে গড়ে ওঠা ইতিহাস ঐতিহ্য সংস্কৃতির অস্তিত্ব বা বিদ্যমানতা যা সে জাতির মধ্যে ইতিহাস ঐতিহ্য সংস্কৃতির মেলবন্ধন রচনা করে এবং এ বৈশিষ্ট্যের কারণে সে জাতিকে অন্য জাতি থেকে পৃথক করে নিজের পরিচয়ে পরিচিত হতে সহায়তা করে। এই আত্মপরিচয় গড়ে ওঠে একটা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। এই প্রক্রিয়া একদিনে গড়ে উঠে না। তার জন্য দীর্ঘ একটা সময়ের প্রয়োজন। জাতিসত্তা বিকাশের প্রক্রিয়া আবার সে জাতির দীর্ঘকালীন অনুশীলনও প্রক্রিয়াও বটে। জাতিসত্তা সে জাতির শিকড়ের অনুসন্ধান এবং সে শিকড়ের পরিচয় মানে তার আত্মপরিচয়। একটি জাতির বিকশিত জাতিসত্তা অন্য জাতিকে সম্মান করে ও অন্যদের জাতিসত্তার বিকাশে সাহায্যও করতে পারে। আমাদের বাঙালি জাতিসত্তার যে গৌরব তা বিশ্বজননী। বাঙালিদের চিন্তাধারা, ধ্যান ধারণা, শিল্পসাহিত্য আমাদের জাতিসত্তার আলাদা পরিচয় বহন করে। আমাদের এ বিকশিত জাতিসত্তা একজন বাঙালিকে গর্বিত করে, নিজের আত্মপরিচয়ের অধিকার সম্পর্কে নিজেকে সচেতন করে, জাতি স্বার্থের পরিপন্থী যে কোনো পদক্ষেপের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে প্রেরণা জোগায়। বাঙালির এ জাতিসত্তা হাজার বছরের হলেও আমাদের বায়ান্নের একুশে ফেব্রুয়ারির ভাষা আন্দোলন এই জাতিসত্তার ভিতকে আরও শক্তিশালী করতে গুরুত্বপ‚র্ণ ভ‚মিকা রেখেছে।
একুশ শুধু আমাদের কাছে একটি সংখ্যা নয়, বাঙালির প্রেরণার উৎসের নাম হয় একুশ। হাজার বছরের এ জনপদে যে মানবগোষ্ঠী বেড়ে উঠেছে এই গাঙেয় অববাহিকায়- সেই মানবগোষ্ঠীর আচার-আচরণ ও জীবনযাত্রার চালচলনের যে ধরন তার নাম বাঙালিয়ানা। এই বাঙালিয়ানাই আমাদের জাতিসত্তার পরিচয় এনে দিয়েছে। ধর্মের বন্ধনে দুটি ভিন্ন ভাষা ও সংস্কৃতির মানুষকে এক জাতিসত্তার চাদরে ঢেকে রাখা যায় না। জাতিসত্তা ভিন্ন একটি বিষয়। একুশের ঘটনা প্রবাহ তার প্রমাণ। হাজার বছরের নানা বাঁকে বাঁকে একটি জাতির সংস্কৃতি গড়ে ওঠে। পৃথিবীর প্রত্যেক জাতির নিজস্ব জাতিসত্তা ইতিহাস পর্যালোচনা করলে তা দৃশ্যমান হবে। বাঙালিদের ভাষা, শিল্প, সাহিত্য সংস্কৃতি, রীতিনীতির যে স্বকীয়তাবোধ তা ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালিরা বুঝিয়ে দিয়েছিল।
বাঙালি জাতিসত্তার এসব উপাদানই যে পশ্চিমা জনগোষ্ঠী থেকে সম্পূর্ণ আলাদা এ বাস্তবতা তারা অনুভব করেছিল অনেক দেরিতে। সে কারণে ভাষার জন্য আত্মত্যাগ এবং তার পিছনে ছিল আমাদের জাতিসত্তাকে অবজ্ঞা করার বিষয়। জাতিসত্তা জাতির অধিকার রক্ষার কথা বলে। সেই অধিকার রক্ষার প্রত্যয়ে বায়ান্নের একুশে ফেব্রæয়ারি ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর যে আঘাত এসেছিল তার প্রতিবাদে এদেশের ছাত্র-জনগণ রুখে দাঁড়িয়েছিল। প্রাণ দিয়েছিলো ছাত্ররা। ঢাকার রাজপথ রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল। সে ঘটনা আমাদের বাঙালি জাতিসত্তাকে আরও দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর করেছিলো। একুশ আমাদের ইতিহাসের উৎস, আমাদের বিবর্তন এবং আমাদের যাত্রাপথের বাঁকে বাঁকে বিদ্যমান নানা সমস্যার সম্ভাব্য সমাধান থেকে একুশের চেতনাই আমাদের উত্তরণের পথ দেখায়। আমাদের মনে রাখতে হবে মহান ভাষা আন্দোলনের চেতনা বাঙালি জাতিসত্তার স্মারক। আমাদের আত্মপরিচয় ও আত্মবিশ্লেষণের প্রধান প্রতীকও ভাষা আন্দোলন।
আত্মপরিচয়, আত্মবিশ্লেষণের নিবিড় অনুসন্ধানই হচ্ছে আমাদের বাঙালি জাতিসত্তা। ভাষা আন্দোলনের রক্তাক্ত পথ ধরেই এসেছে মহান মুক্তিযুদ্ধ। মাতৃভাষা আন্দোলন বাঙালি জাতির একটি গৌরবময় অধ্যায়, তেমনি মুক্তিযুদ্ধও বাঙালি জাতিসত্তার মূলমন্ত্র। একমাত্র বাঙালি জাতি ছাড়া পৃথিবীর কোনো জাতি ভাষার জন্য প্রাণ দেয়নি, এত প্রাণ যায়নি অন্য কোনো দেশের স্বাধীনতার জন্যও। এ দুটোই বাঙালির অহংকার। তাই বাঙালির ঐতিহ্যের জাতিসত্তার যে প্রবাহমান ধারা যুগযুগ ধরে প্রবাহিত হয়ে আসছিলো সেখান থেকে বিচ্যুতি না ঘটতেই একুশের আত্মত্যাগ। বাঙালিরা বুঝিয়ে দিয়েছিলো জোর করে চাপিয়ে দেয়া কোনো ভাষা বা সংস্কৃতি যুগযুগ ধরে প্রবাহমান জাতিসত্তার সাথে মেলবন্ধন রচনা করতে পারে না। সেজন্য ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস আমাদের জাতিসত্তাকে সামনে নিয়ে এসে এর বিকাশ এবং শিকড়কে আরও মজবুত করেছে। তাই বাঙালির জাতিসত্তা বিকাশে ভাষা আন্দোলনের ভূমিকা ইতিহাসে অবশ্যই অবিস্মরণীয়।
লেখক : প্রাবন্ধিক, শিশুসাহিত্যিক ও গীতিকার
সহকারী অধ্যাপক, বিএমসি ডিগ্রি কলেজ, চট্টগ্রাম